অপেক্ষা
সে অপেক্ষা করছে। বাচ্চাটা মারা যাবে, তারপর বাচ্চার মা এবং বাবাকে এ্যারেস্ট করবে।
হসপিটাল বেড থেকে খানিকটা দুরে একটা চেয়ারে বসে আছে পিসি নাইজেল টাম্বলিং-গগিন। লন্ডন মেট্রপলিটন পুলিশ সার্ভিসের একজন অফিসার। প্রতিদিনের মত আজও সে শিফট শুরু হবার ঠিক পনের মিনিট আগে ব্রীফিং রুমে হাজির হল। নাইজেল ইমার্জেন্সি রেসপন্স অফিসার। ওদের টিমে একজন ইন্সপেক্টর, ছয় সাত জন সার্জেন্ট সহ প্রায় ষাট জন অফিসার। ওকে যখন বলা হল হাসপাতালে যাবার জন্য ভেতর ভেতর পূলক বোধ করলো। ওকে যেতে হবে পেডিয়াট্রিক ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিটে। মানে কি? ছোট বাচ্চা আসামী, এটা কিভাবে সম্ভব? অতশত ভাবতে পারছেনা এখন। খুশীর খবর ওটা ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিট, রুগী বেশীরভাগ সময় ঘুমে থাকবে। ঘুমে থাকতে পারবে সে ও, গতরাতে ভালো ঘুম হয় নি। এটা ভাবতে ভাবতে ব্রীফিং রুমে বসে আরাম করে কফি খাচ্ছিলো নাইজেল। সবাই এসে গেছে, সামনে সিনেমা হলের মত বিশাল স্ক্রীন। একটু পর পোষ্টিং দিয়ে ব্রীফিং শুরু হবে। ব্রীফিং আরেক বোরিং জিনিষ, কেউ প্রিজন থেকে ছাড়া পেয়েছে তার তাকে নজরে রাখতে হবে, কোথায় কোথায় ড্রাগ হটস্পট, কোথায় কোথায় এন্টি সোশাল হটস্পট অথবা গ্যাং গুলো কে কাকে মারছে। কে পকেটে ছুরি নিয়ে হাঁটছে, কোন চিপায় অবৈধ অস্ত্র লুকিয়ে রাখা আছে, কোন গাড়ি দেখামাত্র থামাতে হবে। দুনিয়ার ইতং বিতং, মাঝে মাঝে ভাবে, “দুর! করছি কি আমি এখানে? সব বোরিং কাজ কারবার। অন্য চাকরী খুঁজতে হবে।” আবার ভাবে মাসে আঠারো দিন কাজ আর বারো দিন ছুটি, এমন জব আর কোথায় পাবে?
লন্ডন মেট্রপলিটন এলাকাকে বত্রিশটি বরো (Borough)-তে ভাগ করা হয়েছে। নাইজেলের জব তাদের একটিতে, লন্ডন বরো অফ টাওয়ার হ্যামলেটস্। গোটা লন্ডনে প্রায় তিন হাজার অফিসার শুধু রেসপন্স করার জন্য ২৪ ঘন্টা এ্যাকটিভ থাকে। প্রতিটি বরো-তে আরো আছে নেইবারহুড টাস্ক ফোর্স, সেইফ নেইবারহুড টিম, চাইল্ড এ্যাবিউজ এন্ড এক্সপ্লয়টেশন ইউনিট, গ্যাং ইউনিট, পাবলিক অর্ডার ইউনিট (দাঙ্গা-ফ্যাসাদ ডিফিউজ করার জন্য), সি.আই.