Doctor @ Holy Crescent Ctg.
আমি আর ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার স্মোকরুমে বসে হিন্দি মুভি দেখছি। মাসুম। কতো আগের, তবু কি যে সুন্দর! রাত প্রায় বারো ছুঁই ছুঁই করছে। দুই হাজার সালের রোজার মাস, রমজান 2k। আমাদের জাহাজ এখন চট্টগ্রাম আউটারে, “ব্র্যাভো”” এ্যাংকারেজে। গম নিয়ে এসেছিলাম অষ্ট্রেলিয়া থেকে। সাহায্য। স্পেশাল ব্রাশ্ড হুইট। ডিসচার্চ হয়েছে ষাট ভাগ চিটাগাংয়ে আর চল্লিশ ভাগ মংলায়। চিটাগাংয়ের ষাট ভাগ খালাস করতে লেগেছে আ দিন, বাকীটা মংলা জেটিতে করতে লেগেছে এক মাস। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পোর্টের নাম “মংলা”। এ বিষয়ে কিছু লিখতে ইচ্ছে করছেনা। গত কুড়ি বছরে নাকি এত উন্নতমানের ধবধবে সাদা, মোছা গম বাংলাদেশে আসেনি। ভিক্ষার চাল কাঁড়া আর আকাঁড়া। অথচ এই জিনিষ নিয়ে নাকি মন্ত্রী মিনিষ্টাররাও কার্গো রিসিভার পার্টিকে বিরক্ত করে মারছে। আবে হালা! গু মেশানো গমের আটা খায় সারা বাংলার মানুষ সে খবর রাখে কেউ? এই ময়দা, ওই ময়দা, সারা দেশে কত ব্র্যান্ডের ময়দা! গমগুলো সব জাহাজে করে আসে, লেবাররা ডিসচার্জ করার সময় ওই গমের উপর হাগে, আর মোতে। গুয়ে গমি মিশে হয় দুজনে দুজনার, রংও একই। সাইলোতে ডিসচার্জ হলে অবশ্য সে সম্ভাবনা থাকেনা, কিন্তু চিটাগাং পোর্টে সবেধন নীলমণি একটাই গ্রেইন সাইলো জেটি, ওতে আর ক’ জাহাজ ধরে? দেশে থাকলে সকালের নাস্তার সময় প্রায় ব্যাপারটা মনে পড়ে, আমি হাসি। কিন্তু খেতে একটুও অসুবিধা হয় না। পাউরুটি, বার্গার-বন, বিস্কিট, ময়দা জাতীয় সব কিছুই হয় গম থেকে। ওসব গম জাহাজে করে দেশে আসে, খালাস করার সময় পোর্টের খালাসীার ওগুলোর উপর সামান্য হাগে, এটা দোষের কিছু নয়।
মংলা থেকে কোনো মতে আমাদের জাহাজ ছেড়ে চিটাগাংয়ে আসে। ক্যানাডা থেকে মাদার ভেসেল আসবে, কিন্তু জেটীতো দুরে থাক, কাছাকাছিও নোঙ্গর করতে পারবেনা তাই নোঙ্গর করেছে কুতুবদিয়ার কাছে। তখন আমরা গিয়ে ওই জাহাজ থেকে কার্গো নিয়ে আসবো। এটাকে বলে লাইটারিং। মাদার ভেসেল আসতে দেরী আছে, তাই চুপচাপ অপেক্ষা। ইফতারের কিছু পরই তারাবীহ্র নামাজ শুরু হয়। রোজার মাস বলে স্মোকরুমে অফিসারদের আড্ডাও তেমন জমছে না। তবু মাঝরাতে একটু হাঁটাহাঁটি করতে বেরিয়ে স্মোকরুমে উঁকি দিয়ে ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ারকে দেখে বসলাম। মাসুম। দেখা ছবি, আবার দেখতে খারাপ লাগছেনা বরং আরো ভালো লাগছে। ছেলেটি নাসিরউদ্দিন শাহ্ কে বলছে – আমি যদি তোমাকে বাবা বলে ডাকি তুমি কি কিছু মনে করবে? – চমকে নাসিরুদ্দিন শাহ্ ছেলেটার দিকে তাকা, আর তখনই মাসুম ছবির বিখ্যাত গানটি বেজে ওঠে। কি সুন্দর, কি সুন্দর! ধুপ করে দরজা খোলার শব্দ, ক্যাপ্টেন।
“তাড়াতাড়ি উপরে যাও, চীফ ইঞ্জিনিয়ার মারাত্বক এ্যাকসিডেন্ট করেছে।”
