রেটিনা
সকাল প্রায় সাড়ে দশটা। শুক্রবার।
বাবলু আর তার বন্ধুরা সবাই মিলে মহিপাল যাচ্ছে। গিন্নিকে প্রেমের প্রস্তাব দেবে। মহিপাল চৌধুরী বাড়ী। ওখানে গিন্নীদের বাসা।
গিন্নীকে প্রথম দেখেছে গত পরশু। মে দিবসের বন্ধের দিন ডলি আপাদের বাসায় বেড়াতে এসেছে। পাশের বাসার ডলি আপার চাচাত বোন গিন্নী। বেঁটে খাটো ছোট্ট মেয়েটা হাল্কা গোলাপী রংয়ের ঘাগরার মত একটা ড্রেস পরে সারাদিন বাবলুদের সাথে খেলেছে। ওদের পাড়ায় সমবয়সী আরো অনেকে আছে। রকিব, কাওসার, বিউটি, শায়লা, সাবা, নজরুল, মেরী, হ্যাপী, দিয়া, আরিফ, আতিক, সোহেল, জুয়েল, রাসেল, মুন্না, পারভেজ, সুমী, সীমাসহ আরো অনেকে। পাশাপাশি অনেকগুলো বাসার সামনে একটা দোতলা বড় বাড়ী তার মাঝখানে বেশ খানিকটা খোলা জায়গা যেখানে বড় আর মাঝারী অনেক গাছ গাছালিও আছে। ওটা ওদের খেলার ভূবন। স্কুল ছুটির পর বা বন্ধের দিনে ওরা সবাই মিলে হৈ চৈ করে আর খেলে ধুলে সময় কাটিয়ে দেয়। ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, হকি, ডাংগুলি থেকে শুরু করে কুমীর কুমীর, কুত কুত, বৌ-চি, গোল্লাছুট, রেডি কোর্ট সব। কোনটা ছেলেদের খেলা আর কোনটা মেয়েদের এসব নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না, সবাই সব খেলাতেই আছে।
সেদিনও সবাই মিলে বৌ চি খেলছিলো। গিন্নী ছিলো বুড়ি। পিচ্চি গিন্নী সুযোগ মত এমন ভোঁ দৌড় দিলো যে বাবলু কোনভাবেই তাকে ধরতে পারলোনা। পাড়ার সবচেয়ে দ্রুতগামী হিসেবে বাবলুর খেতাব হল চিতাবাঘ, সংক্ষেপে চিতাইয়া। সবারই কোন না কোন খেতাব আছে যেটা পরে বন্ধু ডাকনাম হয়ে যায়। যেমন যে একটু নাদুস নুদুস আর ফর্সা সে কদু, যে দ্রুত গাছে উঠতে পারে সে বান্দইররা, যেই মেয়ে লম্বা এবং চিকনা সে শাকচুন্নী, যার মুখ উপরে নীচে লম্বা সে ঘোড়ামুখী, যার মুখ ডানে বাঁয়ে চওয়া সে চাকমা আর যার চুল সব সময় খাড়া হয়ে থাকে সে হাগাধরা। শাস্ত্রে আছে হাগা ধরলে ছেলেদের চুল খাড়া হয়ে যায়। নজরুলের চুল মাথার তুলির একটু পেছনে সব সময় খাড়া থাকে বিধায় সবার দৃঢ় বিশ্বাস চব্বিশ ঘন্টা নজরুলের হাগা ধরে থাকে। বিষয়টা নজরুলের গা সওয়া হয়ে গেছে।
রইক্কা (রকিব) এসে বাবলুকে আচ্ছামত কথা শোনালো, দেড় ব্যাটারী একটা মাইয়া সেই মহিপাল থেকে এসে ওদের হারিয়ে দেয়! পাড়ার মান-ইজ্জ্বত আর থাকলোনা। বাবলুও অবাক, ফোর-ফাইভে পড়া একরত্তি মেয়ে দৌড়ে চিতাকে হারিয়ে দিলো! বাচ্চা মেয়েটাকে বোঝাতে হবে আসলে বাবলু ওকে ছোট হিসাবে মায়া করে জিতিয়ে দিয়েছে। কাছে গিয়ে বড় বড় একটা ভাব নিয়ে বললো,
“দেখলা তোমারে কি সুন্দর জিতাই দিলাম?”
“এহ্, তুমি জিতাইলা আমারে? পারেনা, হাইরা গিয়া এখন আসি উল্টা বলতেছে।” বাবলু অপমানে রীতিমত রাগান্বিত। কত বড় বেয়াদপ। একরত্বি মেয়ে, ভাইয়া না কিছু না সরাসরি তুমি? কোমরে হাত দিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ালো। বাবলু নীচের দিকে চেয়ে আছে পিচ্চি মেয়েটার দিকে মেয়েটাও কোমরে হাত দিয়ে মুখ উঁচু করে বাবলুর মুখের দিকে চেয়ে আছে। নাকফুলের উপর সূর্যেরর আলো ঝিলিক মারছে। সামান্য ভয়ডর তো নেই-ই, যেন মারামারি করবে। বাবলু বললো,
“এ্যাই মেয়ে নাম কি তোমার?”
“আগে তোমার নাম বল।” সমান তেজে মেয়ের জবাব। রাগে মাথা খারাপ হয়ে গেল বাবলুর,
“কি? এ্যাই মেয়ে, বড়দের সাথে এ্যামনে ব্যাবহার করে? কোন ক্লাসে পড় তুমি?”
“তুমি কোন ক্লাসে পড়?”
ডলি আপা যদি বাবলুকে অনেক মায়া না করতো তাহলে বেয়াদপ মেয়েটাকে একট চড় মেরে বেয়াদপির শিক্ষা দিয়ে দিতো, যাই হোক বুকটা ফুলিয়ে অহংকারের সাথে বাবলু বললো,
“আমি ক্লাস এইটে পড়ি। পাইলট হাই স্কুল। এবার বল তুমি কোন ক্লাসে পড় আর বড়দের তুমি করে কেন বলবা?”
“আমি ক্লাস সেভেনে। রামপুর গার্লস হাই স্কুল। এক বছরের বড় আবার কিয়ের বড় যে ‘আন্নে আন্নে’ বলে ডাকা লাগবে?”
বাবলু একেবারে চুপসে গেলো। ক্লাস সেভেন? বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে এই মেয়ে ক্লাস ফোর-ফাইভের চেয়ে বড় হবে। হঠাৎ মনে হল দেড় ব্যাটারী মেয়েটা যেন আরো দু্হাত লম্বা হয়ে গেছে। রাগটাগ চলে গিয়ে খানিকটা সমীহ আর আকর্ষণ বাড়ছে পিচ্চি অথচ অসম্ভব সুন্দর মেয়েটির প্রতি। চকিতে আশপাশটা দেখে নিলো। সবাই জটলা বেঁধে একই সেটে আবার বৌ চি খেলবে নাকি বড় পরিসরে রেডিকোর্ট খেলবে। এরমধ্যে দিয়া আর সুমী মাটির উপর কোর্ট এঁকে কুত কুত খেলা শুরু করে দিয়েছে। হঠাৎ খেয়াল করলো বাঁ দিকে উঠোনের শেষ প্রান্তে একটা নারকেল গাছের নীচে দাঁড়িয়ে রইক্কা সরু চোখে বাবলুর দিকে তাকিয়ে আছে। এই রে, আবার এসে কথা শোনাবে। কি মনে করে মাথা ঘুরিয়ে ডানে তাকিয়ে দেখে উঠোনের আরের মাথায় হাগাধরা নজরুইল্লাও গভীর মনযোগে ওর দিকে চেয়ে আছে। নিজেকে পরাজিত মনে হচ্ছে, এত খারাপ লাগছে!