ডি, এয়ার ইউনিট, ডগ ইউনিট, হর্স রাইডার্স, ফরেনসিকস, স্পেশালস (বিনা বেতনে শখের পুলিশ), আরো কত কি। বৃটিশ পুলিশ অস্ত্র বহন করেনা। তবে ফায়ার আর্মস ইউনিট আছে বিশেষ প্রয়োজনের জন্য। এই দুর্ধর্ষ ফায়ার আর্মস অফিসারেরা সব সময় বি এম ডাব্লিউ এক্স-ফাইভ নিয়ে চলাফেরা করে। ওরা ট্রোজান নামে পরিচিত। শুট করা সিরিয়াস বিষয়, প্রতিটি বুলেটের হিসেব দিতে হয়। ব্যাপারটা ভয়াবহ, অর্থাৎ শুট করলে নিশ্চিত হয়ে শুট করতে হবে যে বুলেটটার অপচয় হয় নি। বুলেটের অনেক দাম। কারো না কারো মাথা বা হৃৎপিন্ড ভেদ না করা মানে ট্যাক্স পেয়ারদের অর্থের অপচয়। সুতরাং একটি শুট মানে কারো না করো মৃত্যু। ফায়ার আর্মস টিমে কন্টিনিউয়াস শট (ব্রাশ ফায়ার)-এর প্রচলন নেই। মহামান্য রাণীর এই রাজ্য সরকারের নাম ‘হার ম্যাজেস্টিজ গভার্ণমেন্ট অফ ইউনাইটেড কিংডম এন্ড নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড।’ হার ম্যাজেস্টি ‘দ্য কুইন’-এর কড়া নির্দেশ তাঁর প্রজাদের শান্তি বিঘ্নিত করা যাবেনা। শব্দ দুষণ তার মধ্যে অন্যতম।
প্রথমে কল করে পোষ্টিং দেওয়া হয়। প্রতিটি ইউনিটে দুজন অফিসার। প্রতিটা পুলিশ কার একেকটা ইউনিট। এছাড়া আছে আট জনের মিনিবাস, বারো জনের ভ্যান ইত্যাদি। রেসপন্স অফিসাররা সবসময় পুলিশ কার নিয়ে চলাফেরা করে যাতে করে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে ইমিডিয়েট এ্যাকশন নেয়া যায়। যদি আরো অফিসার দরকার পড়ে, রেডিওতে সাপোর্ট চাইতেই মিনিটের মধ্যে কাকের মত কা কা করতে করতে সাইরেন বাজিয়ে পুলিশে সয়লাব হয়ে যায়। কলিগদের একের প্রতি অন্যের এই গভীর টান নাইজেলকে মাঝেমাঝে অপরাধী করে, “তারপরও কেন আমি চাকরী ছাড়তে চাই?”
বেশ কিছুদিন আগের কথা, নাইজেল তখন নতুন। ইষ্ট লন্ডনের মাইল এন্ড পার্কের (Mile End Park) দক্ষিন দিকে রেইলওয়ে আর্চের নীচে একটা নীল রংয়ের ফোর্ড গাড়ী থামালো নাইজেল আর পিসি ফ্লেচার। ড্রাইভার এশিয়ান ছেলে। (এখানে একটা কথা বলে রাখা প্রয়োজন, বৃটেনে এশিয়ান বলতে দক্ষিন এশিয়ান বোঝায়, যেমন বাংলাদেশী বা বেংগলিজ, ইন্ডিয়ান, পাকিস্তানি, শ্রী-লংকান ইত্যাদি। আর আমেরিকায় এশিয়ান মানেই চায়নীজ, জাপানীজ, কোরিয়ান ইত্যাদি।) গাড়ি থামিয়ে ওকে বের হতে বলা হল। বের হয়েই গাড়ী রেখে সে ভোঁ-দৌড়। নাইজেল আর ফ্লেচার বার্ডেট রোড হয়ে সেন্ট পলস্ ওয়ে পর্যন্ত পিছু ধাওয়া করে ওকে হারিয়ে ফেললো। সেন্ট পলস্ ওয়েতে একটা ভ্যানে এক দল স্পেশালস্ ছিলো। ওরাও খুঁজলো, পেলো না। ফেরার পথে নাইজেল টের পেলো ওর ফোন হারিয়ে ফেলেছে। ফ্লেচার বললো সে দেখেছে নাইজেলের পকেট থেকে মোবাইল ফোন পড়েছে বার্ডেট রোডের মাঝখানে, ডিভাইডারের উপর।
“তোমার উচিত ছিলো আসামীর পেছনে না ছুটে যত দ্রুত সম্ভব ফোন তুলে নেওয়া। ওটা তোমার প্রপার্টি, আসামী আজ পালাবে কাল ধরা পড়বে। পালিয়ে আর কোথায় যাবে?”