আমরা হতভম্ব। কোন সমস্যা নেই, কথা নেই বার্তা নেই চীফ ইঞ্জিনিয়ার কি এ্যাকসিডেন্ট করতে পারে? ইঞ্জিনরুমে তো বড়সড় কোন কাজকারবার চলছে না? জাহাজ নোঙ্গর ফেলে আছে, সরোবরের মতো টলটলে শান্ত সাগর। দুলুনি-ফুলুনির প্রশ্নই ওঠেনা। বয়সতো অনেক! হার্ট এ্যাটাক নাকি? নানান কথা ভাবতে ভাবতে উপরে উেঠে দেখি চীফ ইঞ্জিনিয়ারের কেবিনের সাদা টাইলস রক্তে ভেসে যাচ্ছে। . . . . হায় হায় এম.ই.আর গ্রুপের কর্ণধার মজুমদার ভাইয়ের দেওয়া টাইলস্, গিফ্ট। আমাদের জাহাজের বড়সড় রিপেয়ার হচ্ছিলো কর্ণফূলী নদীর আর.এম-৮ এ ()। অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এম.ই.আর গ্রুপ ভালো কাগ পেয়েছিলো। শেষের দিকে ক্যাপ্টেন একদিন বললেন,
“মজুমদার ভাই এক কাজ করেন। আমার এবং চীফ ইঞ্জিনিয়ারের কেবিন, ওউনার্স কেবিন, স্মোকরুম এসবের জন্য প্রয়োজনীয় টাইলস্ কিনে পাঠান আর লোক লাগিয়ে দেন। কতইবা যাবে? অনেক পয়সাতো বানালেন।”
অপ্রস্তুত হয়ে বেচারা প্রথমে ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করলেও পরে টাইলস্ লাগিয়ে দেন। আহ্হারে, মজুমদার ভাইর অফ-হোয়াইট টাইলসের অবস্থা কাহিল। এতো রক্ত? ক্যপ্টেন বললেন টয়লেট থেকে বের হবার সময় খেয়ার করেন নি বেডরুমের বেডের ড্রয়ার খোলা ছিলো, হুমড়ি খেয়ে পড়ে যান সেখানে, ডান পায়ের নীচের মাসলে ড্রয়ারের কোনা ঢুকে গেছে, স্টিচ লাগবে। ক্যাপ্টেন ভেতরে যাবেন না, রক্ত দেখলে মাথা ঘোরে। স্টিচের কথা শুনে খুশী লাগলো। জেঠুকে ছুঁচ মারা হবে। ইয়াল্লাহ্, ক্ষতটা যেন জাভেদের চেয়েও বড় হয়। জাভেদের কথা বলি……
আমাদের জাহাজ তখন সিঙ্গাপুর জুরং শীপ-ইয়ার্ড থেকে ড্রাই ডকিং, রিপেয়ার ইত্যাদি শেষে অষ্ট্রেলিয়ার পথে। ওখান থেকে লোড নিয়ে বাংলাদেশে আসবে। ইন্দোনেশিয়ান কোষ্টস পেরিয়ে এর মধ্যে মহাসুমদ্র, যাকে বলে হাই-সী। দক্ষিন থেকে দক্ষিনে যাচ্ছি। প্রতিদিন ওয়েদার মেসেজ আসে, সব ঠিক আছে শুধু সোয়েলগুলোর হাইট বেশী বেশী। এরমধ্যে তাপমাত্রা কমতে কমতে শীতকালের মত লাগতে আরম্ভ করেছে। উত্তর গোলার্ধে যখন সামার, দক্ষিনে উইন্টার এবং সেটাই স্বাভাবিক। জাহাজও রোলিং-পিচিং করা শুরু করে দিয়েছে সমানে। কোনো কিছু না ধরে দাড়ানোর উপায় নেই। তারপরও খালি জাহাজ, আছাড়-পিছাড় বেশী বেশী হচ্ছে। সেদিনও গভীর রাতে নীচে থেকে একটা কাজ সেরে কেবিনে ঢুকছি, ক্যাপ্টেন আমাকে ডাকলেন, যেন আমার অপেক্ষায়ই ছিলেন।
“তুমি কি স্টিচিং জানো?”- এই যা, ক্যাপ্টেন আমাকে দিয়ে কাঁথা সেলাই করিয়ে ছাড়বে। এমনিতেই কত্তো রকমের কার যে করায়! কপালে নির্ঘাৎ ক্যানভাস সেলাই লেখা আছে। ঢোক গিলে বললাম জানিন স্যার।
“তাহলে তাড়াতাড়ি চেঞ্জ আপ করে ট্রিটমেন্ট রুমে চলে যাও, জাভেদ এক্সিডেন্ট করেছে, স্টিচিং লাগবে।”
আমার মাথাটা ভোঁ ভোঁ করে উঠলো। বলি কি? আমি ভাবলাম কোথাও ক্যানভাস ট্যানভাস ছিঁড়ে গেছে।
“স্যার, সেকেন্ড অফিসার? (যেহেতু সেকেন্ড-মেট জাহাজের মেডিক্যাল অফিসার)
“ওর হাই প্রেসার।” ক্যাপ্টেন বললেন।
“চীফ অফিসার?”
