এক সময়ের বিরক্তিকর হিন্দী গান আমায় নিয়ে যায় বহুদূরে

“এই খান থেকে দুই হাজার কিলোমিটার উত্তরে আমার দেশ, আমার বাড়ী, আমার ঘর।”

গতকালের সাইক্লোন ইণ্ডিয়ার দিকে চলে গেছে। পেছনে রেখে গেছে কোমল হাওয়ার বে অফ বেঙ্গল। বাইরে দারুন মিষ্টি রোদ, মৃদুমন্দ বাতাস। গভীর নীল সাগরের জলের উপর ছোট ছোট তরঙ্গ। বঙ্গোপসাগরের যেখানটায় আমরা আছি সেটা নিকোবার আইল্যাণ্ড থেকে প্রায় তিনশ নটিক্যাল মাইল পশ্চিমে। ব্রীজের বাইরে বেরিয়ে চারপাশ দেখলাম। শুধু পানি আর পানি। নীলের পর নীল আকাশে এক টুকরো মেঘ নেই, কোন পাখিও দেখতে পেলামনা। তবে সাগরে প্রচুর ডলফিন আছে, আমাদের জাহাজের সাথে পাল্লা দিয়ে ডাইভ দিয়ে চলেছে। তিমি দুটো এখনও আছে। ষ্টারবোর্ড সাইডে প্রায় আধমাইল দুরে। শান্ত সাগরে ফোয়ারা ছাড়তে ছাড়তে আমাদের সাথে এগিয়ে চলেছে, পাশাপাশি। স্পীডও সেইম। মাঝে মাঝে পিঠ দেখা যায়, লেজও।

পণ্ডিতের মত ডায়ালগ ছাড়লাম, “হুমম, একেই বলে ডীপ সী। ল্যাণ্ড দৃষ্টি সীমানার বাইরে। আকাশে পাখিও নেই।”
দুষ্টু একটা হাসি দিলো মুমতাজ, “কি বলো? বাড়ীর এত কাছে এসে বলছো ডীপ সীতে? ইউ আর ইন ইউর ওউন সী। ইটস্ বে অফ বেঙ্গল ম্যান!”
ষ্টারবোর্ড সাইডে যেদিকে তিমিগুলো সাঁতরাচ্ছে সেদিকে দেখিয়ে বললো,
“এখান থেকে সোজা উত্তরে তোমার বাংলাদেশ।”

বাংলাদেশ. . . শব্দটা কানে যেতেই বুক হু হু করে।

ষ্টারবোর্ড সাইডের সর্ব ডানে উইংয়ের উপর দুহাতের বাহু রেখে উত্তর দিকে তাকিয়ে আছি শূণ্য দৃষ্টিতে। জাহাজের কোর্স এখন ২৭০ ডিগ্রী, পশ্চিমে যাচ্ছে। সকালের টি টাইমে ব্রীজে এসেছিলাম আড্ডা দিতে। মিষ্টি ঢেউয়ের গহীন সাগরের গাঢ় নীলপানি মন দ্রবীভূত করে দেয়। সকালের সূর্য্যটা পেছনে, উপরে উঠতে এখনো ঘন্টা দুয়েক বাকি। চারিদিকে খোলা আকাশ। উপর দিকে তাকিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখলাম, গাঢ় নীল। কোথাও এক টুকরো মেঘ নেই। কে বলবে গত তিনদিন কি ভয়াবহ ঝড়ের কবলে ছিলাম? বিশাল গাঢ় নীল আকাশ অনেক অনেক উপর থেকে বহুদুর গিয়ে চারপাশে সাগরকে ঘিরে রেখেছে। ভিজিবিলিটি এতই ক্লীয়ার যে সাগরের শেষ পর্যন্ত দেখা যায়। অনক অনেক দুরে, যেখানে আকাশ সাগরের সাথে মিশেছে তার নাম দিগন্ত বা হোরাইজন।