এটা ঠিক, পালিয়ে বেশীদুর যেতে পারবেনা। আজ নাহয় কাল, নয়তো পরশু ধরা তাকে পড়তেই হবে। এখন কথা হচ্ছে পুলিশ আদৌ তাকে ধরতে চায় কি না সেটা নির্ভর করবে তার ক্রাইম কতখানি সিরিয়াস। পৃথিবীর আর কোন সিটিতে এত ক্যামেরা নেই যত ক্যামেরা আছে সিটি অফ লন্ডনে। ইলেক্ট্রনিক চোখ সবখানে, সর্বদা।
আসল কথা হচ্ছে নাইজেল টেরই পায় নি কখন সে ফোন হারিয়েছে। ফ্লেচার ঠিকই দেখেছে, সব সময় চোখ কান খোলা, অভিজ্ঞতা একেই বলে। ফিরে এসে তন্ন তন্ন করেও ফোনের হদিস পেলোনা তখন ফ্লেচারের ফোনে ‘ফাইন্ড মাই আইফোন’ এ্যাপে লগ-ইন করে দেখে ওর আইফোন ইতস্ততঃ নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে মাইল এন্ড পার্কের দক্ষিন-পূর্ব কোন বরাবর। এর মধ্যে দেখা গেলো মুহুর্তের মধ্যে একটি দুটি করে ইউনিট এসে গোটা মাইল এন্ড পার্ক ঘিরে ফেলেছে। ইতিমধ্যে ‘স্টপ এন্ড সার্চ’ অপারেশন শুরু হয়ে গেছে। আকাশে মোটামুটি উঁচুতে এয়ার-ওয়ান হেলিকাপ্টার ইউনিট। পুরো মাইল এন্ড পার্ক জুড়ে সাদাকালো ইউনিফর্ম ছাড়া যেন আর কিছু দেখা যাচ্ছেনা। রাস্তাগুলোর এখানো ওখানে পুলিশ কারগুলো থেকে ফ্লাশিং লাইটগুলোর তীক্ষ্ম আলো দিনের আলোর উজ্জ্বল্য ছাপিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। নাইজেল যখন লেইজার সেন্টার কার পার্কে একজনকে সার্চ করছে ফ্লেচার তাকে রেডিওতে ডাকলো। পার্কের দক্ষিনে রেসিং কার্ট পেরিয়ে একটা স্কেটবোর্ড পার্ক আছে ওটা পার হলেই ফ্লেচারকে দেখতে পাবে। লোকেশন পর্যন্ত দৌঁড়ে যেতে যেতে প্রায় চার পাঁচ মিনিট লেগে গেলো। ওখানে গিয়ে দেখে সেইন্ট পলস্ ওয়ে থেকে রোডশওয়েল রোড পর্যন্ত পুলিশ গাড়ির লাইন, একটা প্রিজনভ্যানও উপস্থিত। তারমানে কেউ না কেউ এ্যারেষ্টও হয়ে গেছে। নাইজেল টেরও পায় নি! রেডিও ম্যাসেজের প্রতি আরো মনোযগী হতে হবে।
স্কেটবোর্ড পার্ক পার হতেই দেখলো এশিয়ান একজন পুরুষের ব্যাক স্ট্যাক হ্যান্ডকাফ লাগানো। ফ্লেচার এগিয়ে ফোনটা নাইজেলের হাতে তুলে দিলো। আইফোন সিক্স প্লাস। লক স্ক্রীনে একটা অপরূপা কিশোরীর সাদাকালো ছবি, ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। নাইজেলের বুকে কেমন যেন অনুভূতি হল, অনেক ভালোলাগার। ছবিটা ওর মায়ের। ক্লডিয়া ছুটে একে নাইজেলের ডান বহুর উপর হাত রেখে স্বস্নেহে জানতে চাইলো ও ঠিক আছে কিনা। “ইয়েস আ’ম ফাইন ক্লড!” নাইজেল ভাবতে পারছেনা কাঠখোট্টা কলিগ ক্লডিয়া যে কিনা নাইজেলের দিকে কোনদিন ফিরেও চায় নি আজ সে সবার আগে ছুটে এসেছে। একটু পর পর নারী, পুরুষ সব অফিসাররেরা এসে এসে নাইজেলের খোঁজ নিচ্ছে ও ঠিক আছে কি না। সবার এত আন্তরিকতা দেখে নাইজেল আবেগ লুকাতে পারেনা। আরে বাবা ওর ফোন হারিয়েছে, অন্য কিছু না।
একশ নব্বই বছর ধরে লন্ডন মেট্রপলিটন পুলিশের এই ভাতৃত্বের সংস্কৃতি এখনও অটুট রয়েছে।