“ও পারবে না।” ক্যাপ্টেন আবার বললেন।
“স্যার আপনি?” ক্যাপ্টেন লাজুক গলায় বললেন,
“রক্ত দেখলে আমার মাথা ঘোরে, প্রেশার বেড়ে যায়। তাড়াতাড়ি যাও।”
অগত্যা গেলাম ট্রিটমেন্ট রুমে। চীফমেট, থার্ডমেট, ক্যাডেটস্ সবাই আছে। জাভেদ বেড়ে শোয়া। গায়ে নীল বয়লার স্যূট, পায়ে সেইফটি শু। একজন ক্যাডেট অনেকগুলো কটন দিয়ে ক্ষতস্থান চেপে ধরে আছে, খুব একটা লাভ হচ্ছে না। আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে নীচ নামছে রক্তের ধারা। অমি ক্ষতটা দেখতে চাইলাম। থুতনির ঠিক নীচে গলায় ইঞ্চি দেড়েক চওড়া, গভীর, হা হয়ে আছে। সুন্দর ফর্সা মুখ জাভেদের, এখন যন্ত্রনায় কাতর। পাল্সের প্রতি বিটের সাথে একদলা করে রক্ত বের হচ্ছে। দেখে বোঝা যায় স্টিচিং ছাড়া কোনো উপায় নেই। জাভেদ নতুন ক্রু, ডেক ডিপার্টমেন্টে। ওরা সবাই রাত বারোটা অব্দি হ্যাচে কাজ করছিলো। ম্যানহোলের মত কার্গো হোল্ড এক্সেসওয়ে থেকে বেরিয়ে ডেকে দাঁড়াতেই জাহাজের দুলুনিতে নিজের শরীরের ব্যালেন্স রাখতে না পেরে সামনের দিকে সটান আছড়ে পড়ে ছোট ছোট করে কাটা স্টীলের স্তুপের উপর, জুরং শীপইয়ার্ডের রিপেয়ারোত্তর স্ক্র্যাপ্স। তারই একটা ধারাল ফলা থুতনির তলা দিয়ে জাভেদের গলায় ঢোকে।
* * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * *
বাইরে অবস্থা খারাপ, সমুদ্র উত্তাল। প্রচন্ড দুলুনিতে দাঁড়িয়ে থাকা দায়। ট্রিটমেন্ট রুমে সবই আছে, ব্যান্ডেজ, নীড্লস এন্ড থ্রেডস্, ফোরসেপস, লিউকোপ্লাস্ট, এন্টিসেপটিক লোশন, ওষুধপত্র সব। নেই শুধু লোকাল এনেসথেসিয়া (Anesthesia) করার ব্যাবস্থা। জাভেদকে বললাম,
“অবশ করার কিছু নেই, কিন্তু সেলাই করতেই হবে। অনেক রক্ত ঝরেছে, সেলাই না করলে রক্ত বন্ধ হবেনা। সেলাইয়ের সময় ব্যাথা পাবে, পারবে সহ্য করতে?”
