আফলাতুন হায়দার চৌধুরী

পরিব্রাজক, লেখক, ছবিয়াল

আফলাতুন হায়দার চৌধুরী

 

মার ডাকনাম সাগর। বাংলাদেশের ফেণী নামের এক শহরে জন্ম। সেখানেই বড় হওয়া। লেখাপড়াও সেখানে।। ফেণী সরকারী পাইলট প্রাইমারী স্কুল, ফেণী পাইলট হাই স্কুল, অতঃপর ফেণী কলেজ।

আই.এস.সি পাশ করে ফেনী কলেজে বিকম ডিগ্রী নেবার জন্য ভর্তি হয়েছিলাম। কিন্তু সেটা না করে আমাকে পাঠানো হল ট্রেনিংয়ে, ১৯৯০ সালে হলাম ফেনীছাড়া। ১৯৯২ সালে ট্রেনিং কমপ্লিট হল, জাহাজে চাকুরী পেলাম।  এবার হলাম দেশ ছাড়া।

এরপর অন-অফ, অন-অফ করে প্রায় সাড়ে নয় বছরের সমুদ্রজীবন, জাহাজের রেডিও অফিসার হিসেবে। তারপর লন্ডন পাড়ি দিই, বড় অফিসার হতে হবে। কোর্স, ট্রেনিং ইত্যাদি নিয়ে আস্তে ধীরে জাহাজের ক্যাপ্টেন হবো ইত্যাদি। কিন্তু ওসব ছেড়ে জেনারেল লাইনে পড়াশোনা করেছি। সারা জীবনের স্বপ্ন ছিলো ইউনিভার্সিটিতে পড়বো, অনার্স করবো, মাষ্টার্স করবো। জাহাজের কোর্সে যাওয়ার কারনে সেই সৌভাগ্য হয় নি। তাই বুড়ো বয়সে লন্ডনে আবার পড়াশোনা শুরু। প্রথমে চার্টার্ড এ্যাকাউন্টেন্ট হবার চেষ্ঠা করেছি। ওটা আমার বিষয় নয়, অসম্ভব। শেষমেষ এম.বি.এ নিয়ে সন্তুষ্ট আছি। কিন্তু জাহাজে আর নয়। লন্ডনে থিতু হয়েছি, গড়ে তুলেছি ছোট্ট একটি ঘর, পরিবার। বর্তমানে লন্ডন মেট্রপলিটান পুলিশ সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা হিসেবে কোনো মতে বেঁচে আছি।

আমার বাবা এবং মায়ের দিকের সবাই মিলে বিশাল এক পরিবার। সমগ্র বাংলাদেশ এবং বিদেশ, কোথাও গিয়ে একা হতে হয় নি। বিয়ের পর যোগ হয়েছে আরেকটি বিশাল পরিবার। কি যে সৌভাগ্য আমার। আমি মিশতে ভালোবাসি।

সব সময় মন জুড়ে থাকে আমার ছোট্ট শহর ফেণী। পরিবার, প্রিয়জন, বন্ধু সব ফেলে প্রবাসে এলেও মন প্রান জুড়ে থাকে আমার দেশ, শহর, প্রিয়মুখগুলো। আর, হৃদয়ের সবটুকু জুড়ে আছে আমার বন্ধুরা। প্রবাসী হয়েছি, বিদেশী হয়ে যাই নি।

সমুদ্রজীবনে যে সব অভিজ্ঞতা হয়েছে সেটা আমার সেরা সম্পদ। আমার সৌভাগ্য আমি সাত সাগর তেরো নদী দেখেছি। গিয়েছি দেশ থেকে দেশে, বন্দর থেকে বন্দরে। মিশেছি এবং দেখেছি নানান জাতি তাদের সভ্যতা, সমাজ, ইতিহাস, রাজনীতি, উন্নতি, জীবন প্রবাহ, সুখ-দুঃখ-হাসিকান্না। দেখেছি গহীন সমুদ্রে সরোবরের মত টলটরে সাগর জলে পূর্ণিমার চাঁদের প্রতিফলনে ভয়াবহ উজ্জ্বল গৃহত্যাগী জোছনা। দেখেছি ঝঞ্ঝা, দেখেছি ঝড়ের কবলে পড়ে পাহাড়সম ঢেউয়ের চুড়ায় উঠে বিশাল জাহাজ ভেঙ্গে দু টুকরো হয়ে যাওয়া, দেখেছি সাগরের জমে থাকা বরফে দিনের পর দিন আটকা পড়ে থাকা, সেই বরফের উপরে সীলদের দুষ্টুমী। দেখেছি প্রাচ্য, দেখেছি প্রতীচ্য। দেখেছি তপ্ত মরুভুমি, দেখেছি ভয়াবহ বরফের দেশ। আর, দেখেছি মানুষ। নানান দেশের নানান জাতের মানুষ। জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা পেয়েছি সেখান থেকে। তারপর থিতু হয়েছি প্রবাসে। এখানেও অভিজ্ঞতা কম নয়।

এক সময় ফিল্ম এসএলআর (Film SLR) ক্যামেরায় ছবি তুলতাম। পরে শিখেছি ছবি তোলা আর ফটোগ্রাফী এক নয়। প্রফেশনাল ডিএসএলআর কিনে মনে হচ্ছিলো, ‘দুনিয়া উল্টাইয়া ফালাইতেছি’। এরপর আমি নয়, আমার বৌ হয়ে গেলেন প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার। অবশ্যই নন-কমার্শিয়াল। ডিএসএলআর, মিররলেস ক্যামেরা, স্ট্রোবস, ডিফিউজারস, ট্রাইপড, কিটস্, প্রপস আরো কত কি! তার দুর্দান্ত সব ক্লিক্ আমিসহ হাজারো মানুষকে হতভম্ব করে ফেলে।

আমি ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসি। ভালোবাসি পরিচিত হতে, নতুন মানুষদের সাথে মিশতে। ভালোবাসি উচ্চতা, পাহাড়, পর্বত, জলাশয়, নদী, সমুদ্র, গাছ, প্রানী, জঙ্গল, গ্রাম, শহর সবকিছু।

 

ভালোবাসি জীবন, পরিবার, বৌ আর ছেলেমেয়েদের।
ভালোবাসি বন্ধুদের।

ভালোবাসি নদীর ধারের ছোট্ট ঘরটি।