ইদানীং লন্ডন মেট পুলিশ রেসপন্স কারগুলোর আশি ভাগই ইলেক্ট্রিক। শতভাগ ইলেক্ট্রিক মানে শতভাগ পরিবেশ বান্ধব, হাইব্রীড জাতীয় দুনম্বরী নেই। বি এম ডাব্লিউ আই-থ্রী। কোন শব্দ করেনা, ভুতের মত। এক্সেলেটরে জোরে চাপ দিলেই বুলেট স্পীড উঠে যায়। মাত্র তিন সেকেন্ডে ৬০ মাইল বা ৯৬ কিলোমিটার স্পীড। গতির এই হঠাৎ পরিবর্তন খুব এনজয় করে নাইজেল। আজ সে ইলেক্ট্রিক কার নেয় নি, নিয়েছে একটা ম্যানূয়াল ভক্সহল এশট্রা ডিজেল কার। কারন সারাদিন ওটা পড়ে থাকবে হাসপাতালের সামনে। ওর পোষ্টিং পড়েছে স্যাল এর সাথে। অনেক অভিজ্ঞ, গত আট বছর ধরে মেট পুলিশের সাথে আছে। বেংগলি অফিসার, ওর বাবা কিংবা দাদা সিক্সটিজ-এ ইন্ডিয়া থেকে লন্ডনে এসেছিলো। এখন ওটা বাংলাদেশ হয়ে গেছে। অত্যন্ত সুভদ্র স্যাল এর ফুল নেইম সালাম মিয়া। নাইজেল স্যালের সাথে কাজ করে আরামও পায়, খুব সাপোর্টিভ আর তারুণ্যে ভরপুর এশিয়ান অফিসার।
হোয়াইটচ্যাপেল রোডের দক্ষিনে প্রায় রাস্তার গা ঘেঁষে বিশাল এলাকা জুড়ে সুউচ্চ আর অত্যাধুনিক রয়েল লন্ডন হসপিটাল দেখলে বিশ্বাস হতে চায় না এই এলাকায় এত বিশাল, দৃষ্টিনন্দন হাসপাতাল থাকতে পারে। ঐতিহ্যবাহী এই হাসপাতালের বয়স বর্তমানে প্রায় ২৮০ বছর। ১৭৪০ সালে ছোট পরিসরে গঠিত এই আরোগ্যাশালার নাম ছিলো লন্ডন ইনফার্মারী, আট বছর পর নাম দেওয়া হয় লন্ডন হসপিটাল। ২৪৩ বছর পর ১৯৯০ সালে এর নাম রাখা হয় দ্য রয়েল লন্ডন হসপিটাল।
মেইন বিল্ডিংয়ের পূর্বদিকে মিলওয়ার্ড স্ট্রীটে যেখানে এ্যাম্বুলেন্সগুলো পার্ক করা থাকে সেখানে ডানদিকে সুবিধামত এক জায়গায় গাড়ী পার্ক করে নাইজেল আর স্যাল ছয়তলার সি সেকশনের পিডিয়াট্রিক ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিট (PCCU) এ পৌঁছলো ততক্ষনে প্রায় সকাল পৌনে আটটা বেজে গেছে। যে দুজন অফিসার ডিউটিতে ছিলো তারা ভোর চারটা থেকে এখানে। হ্যান্ডওভার নিতে গিয়ে যা শুনলো হতভম্বব নাইজেল বিমূঢ় হয়ে স্যাল এর দিকে তাকিয়ে আছে। অভিজ্ঞ স্যাল ইশারায় তাকে আশ্বস্ত করলো।
ভোর সাড়ে তিনটার দিকে রিসাস (Resuscitation ওয়ার্ড যেখানে মৃত্যুপথযাত্রি রোগীদের বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করা হয়) -এর ডাক্তার পুলিশে রিপোর্ট করে। একটা ছোট বাচ্চাকে রিসাসিটেশন ওয়ার্ডে আনা হয়েছে যার ইনজুরি সন্দেহ জনক। একটি শিশুর পিতা ইমার্জেন্সীতে ফোন করে জানায় শিশুটির বাঁ কান দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। শিশুটির বয়স তেরো সপ্তাহ। মেয়ে। পিতা মাতা এশিয়ান বাংলাদেশী। শিশুটিকে দ্রুত হাসপাতালে আনার পর দেখা গেলো মা এক বর্ণও ইংরেজী বলতে পারেনা। বাবা বলছে সে কিছু জানেনা, সভবতঃ বিছানা থেকে পড়ে গেছে।
সেখান থেকেই সন্দেহের শুরু। মাত্র তের সপ্তাহ বয়সি এই শিশুটির মাথার নরম খুলি ভেঙ্গে ব্রেনে পর্যন্ত পৌঁছেছে। ঘাড়ের তিনটি ভার্টিব্রা ভেঙ্গে গেছে, ডান বুকে চারটি পাঁজরের হাঁড় ভেঙ্গে তিনটি হাঁড় ফুসফুস ভেদ করে ঢুেক পড়েছে। একটা শিশু শ্রেফ বিছানা থেকে পড়ে গেলে এত ভয়াবহ ইনজুরি হতে পারে না। রিসাস ওয়ার্ড থেকে প্রয়োজনীয় প্রাথমিক এ্যাসেসমেন্ট শেষে শিশুটিকে পিডিয়াট্রিক ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিটে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু বাচ্চাটির বাঁচার কোন সম্ভাবনা নেই। যে কোন সময় মারা যাবে, তখন এই মৃত্যু আর স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে গণ্য হবেনা। এটা ক্লীয়ার মার্ডার। সেজন্য পুলিশ গার্ডের ব্যাবস্থা। সবার আগে সন্দেহ আসবে পিতা-মাতার উপর। সব শুনে নাইজেলের অস্থির লাগছে, দুনিয়াটা এত কঠোর কেন? নাহ্ আর এই চাকরী করা যাবেনা। এত চাপ সে নিতে পারবেনা।