ব্রীজের ডানপাশের উইং থেকে এখনও চেয়ে আছি উত্তর দিকে। নীল বঙ্গোপসাগর, দৃষ্টি বহুদুর যেতে যেতে শেষ হয়ে মিলিয়ে যাবার আগেই সাগরের নীলজল নীচের দিকে নেমে গেছে। আকাশটা আরো দুরে গিয়ে দেয়ালের মত নেমে গেছে। এ থেকে প্রমানীত হয় পৃথিবী গোল। ছেটবেলার লেখাপড়া মনে আসতে লাগলো, “সমুদ্রে দুর থেকে আসতে থাকা জাহাজের মাস্তুল দেখা যায় প্রথমে, তারপর ধীরে ধীরে পুরো অবয়ব দৃশ্যমান হতে থাকে।” মনে আসতে থাকে দেশের কথা, ছেলেবেলার কথা। ছোটবেলায় নানুবাড়ীতে একবার আকাশ ধরার জন্য যেতে যেতে হারিয়ে যেতে বসেছিলাম। যত আগাই আকাশ তত পেছাতে থাকে। এখান থেকে সোজা দুই হাজার কিলোমিটার (১০৮০ নটিক্যাল মাইল) উত্তরে আমার দেশ। আমার বাড়ী, আমার ঘর। আমার বাংলাদেশ।
মাত্র তিন মাস আগেও দেশে সবার মাঝে ছিলাম, আর এখন গহীন সমুদ্রে। আমার এখনকার অবস্থান ভারত মহাসাগরের উত্তরে, বঙ্গোপসাগরের দক্ষিনে। পাগলের মত দেশকে মিস করছি, বুকটা হু হু করছে। কি অদ্ভুত কপাল, চিটাগাং থেকে ভিয়েতনাম। সেখান থেকে আবার জর্ডানের আক্বাবা। সেই লোহিত সাগরের শেষ প্রান্তের এক শহরে। দুনিয়ার অর্ধেক দুরত্বে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রেডিও রুমে ঢুকতে হিন্দী সিনেমার গান কানে এলো। খালিদ জাভেদ এস.এল.বি.সি (Sri Lanka Broadcasting Corporation) টিউন করে গান শুনছে। এই গান আগেও শুনেছি, এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে গেছে। জীবনেও খেয়াল করে শুনিনি। সারাদিন সবখানে এসব গান বাজতো, কখনো পাত্তা দিই নি। কিন্তু এখন একসাথে এত স্মৃতি এসে জড়ো হচ্ছে! মনে হল এই সুর, এই গান কত যে আপন. . .

ধীরে ধীরে পেয়ার কো বাড়া না হ্যায়
হাধ্ সে গুজার জা না হ্যায়
মুঝে ব্যাস তুঝ সে দিল লাগানা হ্যায়
হাধ্ সে গুজার জা না হ্যায়
ধীরে ধীরে পেয়ার কো বাড়া না হ্যায়
হাধ্ সে গুজার জা না হ্যায় . . .

ডুয়েট গান। শিল্পী আলকা ইয়াগনিক আর কুমার শানু। ছবির নাম নাম ফুল অওর কাঁটে। রোমান্টিক নাকি এ্যাকশন ছবি জানিনা, আমি দেখিনি। নায়ক অজয় দেবগন আর নায়িকা মধু, ইংরেজী বানান Madhoo. অজয় দেবগনকে দুষ্টুমী করে বলতাম অজয় দেব-ঘণ। ওরেব্বাপ রে, তখন কুমার শানু আর অলকা ইয়াগনীকের ডুয়েট গান মানে সিনেমা সুপারহিট। এই সব সুপারহিট গানগুলো শহরের প্রতিটি ক্যাসেটের দোকান, হোটেল-রেষ্ট্যূরেন্ট, চা দোকান, নাপিদের দোকান, রেডিও মেকার, দুর পাল্লার বাস, পিকনিকের বাস সবখানে অনবরতঃ বাজতে থাকে। অনিচ্ছাসত্বেও সারাক্ষন শুনতে শুনতে মনের অজান্তে গানগুলো মুখস্থ হয়ে যায়।


বাকী সবার মত আমাদের বাসায়ও ভিসিপি (Video Cassette Player) ছিলো। যে কোন ছবি মুক্তি পাওয়ামাত্র নিয়ে আসা হত শাহীন ভাই’র ‘ভিডিও শাহীন’ বা মুক্তা মামার ‘আনন্দ ভিডিও’ থেকে। কেন জানি হিন্দী ছবি ভালো লাগতো না, একেকটা ছবি তিন ঘন্টা লম্বা। গান টেনে টেনে দেখলেও দুই/আড়াই ঘন্টার কমনা। তাছাড়া হিন্দী ভাষা শুনতে বিশ্রী লাগতো। কেমন জানি, খ্যাতমার্কা। আমাদের স্থানীয় (ফেণী-নোয়াখালী) ভাষার সাথে অনেক মিল। হিন্দী ভাষা শুনলে মনে হয় এরা চলিত বাংলার মত মিষ্টি করে কথা বলতে জানেইনা। আরেকটা অদ্ভুত বিষয় হল, নোয়াখাইল্লা ভাষায় প্রতিটা শব্দের সাথে হায় লাগয়ে দিলে হিন্দী হয়ে যায়। হিন্দী আর উর্দু ভাষা শুনতে (প্রায়) একই। অক্ষরগুলো দেখতে আলাদা, উর্দু আরবী হরফ হিন্দী সংষ্কৃত অক্ষর। হিন্দী সিনেমা যে একেবারে দেখিনা তা কিন্তু না। আমার জীবনে প্রথম তিন ঘন্টা একবসায় দেখা ছবি কেয়ামত সে কেয়ামত তক, খুব ভালো লেগেছিলো। সেই থেকে আমীর খানের দারুন ভক্ত আমি। এছাড়া ভালো লেগেছে মাসুম, আরো অনেক ছবি আছে ভালো লেগেছে, নাম মনে পড়ছেনা।