“পারবো স্যার।” মনটা হু হু করে উঠলো। মাত্র দুটো শব্দ, বলতে ওর অনেক কষ্ট হচ্ছিলো।
ফার্স্ট-এইড কোর্স করার সময় পরীক্ষা পাশের অন্যতম বিষয় ছিলো দুটো ফোরসেপ দিয়ে নীড্ল এবং থ্রেডে হাত না লাগিয়ে স্টিচিং করে দেখানো। ঠিকমতো না হলে ফেল। এখানে অবস্থা অন্যরকম। জাভেদকে ধরে আছো দুজন, আমাকে ধরে আছে আরো দুজন, যারা ধরেছে তারাও নিজেদের স্থির রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। প্রচন্ড রোলিংয়ে পড়েছে জাহাজ, ট্রিটমেন্ট রুমে ডান থেকে বাঁয়ে গড়াচ্ছে জাভেদের রক্ত। অনেক রক্ত হরিয়েছে সে। লোকাল এনেস্থিসিয়া ছাড়া খোলা হাতে ডাক্তারী সুঁই-সুতো দিয়ে স্টিচিং শুরু করলাম। প্রতি মুহুর্তে আল্লাহ্কে ডাকছি, যেন জাভেদ ব্যাথা কম পায়। এর মধ্যে কতবার যে সুঁই দিতে গিয়েও পারিনি জাহাজের দুলূনির কারনে। দাঁতে দাঁত চেপে দুটো হাতকে সে প্রানপনে মুঠ করছে আর ছাড়ছে। ব্লীডিং হচ্ছে অঝোর ধারায়। ভেবেছিলাম তিনটায় হবে, পাঁচটা স্টিচের পর দুটো এজ (edge) পরষ্পর মিললো, ভালোভাবেই। এন্টিবায়োটিক লোশন দিয়ে সব ভালোভাবে মুছেটুছে পরিষ্কার ব্যান্ডেজ করে দিলাম। সেকেন্ড-মেট প্রয়েজনীয় এন্টিবায়োটিক ইত্যাদি দিয়েছে। শক্ত ছেলে জাভেদ, ওর জায়গায় আমি হলে ও আল্লারে, ও আল্লারে করে পুরো জাহাজ মাথায় তুলতাম।
সাতদিন পর আছাড় খেতে খেতে দক্ষিন-পশ্চিম অষ্ট্রেলিয়ার এসপারেন্স পোর্টে পৌঁছলাম। প্রথমেই পোর্ট অথরিটির একটা বিশেষ টাগবোটে জাভেদকে হাসপাতালে পাঠালেন ক্যাপ্টেন এবং বলে দিলেন প্রয়েজনে কস্মেটিক সার্জারী করতে হলে তা-ও যেন করা হয়। সার্জারী-ফার্জারী কিছু লাগেনি। সেকেন্ড-মেটের দেওয়া প্রেসক্রিপশানও ঠিক আছে। ওরা শুধু আবার ড্রেসিং করে একটা মলম দিলো এবং বললো ওটা নিয়মিত মাখলে ঐ কাটা দাগও একসময় আর থাকবেনা কারন সেলাই খুব ভালো হয়েছে। মনে মনে বলি মাশাল্লাহ্, ভবিষ্যতে চাকরী-বাকরী না পেলে কাঁথা সিলাই করে সংসার চালাতে পারবো।
আজ এত্তোদিন পর আবার একই ধরনের সমস্যা, ফের স্টিচিং। আমার দোয়া কবুল হয়েছে, একটু বেশী করে কবুল হয়েছে। চীফ ইঞ্জিনিয়ারের পায়ের মাসল বিশাল ফালি হয়ে গেছে। তাঁকে সোফায় শোয়ানো হল, পায়র তলায় বালিশ দেয়া হল। খুব যত্মের সাথে সবাই মিলে তাঁর ক্ষতস্থানের যত্ম নিতে থাকলাম। ইতিমধ্যে প্রচুর রক্ত ঝরেছে তাই বেশী বেশী রক্ত এখন আর ঝরছেনা। স্ট্যূয়ার্ডেরা এসী চীফ ইঞ্জিনিয়ারের কেবিন ক্লীন করে ফেললো। মজুমদার ভাই’র টাইলস্ Johnson & Johnson Sol-Plus floor cleaner এর পরশে আবার ঝিকমিক করছে। এর মধ্যে