নাইট ডিউটি অফিসারেরা সব বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় নেবার কিছুক্ষন পর নাইট ডিউটি ডক্টর ইন-চার্জ এলো। মধ্য বয়সী এশিয়ান মহিলা। সারারাত ডিউটি করে ক্লান্ত, এখন তারও যাবার পালা। আরেকবার কনফার্ম করলো বাচ্চার বাঁচার সম্ভাবনা নেই। তার মৃত্যু এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। তাই বলে চেষ্টায় কোন ক্রুটি রাখা যাবেনা। নাইজেল বাচ্চার নাম নোটবুকে টুকে রাখলো। এফিয়া বিইগাম (Afia Begum)। স্যাল নাইজেলকে শুধরে দিলো। বললো, এরা বেঙ্গলী ফাদার এন্ড মাদার। বেবীর নাম আফিয়া বেগম, এফিয়া বিইগাম না। নাইজেলকে যথাসম্ভব বেঙ্গলী উচ্চারণ করার চেষ্টা করতে বলে ফোন নিয়ে ওয়ার্ডের বাইরে চলে গেলো স্যাল। হাসপাতালে যত কম রেডিও ব্যাবহার করা যায় সে চেষ্টা করে পুলিশ। ওয়ার্ডের ভেতর দুনিয়ার সব ইকুইপমেন্ট, রেডিওর রেডিয়েশানের কারনে কখন কোন বিপদ হয় কে জানে? তাছাড়া স্টাফ এবং পেশেন্টদের প্রতি সৌজন্যবোধ বলেও একটা কথা আছে। ওয়ার্ডের ভেতর আবার মোবাইল সিগনাল পাওয়া যায়না, তাই স্যালকে বাইরে যেতে হল। প্রতি মুহুর্তের আপডেট কন্ট্রোলকে আর ডিউটি ইন্সপেক্টরকে পাঠাতে হচ্ছে।
একটু পর স্যাল ওয়ার্ডে ফিরে এলো। নাইজেলকে জিজ্ঞেস করলো, “এ পর্যন্ত ক’টা এ্যারেস্ট করেছো?”
নাইজেল বললো, “সাত, আট কিংবা বিশ?” ফিক করে হেসে ফেললো স্যাল তারপর দ্রুত সিরিয়াস হয়ে বললো,
“লিসেন মেইট, দিস বেইবী ইজ ক্লিনিকালি ডেড। বাচ্চার ইনজ্যুরি দেখে আর তার বাবা মায়ের ভারবাল স্টেটমেন্ট থেকে ডাক্তাররা যা পেয়েছে এগুলো খুবই সন্দেহজনক। যে কোন সময়ে বাচ্চাকে অফিসিয়ালি ডেড ঘোষণা করা হবে। তুমি ইন চার্জ। ডাক্টর ইন-চার্জের নাম সবার আগে নেবে। সাবজেক্ট এর ডিটেইল, তার মা বাবার ডিটেইল ইতিমধ্যে নোট করে নিয়েছ তাই না?”
নাইজেরল হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। শিশুটির এখন সাবজেক্ট। স্যাল এবার আসল কথা বললো,
“যখনই ডাক্তার আফিয়াকে ডেড ঘোষণা করবে সাথে সাথে তুমি মা এবং বাবা দুজনকে এ্যারেস্ট করবে। যেহেতু তুমি ইন-চার্জ হ্যান্ডকাফ পরাবে কি পরাবেনা সেটা একান্তই তোমার সিদ্ধান্ত তবে আমি হলে ড্যাডকে কাফ পরাতাম কারন সে সাইজে ডাবল। বিস্ক এ্যাসেসমেন্টের বিষয়টা মনে রাখবে, অফিসার্স সেইফটি ইজ প্যারামাউন্ট। চিন্তা কোরোনা, আমি সারাক্ষন তোমার পাশে আছি।” নাইজেলের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখে স্যাল তাকে আশ্বস্ত করলো। স্যাল লেভেল-টু অফিসার। টেজার ট্রেইন্ড। হোলস্টারে ইলেক্ট্রিক টেজার-গান আছে ওটা দিয়ে পঞ্চাশ হাজার ভোল্ট শক দেওয়া যায়। যত ভয়ংকর আসামী হোক মূহুর্তে কাবু।
নাইজেল বললো, “একসাথে দুজন কখনো আগে এ্যারেষ্ট করিনি, আমি কি এ্যারেষ্ট রিজন এবং ক’শন দুবার আলাদাভাবে দেবো?”