“আমার নাম গিন্নী।”
“এ্যাঁ?” আবার গিন্নীর দিকে তাকায় বাবলু। ভাবে, এটা আবার কেমন নাম? বাড়ীর গৃহকত্রীর নাম হয় গিন্নী। বাবলুর মাথা কাজ করছেনা।
“আমার নাম বাবলু।”
“বাবলু হাবলু হি হি হি।” বলে একটু সরে রেডি হয়ে আছে, বাবলু ধরতে গেলে পালাবে। বাবলু পাল্টা বললো,
“গিন্নী সিন্নি হি হি হি।”
“এ্যাই, খবদ্দার সিন্নী বলবা না।” আঙ্গুল তুলি হুঁশিয়ার করে দিলো গিন্নী।
“এ্যাই, খবদ্দার হাবলু বলবা না।”
গিন্নী হেসে ফেললো। হাত তুলে নিজেদের বাসা দেখালো বাবলু।
“আমাদের বাসা মহিপাল চৌধুরী বাড়ী।” বলে হড় হড় করে অনেক গল্প করলো বাবলুর সাথে। বাবলুও গল্প করলো মেয়েটার সাথে। বাকী সময়টা খেলার ছুতোয়া যতবার গিন্নীর হাত ধরেছে গিন্নী বাধা তো দেয়ই নি বরং খেলাচ্ছলে দু-একবার বাবলুর বাহুডোরেও ধরা দিলো। সময়টা খুব ভালো কাটলো, তলে তলে মেয়েটাকে পছন্দ করে ফেললো বাবলু। গিন্নী বাবলুকে ওদের বাসায় দাওয়াত করলো। দাওয়াত! বাবলুর নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলোনা। তারমানে গিন্নী তার মনের কথা বুঝতে পেরেছে।
রইক্কা (রকিব) ভালোবাসা বিষয়ে অত্যন্ত জ্ঞানী। ও ক্লাস টেনে পড়লেও তুই তোকারি বন্ধু। চিটাগাংয়ের লাভ লেন থেকে বেড়াতে আসা ক্লাস এইটের একটা মেয়ের কিম্ভুত কার্টুন এঁকে সেখানে লাভ চিহ্ন বসিয়ে ওর সাথে প্রেম করে ফেলেছে। আবার মডেল হাই স্কুলের ক্লাস নাইনের একটা মেয়ের সাথেও লিচু গাছের তলায় লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করে। ওকে নাকি চুমুও খেয়েছে। বাবলুর বিষয়টা শুনে এক মুহুর্তও দেরী করতে রাজী নয় রকিব, তাৎক্ষনান সিদ্ধান্ত দিলো পরশু শুক্রবার সকালেই বাবলু গিন্নীকে প্রেমের প্রস্তাব দেবে। “কাইল বিকাল তিনটায় আস্তানায় জরুরী মিটিং।” দলের সবাই বাবলুকে কিভাবে সাহয্য করবে সেটা পাকাপোক্ত করা হবে।
বাবলুদের বাসার পেছনে কাজী পুকুরের উত্তরপাড়ে একটা জংলা জায়গা আছে যেখানে দুটো বড় বড় বাঁশঝাড় আর প্রচুর পুরোনো গাছপালা আছে। কেউ ওদিকটা মাড়ায় না। একটা গর্তের মত নীচু জায়গা আছে যেটা নূয়ে থাকা বাঁশগাছে ঢাকা, বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। এটা ওদের গোপন আস্তানা, নানান ধরনের গোনীয় কাজ যথা, একে অন্যের মোছলমানী দেখা, লুকিয়ে সিগারেট ফোঁকা, তাস দিয়ে জোড়পাত্তি খেলা বা অতি গোপনীয় মিটিং ওখানেই হয়ে থাকে। বিষ্যূদবার ঠিক বিকাল তিনটার মধ্যে ‘অতি গোপনীয়’ মিটিংয়ে জমায়েত হল রকিব, কাওসার, নজরুল, জুয়েল, রাসেল, মুন্না, পারভেজ আর বাবলু। উপস্থিত সকলে বাবলুর সাথে মহিপাল চৌধুরী বাড়ি পর্যন্ত যাবে, বাবলুর প্রেমের প্রস্তাব সফলভাবে পেশ করার পর সবাই একসাথে ফিরে আসবে। অতি দ্রুত প্রস্তাব পেশ করার ব্যাপারে রকিব বললো,
“শুন্, দুইটা জিনিষ কোন অবস্থায় ভিতরে রাখা উচিত না। গ্যাস আর পেম।”
তারপর বাবলুর কাঁধে হাত রেখে কয়েক মুহুর্ত কি জানি ভাবলো, তারপর আবার বললো,
“গ্যাস আইসলে গ্যাস ছাড়ি দিতে হয় তা না হইলে গ্যাস্টিক হয়।”
বাবলু বিরক্ত হয়, “আরে ধুর! প্রেম আর পাঁদ কি এক?” রকিব দ্রুত মাথা নেড়ে বাবলুকে থামায়, তখনো বাবলুর কাঁধে তার হাত, চোখ বুঁজে থেমে থেমে রকিব বলে চলেছে,
“একই নিয়মে, মনে পেম আইসলে পেমের কথা পেয়োসীকে বইলতে হয়। তা না হইলে হৃদয়ে গ্যাস্টিক হয়, ওইটা ডেইঞ্জারাস। সুতরাং আগামী কাইল শুক্কুরবার সকালেই তুই যাইবি, মনের কথা সব বইলবি। আমরাতো আছিই।”
“কি কমু?” ব্যাকুল হয়ে বাবলু জানতে চায়।
“যা সইত্য তা কইবি। তুই কইবি,
‘ গিন্নী, তোঁয়াকে আঁর ভালো লেগেছে। আঁই লাভ ইউ। তুমি আমায় চিঠি দিও। ’ তারপর তোর ঠিকানা লেখা কাগজটা তার হাতে ধরাই দিবি। এর বেশী কিছু কইবিনা। তারপর চলি আইসবি।”
বাবলু বলে, “সে যদি পইত্তাখ্যান করে?”
“কোন সম্ভাবনা নাই। তুই কুচকুইচ্চা কালা, তার উপর তোর জোড়া ভুরু। এই রকম তেলতেইল্লা কালা এবং জোড়া ভুরুর পোলাদের জইন্য নারী জাতি দিওয়ানা। নিশ্চিন্ত থাক, পেম হবেই।” রকিব অভয় দেয়।
“এইটা ঠিক কইছত। শাকচুন্নী একবার আমারে বেড়াই ধরছিলো। তারপর… ইয়াক থুঃ” বাবলুর এই কথায় সবাই হুমড়ি খেয়ে তার কাছে চলে আসে।
পারভেজের চোখ চকচক করছে, “মেরী আপা তোরে আনজা করে ধরছিলো? ওরে আল্লা রে, তারপর? কেমন লাগলো বেড়াই ধরা?”