এতোই নষ্টালজিক হয়ে গেছি যে কয়েক মূহুর্তের মধ্যে ফ্লাশের মত একরাশ স্মৃতি একের পর এক ঝলসে উঠছিলো। দেশে বহুবার শোনা হিন্দী গান রেডিওতে শুনে দেশের কথা ভাবা। সব মিলিয়ে একরাশ আবেগ মনটাকে আনচান করে দিয়েছ। এক সময় যা ছিলো বিরক্তিকর, এখন কি যে ভালো লাগছে।


আবার কষ্টও হচ্ছে। বড় হয়ে গেছি। বন্ধুদের আগে চাকরীতে যোগ দেয়া মানে বয়স হবার আগে বুড়ো হয়ে যাওয়া। সেই কষ্ট আরো ভয়াবহ। বন্ধুরা সবাই এখনো লেখাপড়া করছে, ফুল টাইম ষ্ট্যুডেন্ট। ফুল টাইম এনজয়মেন্ট। কেউ অনার্স, কেউ পাস কোর্স। ফেণী কলেজে তখনও অনার্স কোর্স আসেনি। অনেকে চিটাগাং ইউনিভার্সিটিতে, কেউবা ঢাকায়। সবাই তারুন্যের উচ্ছ্বলতায় ভাসছে। কোথায় যেন শুনেছিলাম ছাত্র জীবন জীবনের শ্রষ্ঠ সময়। আমার শ্রেষ্ঠ সময় ফুরিয়ে গেছে, বন্ধুরা এনজয় করছে। ভাবতে কষ্ট লাগে, বুক ফেটে যায়, হিংসে হয় ওদের।


শর্টওয়েভ ষ্ট্যাটিকের সাথে ওঠানামা করতে থাকা সুপারহিট এই গানটা যেন কানে মধু ঢেলে দিচ্ছিলো। আমি হারিয়ে যাই দুই হাজার কিলোমিটার দুরে। আমার দেশে, প্রিয় শহরে। স্মৃতিময় ভালোবাসার গান বেজে চলছে . .

ম্যায় এ্যাকেলা কেয়া করতা
এ্যায়সে হি আঁহে ভারতা
তেরে পেয়ার কে লিয়ে তাড়াপতা উমর ভর
তেরা চাঁন্দ সা মুখড়া
তু জিগার কা হ্যা টুকরা
তু হামারে সাপ্নো কি ঝিল কা কানওয়াল
ধীরে ধীরে পেয়ার কো বাড়া না হ্যায়
হাধ্ সে গুজার জা না হ্যায় . . .

ভালোলাগায় মন ভরে যায়, গলা ধরে আসে। চোখের পানি আটকাতে না পেরে ছুটে ব্রীজের পেছনে চলে আসি। এখন কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা। ব্রীজ ডেকের পেছনে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে বাতাসে চোখ শুকানোর চেষ্টা করছি। অনেক নীচে মেইন ইঞ্জিন থেকে গম্ভীর একটানা চাপা গর্জনের শব্দ ফানেল দিয়ে হাল্কা ধোঁয়াসহ বেরিয়ে আসছে। ষ্টাররোর্ড সাইডে তিমি দুটো এখনও আছে, একটু পর পর ভূস ভূস করে ফোয়ারা ছাড়ছে। পেছনে জাহাজের দীর্ঘ ট্রেইল, প্রপেলারের থ্রাষ্ট। উত্তরদিকে খোলা বিশাল সাগর। যতদুর চোখ যায় তার চেয়েও বহু, বহুদুরে আমার দেশ। আমাদের বাসা, ওখানে আবার কবে যাবো? কবে ঘুমাবো আমার বিছানায়?


সাগরের গল্প (পূর্ণাঙ্গ ভ্রমণ উন্যাস)

© লেখক: আফলাতুন হায়দার চোধুরী

পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৩০০

মূল্য: ১০০০.০০ টাকা

প্রকাশক: অনন্যা। বাংলা বাজার ঢাকা

টেলিফোন অর্ডার: ০১৯১৪০২৪৬৬৪ (২৪ ঘন্টায় ডেলিভারী, শর্ত প্রযোজ্য)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Post comment