স্যাল আবার বললো, “না না তার প্রয়োজন নেই, বাচ্চাকে মৃত ঘোষণার সাথে সাথে বাবা, মা দুজনই প্রচন্ড রিএ্যাক্ট করবে, আমার ধারনা অনেক শব্দ করে কান্নাকাটি করবে। এটা আমার এক্সপেরিয়েন্স থেকে বলছি কারন ওরা বেঙ্গলী, আমিও বেঙ্গলী। তুমি দৃঢ়ভাবে ওদের থামাবে, তরপর বলবে – ‘আমি তোমাদের দুজনকে আফিয়া হত্যার অপরাধে এ্যারেষ্ট করছি।’ তারপর এ্যারেষ্ট কেন জরুরী সেটা বলবে, কমপক্ষে দুটো করান তো আছেই ‘পুলিশি তদন্ত এবং ইন্টারভিউ, আর ‘অন্যের জীবন নাশ করা থেকে তাদের বিরত রাখা’ – তারপর ক’শন দেবে। একবারেই হবে। ডাক্তারের ঘোষণা থেকে শুরু করে এ্যারেষ্ট করে থেকে শুরু করে প্রিজন ভ্যানে তোলা পর্যন্ত অবশ্যই বডি ক্যামেরা অন রাখবে। এনি কোশ্চেন?”
“আমি ক’শন ভুলে গেছি।” নাইজেল বললো। ওর হার্টবিট বেড়ে গেছে।
“দুর পাগল! কপাল মোছো।” স্বস্নেহ হাঁসি দিয়ে একটা টিস্যু এগিয়ে দিলো স্যাল।
নাইজেল ওয়ার্ডের এক কোনে, যেখানে নার্সদের কম্পিউটার গুলো আছে সেখান থেকে একটা চেয়ার নিয়ে আফিয়ার বেড থেকে খানিকটা তফাতে বসে অবজার্ভ করতে লাগলো। রয়েল লন্ডন হসপিটালের ছয় তলায় ‘সি’ ওয়ার্ড মোটামুটি বড়, চারটা বেড। দুটো বেড খালি কারন পেশেন্ট দুজন। এক দিকে আফিয়া, উল্টোদিকের বেডে ছয়/সাত বছরের একটা ছেলে। ছেলেটা ঘুমাচ্ছে, বেডে মা বসে আছে। দেখতে মেডিটেরানিয়ান বলে মনে হল। আফিয়ার বাবা এবং মা সর্বক্ষন আছে ওয়ার্ডে। এ মূহুর্তে বাবা নেই, হয়তো টয়লেটে বা বাইরে পরিবারের অন্যদের সাথে কথা বলতে গেছে। পিডিয়াট্রিক ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিটে বাচ্চার মা-বাবা ছাড়া অন্য কারো প্রবেশ নিষেধ। বেডের পাশে হাঁটু ভেঙ্গে বসে একটানা কেঁদে যাচ্ছে তার মা। চিকন সুরে চিঁহিঁ কন্ঠে কাঁদছে। একটু খেয়াল করে বুঝতে পারলো কোরআন রিসাইট করছে। লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস-এ চাকরী না করলে কোরআন রিসাইট কি সেটাই জানতে পারতোনা নাইজেল। মনে হচ্ছে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে আফিয়া। বাচ্চাটার দুহাতের বাহুতে কয়টা সুঁই ঢুকিয়েছে কে জানে? মুখ দিয়ে চলছে ভেন্টিলেশন। নাইজেল ভাবছে ফুসফুসের যে অবস্থা ভেন্টিলেশনে কাজ হবে? মণিটরের স্ক্রীনে হার্ট রেট ‘নাম্বার’ না দেখিয়ে ব্লীপিং লাভ আইকন দেখাচ্ছে, তার মানে হার্ট সচল তবে খুবই দুর্বল। ব্লাড প্রেসার লাইন প্রায় সরল রেখার মত, হাল্কা ইতিউতি উঠানামা করছে। জীবন প্রদ্বীপ নিভু নিভু, নাইজেল ভাবে। অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৬৫ আর ৭৫ এর মধ্যে উঠানামা করছে যা কিনা খুবই রিস্কি, ৭৫ এর বেশী হতেই হবে। নাইজেলের আবার অস্থির লাগছে। ৭৫ থেকে বাড়েনা কেন? রেসপিরেশন লেভেল ১৯, নাইজেল জানেনা এটা সেইফ কি আনসেইফ। টেম্পারেচার ৩৬.৪ বা ৩৬.৫, নরমাল।
চেয়রে বসে নাইজেল অপেক্ষা করছে। বাচ্চাটা মারা যাবে, তারপর বাচ্চার মা এবং বাবাকে এ্যারেষ্ট করবে।
ঠান্ডা মাথায় মনে মনে এ্যারেষ্ট রিজন আরেকবার ঝালিয়ে নিচ্ছে…
কেন এরেষ্ট করবে (Reason for this arrest), এ্যারেষ্টের প্রয়োজনীয়তা (Necessity) তারপর ক’শন। উফ্ ক’শন কেন মনে আসছেনা? মোবাইল বের পকেট সার্জেন্ট ওপেন করলো। এই এ্যাপটা খুব কাজের। Caution এর প্রথম দুই অক্ষর সার্চ ফিল্ডে বসাতেই চলে এলো,
“You do not have to say anything. But, it may harm your defence if you do not mention when questioned something which you later rely on in court. Anything you do say may be given in evidence.”