সেকেন্ড মেট সব যন্ত্রপাতি নিয়ে এসেছে। এবার এনেস্থিসিয়া আছে, ইঞ্জেকশন নয়, এক ধরনের জেল যা অত্যন্ত কার্যকরী। ক্ষতের আশপশে লাগানোর তিরিশ সেকেন্ডের মধ্যে অবশ। সবাই মিলে খুব সুন্দরভাবে তার পা ড্রেসিং করলাম। নয়টা স্টিচ, তিনি খুব একটা টেরও পাননি। আসার সময় ওষুধ খাইয়ে যত্ম করে তাঁর বেডরুমে শুইয়ে তারপর সবাই বিদায় নিলাম। ইতিমধ্যে রাত একটার বেশী বেজে গেছে, সেহ্রী খেতে উঠতে হবে, তারপরও সবাই স্মোকরুমে আড্ডায় বসলাম। জেঠুর সম্পর্কে সবাই একটা বিষয়ে একমত হলাম আর তা হচ্ছে এতো কিছুর পরও জেঠু খুশী এই জন্যে, প্রতি রাতে সবার সাথে উনাকে তারাবীহ্র নামাজ পড়া লাগবে না, ছ’ঘন্টা পর পর ওষুধ খেতে হবে বলে রোজাও রাখতে হবেনা, রিমেট কন্ট্রোল হাতে নিয়ে তাতাং সারাদিন বসে বসে হিন্দী সিনেমা দেখবেন, কি মজা! চীফ ইঞ্জিনিয়ারের নাম এ.টি.এম.এম. রহমান, সংক্ষেপে তাহের রহমান। সেকেন্ড অফিসার নাজিম নাম দিয়েছে তাহের উদ্দিন ঠাকুর। আর যায় কোথায়, পোলাপান ডাকে ঠাকুর। কেউ বলে জেঠু, কেউ নানাভাই, কেউবা তাতাং (ইনফর্মাল, ফিলিপিনো ভাষায় তাতাং মানে শশুর)। এগুলো সব হাল্কা কথাবার্তা, একদল বান্দর একসাথ হলে যা হয় আরকি।
পরদিন দুপুরের দিকে পতেঙ্গা পনের নম্বর জেটি থেকে ভটভটিয়া (বোট) এলো, ক্যাপ্টেন আগে থেকেই অফিসে ফোন করে সব ব্যাবস্থা করে রেখেছেন। চীফ ক্লিনিকে যাবেন, পনের নম্বরে গাড়ী স্ট্যান্ডবাই থাকবে, সঙ্গী হবো আমি। বড় আনন্দ, আবার একটা রাত আপার বাসায় থাকা যাবে। জাহাজ থকে জেটিতে আসতে কমপক্ষে এক ঘন্টা লাগে, যদি উল্টোস্রোত থাকে তাহলে সময় দ্বিগুনেরও বেশী। পতেঙ্গার ভটভটিয়াগুলি আরেক মাদার ভেসেল। ঘাটে ভীড়বেন না, কারন ড্রাফ্ট বেশী, পাথরে তলা লেগে ফেটে যেতে পারে, কতো ঢং! মাদার-ভটভটিয়ার সাথে ভেড়ে লাইটার-ভটভটিয়া অর্থাৎ সাম্পান। চায়নার সইফেং, ডংফেং ইত্যাদি কোম্পানীর বদৌলতে পাওয়ার টিলার সাধারণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে চলে এসেছে। ডাই ডিঙ্গিসম সাম্পানগুলোতেও দাঁড়ের মৃদু ক্যাঁচ-ক্যাঁচ এর পরিবর্তে পাওয়ার টিলারের ভট-ভট শব্দ। একেবারে মন্দ নয়। আমাদের মাদার-ভটভটিয়ার ক্যাপ্টেন (মাঝি) ঘাট থেকে বেশ খানিকটা তফাতে যেখানে নিরাপদ পানি আছে সেখানে এংকর ড্রপ করলেন, তারপর চুপ করে কিছুক্ষন বসে থাকলেন, কর্ণফূলীতে তখন ফুল স্পীডে জোয়ারের পানি ঢুকছে, মাদার-ভটভটিয়া জোয়ারের টানে যতোই উল্টো যায়, ততোই গভীরে এংকর গাঁধতে থাকে। ভটভটিয়া ক্যাপ্টেন সন্তুষ্ট কারন শক্তিশালী স্রোত ছিলো বলে তাকে