“বায়োলজী প্র্যাক্টিকাল ক্লাসে একটা কংকাল আছে না? ওইটায় বেড়াই ধইল্লে যেমন লাগে তেমন। হাড্ডি আর হাড্ডি। তারপর আমার ঠোঁটেরে…. ইয়াক থুঃ” ঘেন্নায় মুখ বিকৃত করে ফেলে বাবলু।
জুয়েল হাসে আর বলে, “আর দুই বছর চান্দুউউ, জাস্ট দুই বছর। যখন ক্লাস টেনে উইঠবা ঠিক এই কথাই মনে আইসবো, তখন বইলবা মধুরে মধু।”
এসব কথায় বাবলুর ভাবান্তর হয় না। উল্টে ভয় হয় গিন্নী যদি ডলি আপাকে সব বলে দেয়, “যদি ডলি আপা সব বাসায় বলি দেয়?”
রইক্কা বলে, “তাইলেতো তোর পেম হই গেছে, ১০০% গ্যারান্টি। ধরা খাইয়া ছ্যাঁচা খাওয়া পইত্যেকটি পেমই সফল। কি রে, তুই ডরাইলি নিকি?”
“নাহ্ নাহ্ নাহ্। ডরইলে ডর, না ডরাইলে কিয়ের ডর?”
প্রেম বিষয়ে অন্য কারো অভিজ্ঞতা না থাকায় যাবতীয় উপদেশ রইক্কাই দিলো। প্রথমতঃ প্রস্তাবের সময় তাড়াহুড়া দেখানো যাবেনা। যদি গ্রহন করে তো করলোই না করলে নাই, মন খারাপ করা যাবেনা। প্রয়োজনে অন্যত্র চেষ্টা করা হবে। খবরদার, কোন অবস্থায় মোছলমানি দেখানো যাবেনা। আজকালকার মেয়েরা পাত্রের মোছলমানী হইছে কিনা নিশ্চিত না হয়ে পেম করেনা। বিশ্বাস করে সাচ্চা দিলে পেম হলে হবে না হলে নাই। বাসর রাইতের আগে মোছলমানী দেখানো হারাম। আরেকটা বিষয় পই পই করে মনে করিয়ে দেয়া হল, কোন ভাবেই কুকুরের কামড় খাওয়ার কথা গিন্নীকে বলা যাবে না। এ বছরের শুরুর দিকে বাবলু কুকুরের কামড় খেয়েছিলো। একটা না, চারটা কুকুর একসাথে কামড় বসিয়েছে। ওরা বুদ্ধি করে এক কুত্তায় কামড়াইছে বলায় শুধু চৌদ্দটা ইনজেকশন দিয়েছে। তা না হলে ছাপ্পান্ন ইনজেকশন দিতো।
“মনে রাখিছ, কুত্তার কামড় খাওয়া পোলার সহিত কোন নারী পেম করেনা। পেস্টিজের ব্যাপার।” জ্ঞানী রকিব বাবলুকে সাবধান করে দিলো।
প্ল্যান পাকা, একে একে সবাই বাবলুর সাথে হ্যান্ডশেক করে। এবার হবে রক্তের শপথ। কাওসার লাল ইটের গুড়া পানির সাথে মিশিয়ে কাঁঠাল পাতার উপর বসিয়ে নিয়ে এসেছে। সবাই ইটের গুড়ার রক্তে তাদের বুড়ো আঙ্গুল রঞ্জিত করে শপথ নিলো, “ভাইয়ের জন্য ভাই, বন্ধুর জন্য বন্ধু, রক্তের জন্য রক্ত। শপথ, এই সিক্রেট মৃত্যু পর্যন্ত সিক্রেট থাকবে।”
প্ল্যান মত সবাই শুক্রবার সকালে রওয়ানা হয়েছে।
পূর্ব উকিল পাড়া থেকে মহিপাল চৌধুরী বাড়ি প্রায় তিন কিলোমিটার দুরত্বে। বাবলুর সাথে এসেছে রকিব, কাওসার, নজরুল, জুয়েল আর পারভেজ। রাসেল আর মুন্নাকে বাসা থেকে বের হতে দেয় নি। ট্রাংক রোড থেকে শহীদ শহিদুল্লাহ্ কায়সার সড়ক ধরে সোজা পশ্চিম দিকে হাটলে মহিপাল পৌঁছানো যায়। ঢাকা-চিটাগাং হাইওয়ের আগে একটা ডানে মোড় আছে, ওটার নাম চৌধুরী বাড়ী রোড। ওই রোড ধরে হাঁটতে থাকলে বাঁ দিকের প্রায় পুরোটাই মহিপাল চৌধুরী বাড়ি। পুরো পথ ওরা হেঁটে এসেছে কারন কারো কাছে রিকশা ভাড়া নেই। চৌধুরী বাড়ি রোডে মসজিদের একটু আগে একটা ঝুপড়ির দোকানের সামনে বসে সবাই জিরুচ্ছে। নজরুল প্রথম থেকেই কেমন জানি অস্থির, গজ গজ করছে এই বলে যে এখানে আসা মোটেও উচিত হয় নি। চৌধুরী বাড়ির পোলাপান যদি জানতে পারে উকিলপাড়া থেকে পোলাপান এসেছে তাদের মেয়েকে প্রেমের প্রস্তাব দিতে, ধরে পিটিয়ে ঠ্যাং ভাঙ্গবে। কাওসার ধমক দিয়ে নজরুলকে থামালো। গিন্নীদের কোন বাড়ী কেউ জানে না। কেউ গিন্নীর বাবার নামও জানেনা। শুক্রবার হওয়াতে এলাকাটাও নীরব, কয়েকটা টং দোকান ছাড়া আর কিছু খোলা নেই। অবশ্য মেইন রোডে সব খোলা। মুল রাস্তার মোড়ে ভুঁঞা সাইকেল মার্ট-এ জাফর ভাইয়া বসে আছে। জাফর ভাইয়াও মহিপাল চৌধুরী বাড়ির, বিরাট গুন্ডা। মোচ আছে। সবাই চোখ রাখছে বাড়ীর দিকে। এ বাড়ি ও বাড়ির মাঝে মাঝে উঠোনগুলোতে পোলাপান খেলছে। সবগুলো চোখ গিন্নীকে খুঁজছে।
এবার আরেক উপদ্রপ, তিন চারটা ষান্ডামার্কা লোক ওদেরকে জেরা করতে শুরু করলো। ষান্ডাগুলো চা দোকান বা লাকড়ির দোকানে কাজ করে। লুঙ্গি পরা, বিড়ি খাওয়া বিশ্রী দাঁত, কথাবার্তার ভাষাও অভদ্র। কাওসার, জুয়েল আর পারভেজ বুক চিতিয়ে ধমক দিতে পিছু হটলো কিন্তু সব গোলমেলে করে দিলো নজরুইল্লা। এই শালা হাগাধরা ভয়ের চোটে আরেক ষান্ডাকে সব বলে দিয়েছে। ওই ষান্ডা হঠাৎ বাবলুর সাথে খুব ভালো আরচণ শুরু করলো এবং বাবলুকে আপনি আজ্ঞে করতে লাগলো। তারপর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে কি জানি বললো অমনি বাবলুর মুখে হাসি দেখা দিলো। বন্ধুদের কাছে বাবলু এসে বললো তোরা বস আমি যাবো আর আসবো। বন্ধুদের সন্দেহ তবু যায় না, ওই ষান্ডা কি এমন বললো যে বাবলুর সাহস এত বেড়ে গেল? এটা চৌধুরী বাড়ি, ওকে মেরে লাশ লুকিয়ে ফেললেও কেউ কিচ্ছুটি করতে পারবেনা। বাবলু অভয় দিলো, ওই ষান্ডা তার বাবার ফ্যাক্টরীতে কাজ করতো এখন করেনা তবে বাবলুদের সম্মান করে। উনি বাবলুকে কামরূপ কামাক্ষার মন্ত্র শিখিয়ে দিয়েছেন, “পাওয়ারফুল মন্ত্র, প্রেম হবেই।” বাবলু যেন সম্মোহিত হয়ে গেছে। গিন্নীকে কোন বাড়িতে পাওয়া যাবে সেটাও বলে দিয়েছেন। এখন বাবলু গিয়ে মন্ত্র পড়ে প্রস্তাব দেবে ব্যাস। সবাই বিপদ টের পেলেও বাবলু যাবেই, ওকে বাধা দেবার চেষ্টা করতেই বাবলু উল্টে হন হন করে রওনা দিলো চৌধুরী বাড়ির দিকে।
বাবলুকে যেই ষান্ডা খুব তোয়াজ করেছে ওর নাম পরটা। শুনে হাসি আসে কিন্তু ওটাই ওর নাম। কাজ করতো বাবলুর বাবার ফ্যাক্টরীতে পরে চাকরী চলে গেছে। বাবলুকে চিনতে পেরে খুব করে তোষামোদি করে গিন্নীদের বাড়ি দেখিয়ে দিয়ে কামরূপ কামাক্ষার মন্ত্র শিখিয়ে দিয়েছে। মন্ত্র বাবলুর পছন্দ হয়নি কিন্তু পরটা কসম খেয়ে বলেছে এই মন্ত্র ঠিক মত পাঠ করলে নারী বশ হবেই এবং সারাজীবন বাবলুকে ভালোবাসবে। আজ পর্যন্ত একজন বণী-আদমও এই মন্ত্র পাঠ করে বিফলে যায় নাই। তবে এই মন্ত্র পাঠ করার সময় হাতের মুষ্ঠিতে বিশেষ তাবিজ থাকবে এবং মন্ত্র পাঠ করতে হবে মনের মানুষের কানে কানে, এক নিশ্বাসে। তারপর তাবিজটা পানা পুকুরের মাঝখানে ফেলে দিতে হবে। মনের মানুষকে বলার আগে কোন অবস্থায় এই মন্ত্র উচ্চারণ করা যাবেনা। পরটা বাবলুকে একটা ছোট্ট তাবিজ ধরিয়ে দিয়েছে।
হালকা গোলাপী রংয়ের বাড়ীটা গিন্নীদের। ওই তো, গিন্নী পোলাপানদের সাথে উঠোনে দৌড়া দৌড়ি করছে। বাবলুকে দেখে একছুটে চলে এলো,
“বাবলুউউউ” এসেই বাবলুর দুহাত ধরেছে, বাবলুর মনে হল এটা স্বপ্ন। নাকের আগায় ঘাম, নাকফুলটা আজও ঝিলিক মারছে। কি যে সুন্দর হাসি মেয়েটার। বাবলুর ডান হাতের তালুতে তাবিজ, যত দ্রুত মন্ত্র পড়ে সরে যেতে হবে। “বাসায় চল।” বলে টান দিতেই থামালো বাবলু,
“না না। তোমাকে একটা কথা বলেই চলে যাবো।”
“দরকারী কথা?”
“হ্যাঁ অনেক দরকারী, কিন্তু কানে কানে বলবো।”
“কানে কানে?” গিন্নী পেছন দিকে তাকায়, “আসো” বলে ওদের মূল ঘরের পেছনে নিয়ে যায়, একদিকে ঘরের পেছন আরেকদিকে বাউন্ডারী ওয়াল। কেউ ওদের দেখতে পাচ্ছেনা। “তাড়াতাড়ি বল।” গিন্নীরও যেন তর সইছেনা। বাঁহাতে চুলগুলো কানের পেছনে নিয়ে মুখটা এগিয়ে দিলো। সুন্দর, মসৃন লালচে ফরসা গাল।
বাবলু বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে সেই নিশ্বাস আটকে রেখে মন্ত্রটা পড়লো,
“গিন্নী সিন্নী
কই মাছের কোয়াব,
গিন্নীরে হোন মাইল্লে
আখিরাতে সোয়াব।”
বাজে কথা বলে ফেললো বাবলু।
কয়েক মুহুর্ত বাবলুর মুখের দিকে চেয়ে থাকলো ছোট্ট মেয়েটা। বজ্রাহত। তারপর ছোট্ট মেয়েটার গলায় এতখানি শক্তি কোত্থেকে এলো কে জানে। গগনবিদারী চীৎকার,
“বেয়াদপ… বেয়াদপ… অসভ্য… …” মুহুর্তে আশপাশে মা খালারা জড়ো হয়ে গেছে। গিন্নী তখনো চীৎকার করে চলেছে, “বেয়াদপের বাচ্চা. . .”
মধ্য বয়সী এক ভদ্রমহিলা দৌড়ে এলেন গিন্নীর দিকে, বাবলুকে দেখে আতংকিত হয়ে চীংকার করে উঠলেন, “ওরে জানোয়ার এনা! কুচকুইচ্চা কালা জানোয়ার!!!”
যেদিক থেকে এসেছে সেদিকে পালালো বাবলু।
টং দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে রকিব আর পারভেজ ইচ্ছামত নজরুলকে ঝাড়লো, কি করে পারলো এতবড় সিক্রেট লিক করতে? তা ও বস্তির কয়েকটা ষান্ডার কাছে? নজরুল মিন মিন করছে, ওকে নাকি বেঁধে ফেলার হুমকি দিয়েছিলো। কাওসার ঘোষণা দিলো নজরুলকে দল এবং আস্তানা থেকে বহিষ্কার করা হবে। হঠাৎ টের পেল আশেপাশে ষান্ডাগুলো কেউ নেই। ইয়া আল্লাহ্, চৌধুরী বাড়ির পোলাপানদের গিয়ে বলে দিলো নাকি উকিল পাড়া থেকে গ্রুপ এসেছে? সর্বনাশ।
হঠাৎ একটা মেয়ের চিল্লাচিল্লির শব্দ শোনা গেলো। এরপর অনেকগুলো পুরুষকন্ঠ, ধর ধর ধর! চৌধুরী বাড়ির দিক থেকে প্রচন্ড বেগে ওদের দিকে ধেয়ে আসছে বাবলু, পেছন পেছন চৌধুরী বাড়ির পোলাপান, প্রায় সবার হাতে লাঠি। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে শুধুই দৌড়। এ মুহুর্তে জান বাঁচানো ফরজ।
সবাই মিলে দৌড় দিলো শহিদ শহীদুল্লাহ কায়সার সড়কের দিকে। ওটাই এ মুহুর্তে সবচেয়ে নিরাপদ। শত শত রিকশা, ঠেলাগাড়ি, বেবীট্যাক্সি, টেম্পু, গাড়ী, বাস, ট্রাক আর জনতার ভীড়ে হারিয়ে যাওয়া কঠিন হবেনা। মেইন রোডে পৌঁছার আগ মুহুর্তে বাবলু দেখে জাফর ভাইয়া মটরসাইকেল বের করছে, পাশে একটা ছেলে হাতে হকিস্টিক। বাবলু প্রানপনে মেইন রোডে উঠে বাঁয়ে মোড় নিয়ে প্রানপনে দৌড়াচ্ছে। এখন আর বন্ধুদের দেখা যাচ্ছেনা। কি মনে করে পেছনে তাকিয়ে দেখে জাফর ভাইয়ার লাল হোন্ডা H100CDi রিকশা আর অন্য সব গাড়ীর ফাঁক গলে এঁকেবেঁকে এগিয়ে আসছে, পেছনে বসা সেই ছেলেটা, তার বাঁ হাতে হকিস্টিক। আতংকে অস্থির হয়ে গেল বাবলু, মৃত্যুভয় তাকে গ্রাস করেছে। এখন তাকে দৌড়াতে হবে, তা না হলে নির্ঘাৎ মৃত্যু।
প্রথমে ভাবলো ওয়াপদা কলোনীর গলিতে ঢুকবে কিন্তু সেটা বাদ দিয়ে আরো জোরে দৌড়ে সামনের দিকে এগুতে থাকলো। চিতার মত ক্ষিপ্রগতিতে লোকজনের ফাঁক গলে ফেনীর দিকে দৌড়ে যাচ্ছে বাবলু। ডান হাতের মুঠোয় তাবিজ, নাহ্ ওটাও ফেলা যাবেনা। পাঠান বাড়ী রোডে ঢুকে যাবে? নাহ্, সোজা দৌড়াতে লাগলো, তারপর হাতের বাঁয়ে ফায়ার ব্রিগ্রেড, ডানে সাদেক বিল্ডিং ফেলে সোজা যেতে যেতে হঠাৎ বাঁয়ে তীব্র বেগে ডাক্তার পাড়ায় ঢুকে গেলো। একটু এগিয়ে জুলফিকার ডাক্তারের বাসার উল্টোদিকে একটা হলুদ দোতলা বাড়ী, লাল ফ্লোর আর লাল লাল পিলার। বাঁ দিকে দোতলায় ওঠার খোলা সিঁড়ি, কোন দিকে না তাকিয়ে এক দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে সিঁড়ির ঠিক উপরের ধাপে বসলো। বিল্ডিংয়ের পেছনে পুকুর তার ওপাশে রাস্তার ধারের দোকানপাট। বাবলু হাতের তাবিজটা ছুঁড়ে পুকুরে ফেলে দিলো। দোতলার উপর থেকে দোকানপাটের ফাঁক দিয়ে রাস্তা দেখা যায়। বাবলু দেখে জাফর ভাইয়ের লাল হোন্ডা পেছনে সেই হকিস্টিকওয়ালা ছেলেসহ ট্রাংক রোডের দিকে যেতে যেত চোখের আড়াল হয়ে গেল। এবার ধড়ে প্রান ফিরে পেলেও মনে হচ্ছে সে মরে যাবে। এত দৌড় জীবনেও দৌড়ায়নি। অনেকখানি পথ। হা করে বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে, সারা শরীর ঘর্মাক্ত। মুখও ঘামে ভিজে জবজবা। দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিল, এখানেও ফ্লোর লাল রংয়ের, খোলা ছাদহীন বারান্দা। সামনের রুম খোলা তবে সাড়াশব্দ নেই। এখানে সে আগেও এসেছে। খলিল ডাক্তারের বাসা, বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দোতলায় সামনের রুমে রোগী দেখেন।
চার পাঁচ মাস আগের কথা। বাঁশ পাড়ার মস্তানসুর কাকার বাড়ীর পেছনের জংলা উঠোনে কুকুর বাচ্চা দিয়েছে। বাবলুর কুকুর পোষার শখ, আম্মার জন্য পারেনা। আম্মা কুকুর দেখতে পারেনা। কিন্তু মস্তানসুর কাকার পেছনের উঠোনে বাচ্চা কুকুরগুলোকে খেলতে দেখলে নিজেকে সামলাতে পারেনা। দিন যায় আর বাচ্চাগুলো বড় হতে থাকে, কি যে সুন্দর কুকুরছানাগুলো। একটা ছেলে কুকুর মনে মনে পছন্দ করে রেখেছে, তক্কে তক্কে আছে বেশী বড় হয়ে যাবার আগেই ওই কুকুরছানাটা চুরি করবে। নামও ঠিক করে রেখেছে, “জর্জ বুশ।” আমেরিকার প্রেসিডেন্টের নামে নাম। এক বিকেলে বাচ্চা কুকুরটা কোলে নিয়ে পালাতে যাবার মুহুর্তে মা টের পেয়ে গেলো। কিন্তু বাবলুকে ধরা এত সহজ নয়, বাধ সাধলো বাঁশঝাড়। ওখানে হোঁচট খেয়ে পড়েও বুকের মধ্যে জর্জ বুশকে আগলে রেখেছিলো। বুশের মা কামড় বসালো বাঁ হাতে, বাপ-চাচারা মিলে কামড় দিলো পায়ে। জর্জ বুশকে ছেড়ে দেয়া মাত্র সবাই কুকুরের দল বাবলুকে আপাততঃ মাফ করে ফিরে গেল। মাথার মধ্যে বারবার ঘুরছে লুই পাস্তুরের নাম। কুকুর কামড় দিলে জলাতংক রোগ হয়, সেই রোগের ওষুধ আবিষ্কার করেছে লুই পাস্তুর। বাংলা বইতে সব লেখা আছে। নাহ বাবাকে জানাতেই হবে, মরনের চেয়ে মাইর ভালো। কুকুরে কামড়েছে শুরে বাবা এক সেকেন্ড দেরী না করে বাবলুকে ডাক্তারখানায় নিয়ে গেলো। ডাক্তারপাড়ার হলুদ রংয়ের বাড়ী, লাল লাল পিলার। চেম্বারের সামনে ছোট্ট নেমপ্লেট, ডাঃ মোঃ খলিলুর রহমান। এমবিবিএস। খলিল ডাক্তারও বাবলুর মত, কুচকুইচ্চা কালা। কিন্তু মুখটা মায়ায় ভরা আর ব্যাবহার অমায়িক। তিনি ইনজেকশনের জন্য প্রেসক্রিপশান দিলেন, দিনে একটা করে চৌদ্দ দিন দিতে হবে। নিজেকে ধন্যবাদ দিয়েছিলো বাবলু, চারটা কুকুর কামড়ে দিয়েছিলো বললে ছাপ্পান্ন দিন লাগতো।
পায়ের শব্দে পেছন ফিরে চায় বাবলু।
“আরে! বাবলু ভাইয়া না? কি হয়েছে আপনার?” ফুলের মত ফুটফুটে একটা মেয়ে, কোকড়া কোকড়া চুল। লাল ফ্রক পরা। মেয়েটার চোখেমুখে উৎকন্ঠা। বাবলু তখনো হাপরের মত শ্বাস নিচ্ছে, গায়ের আর মুখের ঘাম তখনও শুকায় নি। কিন্তু বাবলুর নাম জানে কি করে? বাবলু কিছু একটা বলতে যাবে মেয়েটা হঠাৎ দৌড়ে ভেতরে চলে গেল। বাবলু ওকে আগে কখনো দেখেনি, কিভাবে চেনে তাকে? একটু পর ফিরে এলো মেয়েটা। হাতে এক গ্লাস ফ্রীজের ঠান্ডা পানি। ততক্ষনে অনেকটা সামলে নিয়েছে। ঢক ঢক করে এক নিশ্বাসে পানি শেষ করে গ্লাস ফেরত দিলো বাবলু। ছোট্ট মেয়েটা কিভাবে বুঝলো বাবলুর এখন ঠান্ডা পানি লাগবে?
“মারামারি করেছেন?” বাবলুকে ভালো করে দেখছে মেয়েটা।
“নাহ্। আমার নাম জান কেমনে?” বাবলু জানতে চায়
“আপনাকে আমি চিনি। সাহাব চাচ্চুর বাসায় রাজীবের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে দেখেছি।”
বাবলুর পাড়ায় ম্যানেজার সাহেবদের বাড়ি, উনার ছোট ছেলে রাজীবের জন্মদিন গেল কিছুদিন আগে। দুনিয়ার মেহমান এসেছিলো সেদিন, অনেক ছেলেমেয়েও। কিন্তু এই মেয়েটিকে সে দেখেনি।
“কি নাম তোমার?”
“রেটিনা।”
মেয়েটার কন্ঠে খুব মিষ্টি হয়ে বেজে উঠলো নামটা।
“কোন ক্লাসে পড়?”
“ক্লাস ফাইভে।” বলে হেসে ওঠে রেটিনা। কি মিষ্টি, কত আপন, যেন কতকাল ধরে বাবলুকে চেনে। রেটিনা আবার প্রশ্ন করে, “আপনাকে কেউ তাড়া করেছে বাবলু ভাইয়া?”
কিছুক্ষন রেটিনার দিকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটি ফাজলামো করছেনা, জানতে চাচ্ছে। বাবলু আবার মুখ ঘুরিয়ে নিলো। রেটিনা নীচু গলায় বলে, “আমাকে বলতে পারেন, আমি কাউকে বলবো না।”
“রেটিনা। আমি যাই হ্যাঁ।” উঠে দাঁড়ায় বাবলু, এখন বাবলু পুরোপুরি ধাতস্থ হয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে উঠোন পার হয়ে রাস্তায় ওঠার মূহুর্তে শুনতে পায়, “টা টা বাবলু ভাইয়া!” উপর থেকে রেলিংয়ে এক হাত রেখে অন্য হাতে টাটা দিচ্ছে মিষ্টি পরীটা।
ডাক্তারপাড়া থেকে মেইন রোডে উঠার আগে ভালোমত ডানেবাঁয়ে দেখে নেয় বাবলু। এতক্ষন পর্যন্ত কারো থাকার কথা নয় তবু সাবধানের মার নেই। মেইন রোড ধরে ট্রাংক রোডের দিকে সামান্য এগিয়ে ডানে ইসলামপুর রোডে ঢুকে গেলো। এরপর জগন্নাথ বাড়ী রোড, বাজার ইত্যাদি হয়ে বাসায় ফিরে গেল। প্রায় দুপুর হয়ে গেছে, এর বেশী দেরী হলে আম্মা জেরা শুরু করবে। ডলি আপার কথা মনে হতে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। যদি উনি জানতে পারেন, কি হবে বাবলুর?
বিকেলে আস্তানায় জড়ো হল সবাই। বাবলুকে অক্ষত দেখ সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। কেউ বাবলুকে জেরা করছেনা দেখে বাবলুও কামরূপ কামাক্ষার মন্ত্রের কথা চেপে গেল। কিন্তু বাধ সাধলো রইক্কা। বাবলুকে প্রথম থেকেই সন্দেহের চোখে দেখছে সে। জুয়েল আর কাওসারকে কানে কানে কি যেন বলতেই ওরা একসাথে বাবলুর দিকে তাকালো। বাবলু প্রমোদ গুনলো। সবাই মিলে চেপে ধরতে বাবলু যা যা ঘটেছে জানালো।
বাবলুর সব শুনে সবাই থ’। বাবলুটা এত গাধা? কোথাকার কোন পরটা না কি, কামরূপ কামাক্ষার মন্ত্র আর তাবিজের কথা বলে বোঝালো এভাবে বললে প্রেম হবেই। আর বাবলু সেটা বিশ্বাস করে নোংরা কথা বলে বসলো মেয়েটাকে? তারপর সবার মার খেয়ে লাশ হবার উপক্রম। পুরা চৌধুরী বাড়ি ওদের পিছু নিয়েছিলো। এদিকে রকিবের সব রাগ ওই নজরুলের দিকে। “শালা হাগাধরা, তুই সব নষ্টের গোড়া। ভয়ের চোটে ষান্ডা গুলার কাছে সিক্রেট আউট করছস। তুই দল থেকে বাদ, যা ভাগ!”
বাবলু আর কিছু ভাবতে চায় না। সত্যি খুব বাজে কাজ করেছে। গিন্নী কোন দোষ করেনি অথচ সে বাজে কথা বলে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে। প্ল্যানমত ভদ্রভাষায় প্রস্তাব দিলে হয়তো এমন চেঁচাতোনা। হাতের মুঠোয় তাবিজ থাকাতে বাবলু ধরে নিয়েছিলো যেভাবে শেখানো হয়েছে হুবহু সেভাবে না বললে চরম ক্ষতি হবে। কামরূপ কামাক্ষার মন্ত্র বলে কথা।
এদিকে বিপদের শেষ নেই। ডলি আপা থেকে লুকিয়ে থাকতে হবে, কিন্তু কতদিন? ডলি আপা শোনামাত্র বাবলুর বাসায় চলে আসবে। উফ্! অস্থির হয়ে যায় বাবলু। রইক্কা সুখবর এনে দেয়, ডলি আপারা বাসা পাল্টে মাষ্টার পাড়া চলে যাচ্ছে। স্বপ্ন সত্যি হবার মত ডলি আপারা সত্যি কয়েকদিনের মধ্যে চলে গেল। বাবলু এ ক’দিন একরকম লুকিয়ে ছিলো। প্রতিজ্ঞা করলো আর কোনদিন মহিপাল চৌধুরী বাড়ি যাবেনা। গিন্নীর সামনে কোনদিন দাঁড়াবেনা। লজ্জ্বা, লজ্জ্বা। কি যে দুঃস্বপ্নের মত ব্যাপারটা, ভুলেও মনে আনতে চায় না আর।
দেখতে দেখতে দু বছর চলে গেল। বাবলু এখন ক্লাস টেনে। আগের মত গাঁট্টাগোঁট্টা নেই। লম্বা হয়েছে বেশ, দেখতে যুবক যুবক লাগে। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে আজকাল দুর দুরান্তেও যায়। সেদিন সকালে স্কুলে গেছে ট্রাংক রোড ধরে মিজান রোড ঘুরে। সুমন সহ হোমওয়ার্ক সেরে একসাথে স্কুলে যাবে। ট্রাংক রোড থেকে যে রাস্তাটা উত্তর ডাক্তারপাড়ার দিকে ঢুকেছর সেখানে পুরান হাসপাতাল কম্পাউন্ডে একটা বকুল গাছ, নীচে দুনিয়ার ফুল।মিস্টি গন্ধে মৌ মৌ করছে চারদিক। কি মনে করে পকেট ভর্তি করে বকুল ফুল নিলো বাবলু।
“বাবলু ভাইয়া!”
যেন ইলেকট্রিক শক। চকিতে চেয়ে দেখে স্কুল ড্রেস পরা চারটা মেয়ে একসাথে। রাস্তায় একটু পর পর রয়েল-ব্লু কালারের ড্রেস পরা মেয়েদের দেখা যাচ্ছে। কাছেই ফেনী গার্লস হাই স্কুল। সবাই স্কুলে যাচ্ছে। বাবলুদের স্কুল ড্রেস উপর থেকে নীচে সব সাদা। গার্লস স্কুলও সাদা ছিলো। কিছুদিন হল ড্রেস পাল্টেছে। উপরে গাড় নীল কামিজ সাদা ওড়না ভাঁজ করে পেছনে ক্রিস ক্রস, নিচে সাদা স্যালোয়ার, পায়ে নীল হকিবুট বা কেডস। খুব স্মার্ট লাগে দেখতে।
“কেমন আছেন?” চার জোড়া চোখ বাবলুর দিকে চেয়ে আছে, প্যান্টের ডান পকেট ভর্তি বকুল ফুল। যে মেয়েটি কথা বলছে ও সবার চেয়ে লম্বা। খুব পরিচিত মুখখানা, ঢেউ খেলানো চকচকে চুল, পরিপাটি করে আঁচড়ানো, মাথায় কালো ব্যান্ড। অন্যদের মত মাথায় স্কার্ফ বাঁধেনি, স্কাউটদের মত গলায় বেঁধেছে। মুখটা খুব চেনা কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছেনা কে হতে পারে।
“কতদিন পর দেখলাম আপনাকে!” একেবারে পরিচিতের মত কথা বলছে। কেন? কে সে?
“চিনতে পারছেন না?” মেয়েটি অবাক।
“আম.. আম.. আমি কি বলবো বুঝতে পারছিনা।” কোন মতে বাবলু বললো।
শব্দ করে হেসে উঠলো মেয়েটি, সাথে পাশেরগুলোও। বাবলুর মাথা ঘুরছে। “বলতে না পারলে চিঠি লেখবেন কেমন?” হাত দিয়ে চিঠি লেখার মত ইশারার করে মায়াভরা হাসি ছুঁড়ে দিয়ে গট গট করে চলে গেলো সবাই মিলে।
“তোর কি হইছে। কোন কথা কইলিনা যে?” সুমন অবাক।
“কি কথা কমু, আমি তো তারে চিনিই না।” বাবলু বলে। ওরাও ওদের স্কুলের দিকে রওয়ানা হয়েছে।
“তোরে চিনে, তোর নাম পর্যন্ত জানে। আর তুই চিনস না?”
“সইত্য আমি চিনিনা। কে ও? বাসা কই?”
“আমাদের পাড়ার, খলিল ডাক্তারের মাইয়া এইটা। তবে ভদ্র, পোংটা না।”
“রেটিনা?” খলিল ডাক্তারের মেয়ে শুনে আকাশ থেকে পড়ে বাবলু।
“এখন দেখি নামও জানস।” সুমন খোঁচায়।
“ওরে আমি এইটুক দেখছি, তা ও দুই তিন বছর আগে। কত লম্বা হয়ে গেছে, চিনুম কেমনে?” বাবলু এর বেশী কিছু বললো না।
“তিন বছরের ভিতরে একবারও দেখা হয় নাই? অথচ তোরে মনে রাখসে, আবার চিঠিও লেখতে কইলো? বাপ রে বাপ! আজকেই লেইখা ফালা।” খুব আগ্রহের সাথে বলে সুমন।
“ধুৎ! বাচ্চা মেয়ে।”
“আর তুমি ক্লাস টেনে উইঠা আংকেল হইয়া গেছ? আরেহ্, রেটিনা পড়ে ক্লাস সেভেনে, একেবারে বাচ্চা না।” এবার বাবলু বিরক্ত চোখে তাকায়। কিন্তু সুমন মারিয়া,
“শোন বাবলু, চিঠি দিস প্রেমপত্র না। এমন করিস ক্যান? কাগজের মধ্যে দুই লাইন বসায়া পাঠায়া দে।”
বাবলু কথা বাড়ায় না। চুপ চাপ হাঁটতে থাকে। জিন্দেগীতে আর কোন মেয়ের সামনে দাঁড়াবেনা সে।
কিন্তু রেটিনার কথা ঘুরে ফিরে মনে হতে লাগলো। সেদিন পরীর মত সেই মেয়েটা নিজ থেকে বুদ্ধি করে ঠান্ডা পানি খাইয়ে ওর অনেক বড় উপকার করেছিলো। ভেবে মনটা কৃতজ্ঞতায় ভরে যায়। এতদিন পর আবার যখন দেখলো তখন অনেক পরিবর্তন। নীল স্কুল ড্রেস, সাদা ভাঁজ করা ওড়না, পেছনে ক্রিস ক্রস। হাত দিয়ে চিঠি লেখার ভঙ্গি, মুখচোখ ভরা অসম্ভব সুন্দর হাসি। সবচেয়ে বেশী মনে পড়ে রাতে ঘুমাতে গেলে, অনেক্ষন ঘুম আসেনা। তাই বলে চিঠি লেখবে? না না।
স্কুলের পড়া, প্র্যাটিকাল ক্লাস, প্রইভেট সব মিলিয়ে বেশ ব্যাস্ততার মধ্যে অনেকগুলো মাস গড়িয়ে গেল। টেস্টে ভালো রেজাল্ট করে এসএসসির রেজিস্ট্রশন কম্প্লিট করার পর খানিকটা জিরোবার সুজোগ হল। আবার কল্পনায় ফিরে আসে রেটিনা। খুব দেখতে ইচ্ছে করে রেটিনাকে। কি করবে বাবলু? যত দিন যায় অস্থিরতা বাড়ে বাবলুর। ধ্যাৎ, মন কিছুতেই মানছেনা। ডাক্তার পাড়া যাবে সে।
জীবনে প্রথম কোন মেয়েকে চিঠি লেখলো।
রেটিনা,
সরি, প্রথমে তোমাকে চিনতে পারিনাই। মুখটা খুব চেনা চেনা লাগতেছিলো কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারিনি ওটা তুমি। এত বড় হয়ে গেছ!!
যেদিন প্রথম তোমাকে দেখেছিলাম, ঐ যে, আমি তোমাদের সিঁড়ির উপর বসেছিলাম। তুমি আমাকে পানি এনে দিলে। পানি না পেলে মনে হয় আমি মরেই যেতাম। তোমাকে কি যে সুন্দর লাগতেছিলো কিন্তু বলতে ইচ্ছা করলেও বলি নাই। তখন তুমি ছোট মানুষ না?
এতদিন পর সেদিন তোমাকে দেখে আমি বুঝতে পারিনাই তুমি রেটিনা। আগের চেয়ে অনেক লম্বা, অনেক বেশী সুন্দর। তোমার কথা শুনে কিছু বুঝতে পারতেছিলাম না আবার বোঝাতেও পারতেছিলাম না। কিন্তু এটা বুঝতে পারতেছিলাম তোমরা সবাই আমার আমার অবস্থা দেখে খুব হাসতেছিলে। তুমি বলছিলা যদি বলতে না পারি তাহলে যেন লেখে জানাই। তাই লেখলাম।
তোমাকে নিয়ে অনেক ভাবি, ভাবতে ভালো লাগে।
ইতি।
বাবলু
চিঠিটা লিখে ভাঁজ করে তার উপর আরেকটা সাদা কাগজ মুড়ে মোটা টেস্ট পেপারস বইয়ে লুকিয়ে রেখেছিলো। আজ যাবো কাল যাবো করে পরীক্ষা চলে আসাতে আর যাওয়া হয় নি, চিঠিটাও দেয়া হয় নি। এসএসসি পরীক্ষার ডামাডোলে ভুলেও গেছিল চিঠির কথা।
সবগুলো প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা শেষ হবার পর হাতে এখন অফুরন্ত সময়।
এবার আর দেরী করলোনা, একদিন নীল জিন্স সাদা কেডস্ আর খয়েরী রংয়ের টিশার্ট পরে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। নিজেকে দেখে মুগ্ধ, গায়ের কালো রং আড়াল করতে খয়েরী টিশার্টের জুড়ি নেই। মেইন রোড থেকে ডাক্তার পাড়া ঢোকার সময় বুকের টিপ টিপ বেড়ে গেল। ভয় পাচ্ছে নাকি? ধুর, অনেক বড় হয়েছে সে। তখন বেলা প্রায় বারোটা, আশপাশ নীরব। হলুদ দোতলা বাড়ির উঠোনে পা রেখে দেখে সব নীরব। ডাক্তার সাহেবের ছোট্ট নেমপ্লেটটা কোথায়? উপরে নীচে সামনের দরজা জানাগুলোও বন্ধ। স্কুল বন্ধ চলছে, বেড়াতে গেল নাকি? খোলা সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে গিয়ে শব্দ শুনে ঘুরে দাঁড়ালো,
“এই যা বাবা, কারো চান?” মধ্যবয়সী এক মহিলা। হাতে বাজারের ব্যাগ, কাজের লোক বোধ হয়।
“ডাক্তার সাহেবের কাছে যাচ্ছিলাম।” বাবলু বলে।
“কেউ তো থাকেনা এইখানে।” মহিলা বললো।
“খলিল ডাক্তার সাহেবের বাসা না এইটা?” অবাক হয় বাবলু।
“উনারা চাইর পাঁচ মাস আগে গেছে গা। ভাড়া থাকতো।”
বড় একটা ধাক্কা খেল বাবলু। কল্পনাও করতে পারেনি এটা ডাক্তার সাহেবের নিজের বাড়ী না, উনারা ভাড়াটিয়া ছিলেন। মহিলা জানেনা তারা কোথায় গেছে। শূন্যদৃষ্টিতে বাড়িটা আবার দেখে বাবলু। হলুদ রংয়ের দেয়াল, লাল লাল পিলার। বন্ধ দরজা-জানালায় ধুলোর আস্তর। সদর দরজায় তালা ঝুলছে।
রিকশায় এসেছিলো। কখন হাঁটতে শুরু করেছে টের পেলনা। কেমন জানি খালি খালি লাগছে সবকিছু। একেবারে চলেই গেল? বাবলু জানতেও পারলোনা? জানবে কোত্থেকে, সে ই তো কোন খবর রাখেনি। সুমন কৌতুহল দেখালে তাকেও ডাঁট দেখিয়েছে, সুমনও আর কথা বাড়ায় নি। ঘুরে ফিরে মনে পড়ছে সেই ছোট্ট পরীটার হাসিমাখা মিষ্টিমুখ, ঠান্ডা পানি এনেছিলো বাবলুর জন্য। দুবছর পর হঠাৎ বড় হয়ে ওঠা রেটিনাকে দেখে কল্পনাও করতে পারেনি এটাই সেই ছোট্ট পরীটা। কি সুন্দর, কি সুন্দর। মেয়েটা তাকে মনে রেখেছে, এটা ভেবে মন যতটা ভালোলাগায় ভরে যায় তারচেয়ে বেশি আসে বিষাদ। সারাক্ষন মনে হচ্ছিল কিছু একটা হারিয়েছে। বুকের ভেতট কেমন কষ্ট হয়। গলা ধরে আসে, কান্না পায় বাবলুর।
আরো দুই বছর পর।
গত মাসে ফার্স্ট ইয়ার কম্প্লিট করে বাবলু এখন ফেনী কলেজে ইন্টারমেডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র। সায়েন্স গ্রুপ। মেইন বিল্ডিংয়ের পেছনে পুকুর পেরিয়ে একেবারে রেল ষ্টেশনের সীমানায় ওদের ক্লাসরুমগুলো। আগে নীচ তলায় ক্লাস হত এখন থেকে উপরতলায় ক্লাস হবে কারন নীচতলায় জুনিয়ার মানে ফার্স্ট ইয়ারের স্ট্যুডেন্টরা ক্লাস করবে। আজ বাবলুর অন্যরকম ভালোলাগার দিন, প্রায় এক বছর পর সিনিয়ার হল। জুনিয়ররা ওকে ভাইয়া ডাকবে। সায়েন্স বিল্ডিংয়ের নীচতলা এখন একঝাঁক নতুন ছেলেমেয়ের কলরবে মুখরিত। বাবলুর কিছুক্ষন একা থাকতে ইচ্ছে হল।
সায়েন্স বিল্ডিং থেকে হেঁটে মেইন বিল্ডিংয়ের দিকে চলে এলো। শহীদ মিনারের কালো বেদীর উপর বসে মাঠের উপর ছুটে যাওয়া মেঘের ছায়া দেখছে। হেমন্তের শেষ তবু আকাশে শরৎকালের মত টুকরো টুকরো মেঘ। দেখতে ভালো লাগে। ছায়াগুলো যখন মাঠের উপর ছোটে মনে হয় সেও ভাসছে।
“বাবলু ভাইয়া!”
মেঘের দেশ থেকে মাটিতে পড়ে যাবার চেয়েও বেশী অবাক হল বাবলু। গিন্নী। চোখের সামনে জলজ্যান্ত দাঁড়িয়ে। একেবারে পরিপূর্ণ যুবতী। কিন্তু চার বছর আগের সেই ভয়াবহ অপরাধের কারনে গিন্নীর দিকে সরাসরি তাকাতে পারছেনা বাবলু। কোনমতে আমতা আমতা করে বললো,
“আমি জানিনা কিভাবে…”
বাবলুর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে গিন্নী আবার বললো, “কই মাছের বিষয়টা কোথায় পেলেন বলেন তো বাবলু ভাইয়া?”
“পরটা বলেছে মন্ত্রে প্রিয় খাবারের নাম থাকতে হয়। পরটা আব্বার ফ্যাক্টরীতে কাজ করতো। বাজে কথা বলে ফেলেছিলাম, আমাকে মাফ করো দিও।” মাটির দিকে চেয়ে বাবলু বললো। কিন্তু গিন্নী ওকে ভাইয়া ভাইয়া করছে কেন? গিন্নী এদিকে খিল খিল করে হাসতে হাসতে শেষ, যেন কিছুই হয় নি। বলে,
“পরটা আবার কেমন নাম? ‘কোয়াব’ কি ধরনের ভাষা? আচ্ছা ওই পরটা কেমনে জানে কই মাছ আমার প্রিয়?” একসাথে অনেকগুলো প্রশ্ন গিন্নীর। অপরাধীর মত মাথা নিচু করে রেখেছে বাবলু, কথা বলছেনা।
“এই নেন।” গিন্নীর হাতে ছোট সাদা ইনভেলপ।
“কি?”
“ঈদ কার্ড” বলে বাবলুর হাতে গুঁজে দিয়ে দ্রুত চলে গেলো।
ইনভেলপ খোলা এবং ভেতর কোন কার্ড নেই, আছে ভাঁজ করা ছোট সাদা কাগজ। কয়েক মুহুর্ত অপেক্ষা করে কাগজটা খুললো। সুন্দর, গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,
“বাবলু হাবলু
কই মাছের কাবাব,
বাবলুকে ভালোবাসলে
আখেরাতে সওয়াব।”
নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছেনা। এ ও সম্ভব? মাথা তুলে দেখে দেখে গিন্নী সায়েন্স বিল্ডিংয়ের দিকে যাচ্ছে। হাল্কা গোলাপী স্যালোয়ার কামিজ, পিঠ ভর্তি খোলা কালো চুল। হঠাৎ থেমে ঘুরে দাঁড়ালো। সেই ফর্সা সুন্দর মুখটা, নাকে নাকফুল।
নাকফুলের উপর সূর্যেরর আলো ঝিলিক মারছে।
(সতর্কতাঃ- প্রতিটি চরিত্র কাল্পনিক)