জমে থাকা ভারটা বুক থেকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস দিয়ে বের করে নিলো নাইজেল। কত লক্ষবার এটা বলেছে ট্রেনিংএ থাকতে আর আজ হঠাৎ ব্রেন ব্লক করলো। ক’শন দিয়ে টাইম নোট করতে হবে পকেট নোটবুকে। তারপর আসামী যা বলবে সেগুলো দ্রুত নোট করে ওদের থেকে সিগনেচার নিতে হবে। না দিলেও সমস্যা নেই, ক্যামেরাতো চলছেই। এ্যারেস্ট করার পর আসামী যা বলে তাকে বলে সিগনেফিক্যান্ট স্টেটমেন্ট। কোর্টের জন্য ওগুলো খুবই জরুরী।
নাইজেলের পুরো মনযোগ ওই বেডের দিকে। সে এই কেইসের অফিসার ইন-চার্জ, সংক্ষেপে ও.আই.সি। আফিয়ার হাতের কাছে একটুখানি খালি জায়গা পাওয়া গেছে যেখানে মা আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করতে পারছে। সারা শরীরে ব্যান্ডেজ, অনেকগুলো স্যালাইনের পাইপ, ইলেক্ট্রিক ক্যাবল। মা তার সন্তানকে ছোঁয়ার এই সামান্য সুযোগ পেয়ে অঝোরে কাঁদছে আর গুনগুন করে কত কি বলছে। একটু পর পর নিশ্বাস নিতে গিয়ে বিষম খাচ্ছে যেন। নাইজেল ভাবতে পারছেনা, আফিয়ার এই ভয়াবহ ইনজ্যূরি কিভাবে হল? কে জানি ওয়ার্ডে ঢুকলো, দরজা খোলার সাথে সাথে ভারী অথচ নীচু মোটা গলায় ছেলেবেলার অতিপরিচিত একটা গান গাইতে গাইতে একজন ভেতরে ঢুকছে। গুনগুন করে হলেও নাইজেল স্পষ্ট বুঝতে পরছে,
“Incy wincy spider
Climbed up the spout
Down came the rain
And washed the spider out
Out came the sunshine
And dried up all the rain
So incy wincy spider
Climbed the spout again.”
ওয়ার্ডের হেভী ডাবল ডোর ঠেলে ভেতরে ঢুকতে বেগ পেতে হচ্ছে, হাতে দুটো এ্যালুমিনিয়ামের স্যুটকেস আর কাঁধে কেবল আর পাইপ (cables & pipes) ঝুলছে, কিন্তু গান থামছেনা। নাইজেল সাহায্য করার জন্য উঠতে যাবে তখন সে পুরোপুরি ওয়ার্ডে ঢুকে পড়েছে।
“আমার জন্য তোমাকে উঠে দাঁড়াতে হবেনা অফিসার। যদিও জানি আমি কিং অফ দ্য ওয়ার্ল্ড তবু তোমাকে ক্ষমা করলাম।”
আই ডি দেখে বুঝলো তিনি একজন ফুসফুস বিশেষজ্ঞ, পালমোনলজিস্ট। ভদ্রলোককে দেখেই নাইজেলের পছন্দ হয়ে গেলো, চেনা চেনাও লাগছে। বয়স ষাটের কম হবেনা, জিনিষপত্র আফিয়ার বেডের কাছে রেখে নাইজেলের সামনে আসলে নাইজেলও উঠে দাঁড়ালো। হঠাৎ নাইজেল তাকে চিনতে পারলো, আরে? এতো ম্যাড হ্যাটার! অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারলেন্ডের সেই পাগলা চা-খোরের মত দেখতে এই ডাক্তার। নাইজেলকে বললো,
“আমি ডক্টর ফ্যারাডে।” তারপর হঠাৎ নাইজেলের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো, “আসলে আমি ডাক্তার না, প্লাম্বার। পানির লাইন রিপেয়ার করি।” বলে এমভাবে চোখ টিপলো যেন ষড়যন্ত্র করছে। ভদ্রলোকের দুষ্টুমি বুঝতে পেরে সে ও একটু হাসলো।
“ওয়ার্ডে রোগী ছাড়া আর কেউ থাকলে আমার শরম লাগে।” ডক্টর ফ্যারাডের কথা শোনা মাত্র নাইজেল আফিয়ার মা আর পাশের বেডের ছেলেটির মা কে ওয়ার্ড থেকে বের করে দিলো।
প্রায় আধাঘন্টা একটানা কাজ করার পর ডক্টর ফ্যারাডে বললো, “আহ্! সেচ প্রকল্প সফল হয়েছে।” এই আধাঘন্টা ধরে যা ঘটলো নাইজেলের মনে হল সে ভিন্ন এক জগতে আছে। আফিয়ার ফুসফুস নাকি রক্তে ডুবে গিয়েছিলো। বুক কেটে পাইপ ঢোকানো হল। একুরিয়ামে যেমন পাম্প থাকে ওই ধরনের একটা ছোট পাম্প দিয়ে রক্ত বের করে প্যাকেটে পুরেছে। আবার আরেক পাম্প দিয়ে লিকুইড ঢুকিয়ে আবার বের করেছে। এভাবে পুরো ফুসফুস ক্লীন করে ফেলেছে। অন্যদিকে ব্লাড সাপ্লাই কন্টিনিউ করেছে। কাজ শেষে কাটা বুক আবার জোড়া লাগিয়ে নিখুঁতভাবে ড্রেসিং করে দিয়েছে। ড: ফ্যারাডে কাজ শেষে আবার ব্লাড স্যালাইন জুড়ে দিয়ে সব গুছিয়ে নিয়ে বিদায় নিলো। বিদায় নেবার সময় বললো ফুসফুস রিপেয়ার করে দিয়েছে, সময়মতো হীল (heal) হবে। যাবার সময় আবার সেই গানটি…
“Incy wincy spider
Climbed up the spout
Down came the rain
And washed the spider out . . .”
ডক্টর ফ্যারাডের পেছন পেছন তার গানও চলে গেলো।
মণিটরের দিকে তাকিয়ে অবাক নাইজেল। রেসপিরেটরি এখন ৪০/৫০ উঠানামা করছে যেটা ১৬ তে স্থির ছিলো। তারমানে ফুসফুস এরমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছে? হার্ট রেটেও লাভ চিহ্নের বদলে নাম্বার দেখা যাচ্ছে। মৃত্যু নিশ্চি জেনেও হসপিটালের ডাক্তার, স্পেশালিস্টার যা করছে নাইজেলের কাছে মনে হচ্ছে ম্যাজিক। অবস্থার উন্নতি হচ্ছে।
একটু পর আফিয়র বাবা আর মা একসাথে ফিলে এলো। মা এসে আফিয়াকে ডাকছে, আফিয়া গভীর ঘুমিয়ে। একবিন্দু নাড়াচাড়া করছেনা। কিন্তু হার্টরেট আর লাং ফাংশান ফিরে এসেছে। মা কি সেটা বুঝতে পারছে? কিংবা ওর বাবা?
এতকিছুর পরও ডিউটি ডাক্তার বলে দিয়েছে। আফিয়ার বাঁচার কোন সম্ভাবনা নেই। যদি কোনমতে বেঁচেও যায় (যার কোনও সম্ভাবনা নেই) তাহলে জীবমৃত হয়ে বেঁচে থাকবে। তার ব্রেন ইনজ্যূরি রিপেয়ারের উর্ধে।
নাইজেল আবার গিয়ে চেয়ারে বসেছে। আফিয়ার মা এবং বাবাকে অবজার্ভ করছে।
অপেক্ষায় আছে, বাচ্চাটি মারা যাবে। তারপর বাচ্চার মা এবং বাবাকে এ্যারেষ্ট করবে।
দ্রষ্টব্যঃ পুরো ঘটনা কাল্পনিক। কমেন্ট করার আগে বিষয়টি খেয়াল রাখলে বাধিত হবো।