এ্যাসটার্ন কিক্ দিতে হয় নি। মাদার এবং লাইটার ভটভটিয়া সুস্থিরভাবে পরষ্পর এলংসাইড (Alongside) হবার পর মাঝি এবং তার ফার্স্ট-মেটের (প্রত্যেক ভটভটিয়ায় মাঝির একজন সাগরেদ থাকে) সহযোগিতায় চীফ ইঞ্জিনিয়ারকে লাইটার-ভটভটিয়ায় নামিয়ে মিনিটখানেক চলার পর সেটাতে করে ঘাটে নামলাম। বেচারা চীফ হাঁটতে পারছেন না অথচ এ অবস্থায় কতো রকম চড়াই উৎরাই পেরুতে হচ্ছে। এখানেই শেষ নয়, পনের নম্বর টিনশেড যে ঘাট সেথান থেকে প্রায় একশ মিটার দুরে রাস্তায় আমাদের গাড়ী অপেক্ষামান দেখা যাচ্ছে তবে যেতে হবে অনেকগুলো পাথরের উপর তিড়িং তিড়িং করে। বড় সোঁন্দর গাঁট্ (ঘাট)। বড়ই সোন্দইয্য, ইবার ঊঁচেদি ফার ওইলে ব্যাক্কেরে হাঁশ্ টিঁয়া করি দ’ন ফরে। (সুন্দর ঘাট, এ ঘাট পার হতে হলে সবাইকে পাঁচ টাকা করে দিতে হয়)। আহত চীফ ইঞ্জিনিয়ারকে নিয়ে কিভাবে যে রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছলাম, ভেবে আজও অবাক হই। এতদসত্বেও তিনি তাঁর ডান পায়ের উপর ভর করছিলেন বিধায় ব্লীডিং হয়ে একদিনের শুকনো ব্যান্ডেজ ভিজে জবজবা। খুলশীর হলি ক্রীসেন্ট হাসপাতালে যখন পৌঁছি তখন পুরোপুরি বিকেল।
পরিচ্ছন্ন, শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ। পার্কিংয়ে অনেকগুলো গাড়ী, কোথাও কোলাহল নেই। গাড়ী থেকে নামিয়ে ধীরে ধীরে চীফ ইঞ্জিনিয়ারকে ইমার্জেন্সীতে নিয়ে গেলাম। জনৈক ভদ্রলোক চীফকে বেড়ে শোয়ালেন, ডাক্তার এলেন মিনিট পনের বাদে। ইয়াংম্যান, বেশ লম্বা। একজন এসিস্ট্যান্ট এসে ব্যান্ডেজ খুলতে শুরু করেছে। ডাক্তার সাহেবকে দুর্ঘটনার কথা বিস্তারিত জানালাম এবং জাহাজে স্টিচিং করা হয়েছে সেটাও। ক্ষতের উপর যে কটনটা থাকে সেটা টেনে তোলার সময় চীফ ইঞ্জিনিয়ার আস্তে উফ্ করে উঠলেন। ব্যাপারটা যেন ডাক্তারের পছন্দ হলনা। ‘খুব সুখী মানুষ তাই না? সহ্য হয় না। মেরীন ইঞ্জিনিয়ার, বিরাট কারবার, ব্যাথাট্যাথা সহ্য হবে কেন?’ বলৈ সাদা একটা প্লাস্টিকের বোতল থেকে কিছু তরর সরাসরি সেলাই করা জখমের উপর ঢেলে দিলেন। দেখলাম উফ্ উফ্ করে বেডের উপর একটা শরীর ধড়ফড় করছে। আমি বাকশক্তিহীন, একি? একজন আহত মানুষকে এভাবে টর্চার করার মানে কি? প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিলো আমার। আমতা আমতা করে বললাম, পেশেন্টকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছেন কেন, সরাসরি স্পিরিট ঢেলে দিলেন?’ শীতল চোখে আমার দিকে তাকায় ডাক্তার, চিবিয়ে চিবিয়ে বলৈ, আপনারতো এখানে থাকার কথা নয়, যান ওঘরে গিয়ে বসুন।’
* * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * *
পাশের রুমে এসে বসলাম। চীফ ইঞ্জিনিয়ারের উহ্-আহ্ আর গোঙ্গানির আওয়াজ কানে আসছে, আমি শিউর ঐ ডাক্তার ইচ্ছে করে বেচারাকে কষ্ট দিচ্ছে। প্লাস্টিকের সাদা বোতলে যে তরলটা আছে তার নাম হেসিক্সল বা হেক্সিসল ঠিক পড়তে পারিনি, তবে এটুকু বলতে পারি ওটা কোনো জখমের আশপাশটা ক্লীন করার জন্যে এবং যিনি ড্রেসিং করবেন তিনি ড্রেসিংয়ের আগে ও পরে ওটা দিয়ে নিজের হাতটা ধুয়ে নেবেন জীবানুমুক্ত করার জন্য। এধরনের লিকুইড সরাসরি কাটা জখমের উপর ঢাললে পেশেন্ট প্রচন্ড যন্ত্রনায় গোঙ্গাবেনা? তার কাছে স্যাভলন ছিলো, সরাসরি স্যাভলন দিলে কি হত? ধীরে ধীরে রাগ উঠতে শুরু করেছে, মাথা গরম হচ্ছে। আমার পরনে জিন্স, ইন করা ফ্লানেল শার্ট, পায়ে রীবক ফুটওয়্যার শক্ত করে ফিতেয় বাঁধা। উঠে গিয়ে মারবো নাকি এক লাথি, শুয়োরের বাচ্চার গালে?
– ছিঃ ছিঃ এসব কি ভাবছি, মারামারি করবো? এটা প্রাইভেট হাসপাতাল, সিকিউরিটির লোক আছে, একজন ডাক্তারকে অপমান করলে আমাকে এমনি এমনি ছাড়বেনা। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে যার জন্য ফাইট করতে যাবো, সেই চীফ ইঞ্জিনিয়ারই এটাকে সাপোর্ট করবেন না। তিনি কেন, কোন ভদ্রলোকই মারামারি, ভায়োলেন্স পছন্দ করবেন না। এসব বেয়াদপীকে তুচ্ছ বিষয় বলে নিজের মান নিয়ে ফিরে আসবেন। কিন্তু মন শান্ত হচ্ছে না, বারবার চেখে ভাসছে যন্ত্রনায় একজন মানুষের ছটফট করার দৃশ্য, এবং যন্ত্রনা দিচ্ছে একজন ডাক্তার যার কাজ যন্ত্রনার উপশম করা। ভাবলাম, আমার কিছুই করার নেই মনে মনে রাগ করা ছাড়া। তবে কিছুতেই মনের ভাব চীফ ইঞ্জিনিয়ারকে জানাইনি, কাউকে নয়।
ড্রেসিং শেষে চীফ ইঞ্জিনিয়ারকে নিয়ে আসা হল এই ঘরে, যেখানে আমি অপেক্ষায় আছি। এটা তাদের ইমার্জেন্সী ওয়ার্ডের অফিসরুম, ডাক্তার প্রেস্ক্রিপশান দিলেন এবং একটা সদুপোদেশ দিলেন তা হচ্ছে এখান থেকে যাতে ওষুধ না কিনি, এরা দাম বেশী রাখে। মনে মনে বলি, “শালা, মেরীনররা তোর মত চার-আনা আট-আনার থোড়াই কেয়ার করে।” বিল দিয়ে চীফকে নিয়ে যখন ঐ হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলাম, ঘড়ির কাঁটা তখন বিকেল পাঁচটা ছুঁইছুঁই করছে। পাঁচটা বিশ মিনিটে ইফতারের সময়, আসরের নামাজ পড়া হয় নি। প্রত্যেক রোজার মাসে নামাজ মেইনটেইন করি কিন্তু ঈদের নামাজ শেষে সব খতম, কি অদ্ভুত ঈমানদার। ঢাকা ট্রাংক রোডে গাড়ী চলছে, ড্রাইভার শান্তিতে গাড়ী চালাতে পারছেনা। প্রচুর গাড়ী, ট্রাক, বাস, টেম্পো, বেবী-ট্যাক্সী, রিকশা সবাই পাঁচটা বিশের আগে ঘরে ফিরতে চায়। রাস্তার দুধারে অগণিত বাহারি টেবিল, ইফতারীর পশরা সাজানো, টেম্পরারী ইফতারি শপ। একটা দোকান দেখলামনা যেখানে কাস্টমার নেই। জ্যাম! সামনে অলংকারের মোড়ে বাসের হেল্পারের সাথে রিকশাওয়ালাদের চীৎকার চেঁচামেচি চলছে। পেছনে মসজিদের মাই ওয়াজ মাহ্ফীলের শব্দ। ডানে যাত্রীসেবা মিনিবাস, ফেনী লক্ষীপুর-লক্ষীপুর বলে চলেছে অনবরতঃ। বাঁয়ে ভ্যান, রিকশা এসব ছাড়িয়ে ফুটপাথে বা রাস্তার উপপ ইফতারীর পশরা দেখা যাচ্ছে। চীফ ইঞ্জিনিয়ারকে তার রিলেটিভের বাসায় নামিয়ে আমি যাবো আগ্রাবাদ, আপার বাসায়। এমন হলে পাঁচটা বিশ তো দুরে থাক সাতটা বিশেও বাসায় পৌঁছা সম্ভব নয়। আমার কোন টেনশন হচ্ছে না, কি এক অবসাদে ছেয়ে আছে মন। বারবার ভেসে আসছে মনের পর্দায়, “সুখী মানুষ, না?” বলে জখমের উপর কিছু একটা ঢেলে দেওয়া হল আর প্রচন্ড যন্ত্রনায় শিহরিত এক বৃদ্ধ। তাকালাম তাঁর দিকে, চুপচাপ, মুখটা ঈষৎ ব্যাথাতুর, চেয়ে আছেন বাইরের দিকে, স্বাভাবিক। আমার মনের অবস্থা তিনি জানেন না, জানার কথাও নয়।
ওই ডাক্তার জানেনা কিভাবে একজন মানুষ শিপের চীফ ইঞ্জিনিয়ার হয়, কিংবা ক্যাপ্টেন। সুখী মানুষ বলতে ডাক্তার কষ্টহীন মানুষ বুঝিয়েছে। জাহাজের ইঞ্জিনিয়ার সুখী মানুষ? একটু ব্যাথায় কাঁকিয়ে ওঠে? সেই জুনিয়র লাইফ থেকে তিল তিল করে অতি পরিশ্রম, কষ্ট, যন্ত্রনা আর কালক্ষেপনের পর ক্লাস-ওয়ান সার্টিফিকেট অর্জন করেন যার ফলে পাওয়া যায় কাংখিত চীফ ইঞ্জিনিয়ার পদবী। পুরো সী লাইফ কাটে পরিশ্রম করে, কষ্টে, আর বিপদের মধ্যে কারন চাকরীর ধরনই এমন। সব সময় যে শারীরিক পরিশ্রম করতে হয়েছে শুধু তাই নয়, স্যাক্রিফাইস করতে হয়েছে নিজের যৌবন, তারুণ্যা। আর পরিবার পরিজন, এমনকি মাটির সংস্পর্শবিহীনভাবে সাগর জলে ভেসেছে বছরের পর বছর।
সুখী মানুষ বলে একজন আহতকে তীব্র যন্ত্রনা দিয়ে ওই ডাক্তার কি আনন্দ পেয়েছে আমি জানিনা। জাহাজে সেউ সামান্য আহত হলে সবাই মিলে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে তার সশ্রুশা করি সে যেই হোক। সবার ভালোবাসা মেশানে সেবাই গভীর সমুদ্রেউ দ্রুত সুস্থ্য হয়ে ওঠে জাভেদের মত মারাত্মক আহত সী-মান আর সার্টিফিকেটধারী মুর্খ জেলাস ডাক্তারের কারনে হাসপাতালের মতো নিরাপদ যায়গায় তীব্র যন্ত্রনায় ব্যাথিত হয় চীফ ইঞ্জিনিয়ারের মতো আহত মানুষ।
আমি এখনও বুঝিনা ‘সুখী মানুষ’ বলে দগদগে ক্ষতের উপর স্পিরিট ঢেলে দেবার কারন কি? এতো রাগ কেন?
* * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * *