‘স্বপ্ন’

 

আমার কাজের রুটিন অন্যসব কাজের চেয়ে আলাদা। রুটিন যেমনই হোক কাজে আসা যাওয়ার রুটিন এক। নিতান্ত বাধ্য না হলে গাড়ী নিয়ে যাই না। ট্রান্সপোর্ট খরচ কর্তৃপক্ষের। ট্রেন, টিউব, বাস, রিভার, যা খুশী তা। আমার এই জবে জয়েন করার অন্যতম কারন ছিলো এই সুযোগটি। বৃহত্তর লন্ডনে বছরে প্রায় আড়াই হাজার পাউন্ড খরচ হয় যাতায়তে। মরার ট্রাভেল কস্ট। বাসা থেকে বাস পর্যন্ত যেতে বড়জোর দশ মিনিট, তারপর বিশ মিনিটের জার্নি। অন্যদিকে টিউবে সময় লাগে আরো কম তবে হাঁটাহাঁটি বেশী। মাঝে মাঝে গাড়ী নিই যদি আবহাওয়া বেশী খারাপ থাকে, কিংবা ট্রাফিক জ্যাম। তখন মনে হয় আহারে, “তেল গেলো জ্বলিয়া।” তবে মিনিট দশেক হেঁটে বাস স্টপ পর্যন্ত গিয়ে, বাস ধরে খানিকটা ধীরে সুস্থে আসা যাওয়া করতে বেশী ভালো লাগে। কিছুক্ষন অন্ততঃ ভাববার সময় পাওয়া যায়।

“Everybody needs a place to think.”

বাসে চড়ার সময় আর হন হন করে হাঁটার সময় কতো কি ভাবি। ওটা আমার ভাবন সময়। কি যেন বলছিলাম, ওহ্ আমার কাজ। অন্য যে কোন কাজের চেয়ে আলাদা। ছয়দিন কাজ, চারদিন বন্ধ। আবার ছয়দিন কাজ, আবার চারদিন বন্ধ, এভাবে। মাসে আঠারো দিন কাজ, বারদিন বন্ধ। শেষ দুই দিন নাইট শিফট্। ষষ্ঠ দিন কাজ শেষে সকাল সাতটায় বাড়ি ফেরার পথে মনে একটা চানরাইত টাইপ আমেজ থাকে। বোস্ এর ওভার-দ্য-ইয়ার হেডফোন পরে গান শুনতে শুনতে হাঁটা ধরি। তখন মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় পুরো পথটা হেঁটে চলে যাই। হাঁটতে আমার ভালো লাগে।

আজকালকার হেডফোনগুলোতে সাইলেন্সার লাগানো থাকে, নয়েস ক্যান্সেলেশান এক্টিভেট করে দিলে বাইরের দুনিয়ার কড়কড়া-মড়মড়া সব শব্দ বাতিল। বিশাল জনারণ্যে, শহুরে কোলাহলের মাঝে অদ্ভুত প্রাইভেসি এনজয় করা যায়। ডুবে যাই ভাবনার সাগরে। ভাবনা লজ্জ্বাহীন।

সেদিনও হন হন করে ফিরছিলাম বাসায়। একই বাস থেকে নামা, একই লোকাল পথ, পথের একপাশে গাছ, একই ফুটপাথ, দুধারে সারি সারি বাড়ি, আবার খেলার মাঠ, আবার সারি সারি বাড়ি। কিন্তু আজকের পথ এমন কেন? ভালো করে চারপাশ দেখার আগেই আমাকে থামালো এক লোক। ডান হাত তুলে, যেন গাড়ী থামাচ্ছে। কি যেন বলছে, কিছু শুনছিনা, সাইলেন্সার লাগানো হেডফোন কানে। প্রফেশনাল অভ্যেস, মুহুর্তে ডেসক্রিপশন রেকর্ড করে ফেললাম মনে মনে। শ্বেতাঙ্গ, পুরুষ, উচ্চতা পাঁচ ফুট এগারো, বয়স চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে, বল্ড হেড মানে বেল মাথা। গোলগাল মুখ, ক্লিন শেভড্, কালো মেটাল ফ্রেমের চশমা, স্ফটিক স্বচ্ছ কাঁচ, চশমার পেছনে নীল মার্বেল চোখ। মুখটা একদম শিশুর মতন। কালো টি-শার্ট, বুকে বড় রূপোলী ‘সুপারড্রাই’ লোগো, ব্লু জিনস্, সাদা ট্রেইনার্স। আরে! ডেসক্রিপশন নিচ্ছি কেন? আমি কি এখন ডিউটিতে নাকি? হেডফোনের পাওয়ার অফ করে দিলাম, ওর কথা এবার শুনতে পাচ্ছি,

“আমরা ট্যুরিষ্ট, আমাদের বাস ব্রেক ডাউন করেছে, এখানকার কিছুই চিনিনা, তুমি কি স্থানীয়? আমাদের সাহায্য করবে প্লীজ?” শ্বেতাঙ্গ লোকটি আমাকে জিজ্ঞেস করলো। যে এলাকায় আছি সেখানে আমরাই স্থানীয়, সাদারা হচ্ছে ফরেনার। চারদিকে তাকালাম। একি, আমি এখানে কি করছি? এটাতো ম্যানসফোর্ড স্ট্রিট, ওল্ড বেথনাল গ্রীন রোড আর হ্যাকনী রোডের সংযোগকারি পথ। অথচ আমার থাকার কথা ব্লেয়ার স্ট্রিটে, ক্যানিং টাউনের কাছে।

“তুমি কি আমাদেরকে লোকাল ট্রেন ষ্টেশনটা দেখিয়ে দেবে?” উত্তর দিকে হ্যাকনী রোড, পেছনে ওল্ড বেথনাল গ্রীন রোড। বললাম,

“সোজা গিয়ে ডানে মোড় নাও, একটু এগিয়ে গেলে ওভারগ্রাউন্ড ষ্টেশান দেখবে, ওটা ক্যামব্রীজ-হীথ্ ষ্টেশান, ওকে?”

“আমাদের বাকী সবাই ওই হোটেলের লবিতে, ওয়েট করছে। তুমি কি আমার সাথে একটু আসবে? সবাইকে নিয়ে যাবো ষ্টেশানে, আমাদের পথটা দেখিয়ে দেবে প্লীজ?”

গভীরভাবে অনুনয় করছে, হঠাৎ মনে হল লোকটা ছোট হয়ে যাচ্ছে। ছোট হতে হতে আমার আড়াই বছরের ছেলে হয়ে গেছে। ব্লু জিনস্, সাদা ট্রেইনার্স, কালো টি-শার্ট, শুধু বুকে কোনো লোগো নেই। আমার ছেলের চোখ তো নীল না! ম্যানসফোর্ড স্ট্রীট থেকে উত্তর দিকে ওর পেছন পেছন যাচ্ছি শেলডন প্লেইস ধরে। লোকটা তার ফুল সাইজ ফিরে পেয়েছে, উচ্চতা পাঁচ ফুট এগারো। একটু এগিয়ে ক্যানরবার্ট স্ট্রীট আর টীজডেইল স্ট্রীটের কোনায় বিশাল এক আবাসিক হোটেল। আজ কি হচ্ছে এসব? লন্ডনের E2 এলাকায় শেলডন প্লেস, টীজডেইল স্ট্রীট, ক্যানরবার্ট স্ট্রীট এগুলো সব এঁদো গলি। এখানে এত উঁচু আর বড় আবাসিক হোটেল, তা-ও প্রায় ফোর স্টার ক্যাটাগরি? ম্যাজিক-সারপ্রাইজ? অসম্ভব!

ভেতের ঢুকে দেখি বিশাল রিসিপশন এরিয়ায় এখানে ওখানে ছড়িয়ে বসে আছে বিশ-পঁচিশজন মধ্য বয়সী নারী পুরুষ। সবার সাথে লাগেজ। ক্লান্ত সবাই। আমাকে যে নিয়ে এসেছে সে জনে জনে তার সাথীদের জানাচ্ছে আমাকে অনুসরন করার জন্য। ওভারগ্রাউন্ড ট্রেইন ষ্টেশানে যাবে। ষ্টেশানের নাম ক্যামব্রীজ-হীথ্। হ্যাকনী রোডের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে হবে। একজন ব্লন্ড নারীকে দেখলাম, শেতাঙ্গ। বয়স পঞ্চাশ থেকে ষাটের মধ্যে। মুখটা খুব সুন্দর, তার উপর রেশমী ব্লন্ড চুলে আরো আকর্ষণীয় লাগছে। আমি চেয়ে আছি বৃদ্ধার দিকে। যত দেখি, তত ভালো লাগে। যত ভালো লাগে, তত বয়স কমে। ষাট থেকে পঞ্চাশ, পঞ্চাশ থেকে চল্লিশ, তিরিশ. . . উফফ্ ওই নারী আমায় টানছে। হচ্ছে কি এসব? – গায়ে সাদা রংয়ের গাউন জড়ানো, মেডিকেল কলেজ স্ট্যুডেন্টদের মত। গাউনটা টাইট হয়ে লেগে আছে তার গায়ে। আরেক কলিগ তাকে রিকোয়েস্ট করছে আরো কিছুক্ষন থাকার জন্য, তাদের সাহায্য লাগবে। কিন্তু তিনি মহা বিরক্ত। দীর্ঘ নাইট শিফট শেষ করে ওভারটাইম করার ইচ্ছে তার নেই, নো চন্স। সে বাড়ী যেতে চায়।

বের হয়ে যাবার পথে আমার সামনে থমকে দাড়ালো। তারপর কমান্ডের ভঙ্গিতে আমাকে বললো, “স্টপ! আই এ্যাম ডিটেইনিং ইউ।” বলে আমার বাঁ হাতের কব্জি ধরে বিশেষ একটা ট্যাকটিক এ্যাপ্লাই করে আমার পাশে এমনভাবে দাঁড়ালো, যেভাবে পুলিশরা দাঁড়ায়। কিন্তু আমার গায়ের সাথে এমনভাবে সেঁটে দাঁড়িয়েছে, আমার ভালো লাগছে। কিন্তু আমার তো ভালো লাগার কথা নয়? আমাকে ডিটেইন, মানে আটক করার ও কে? বললাম,

“তুমি আমাকে টাচ্ করেছ, এটা এ্যাসাল্ট। (মিথ্যে কথা, আমার খুউব ভালো লাগছে) শক্ত করে হাত ধরে আটকে রেখেছো, ব্যাথা পাচ্ছি, এটা সেকশান-থ্রী পাবলিক অর্ডার অফেন্স। ফোর্স এ্যাপ্লাই করার পাওয়ার কে দিয়েছে তোমাকে?” আমি চ্যালেঞ্জ করলাম, যদিও নড়তে পারছিলামনা, বজ্র আঁটুনি। আবার গায়ের সাথে গা লাগাতে ভালোও লাগছে। মন বলছে ধরের রাখো অনন্তকাল। কি সুন্দর রেশমী ব্লন্ড চুল, ওখানে গাল ডলতে, ওর কাঁধে মাথা রাখতে ইচ্ছে করছে। ছি ছি, পঞ্চাশোর্ধ মহিলা আর আমি কিনা…।

“সেকশন থ্রী। ঠিক বলেছ, তবে পাবলিক অর্ডার নয, তোমাকে ডিটেইন করেছি সেকশান থ্রী কমোন ল’ মোতাবেক,” মহিলা জবাব দিলো। সুপ্রাচীন এই আইনে যে কোন নাগরিক কোন অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে বা হতে যাচ্ছে দেখলে সেখানে নির্দিষ্ট মাত্রায় বল প্রয়োগ করতে পারে (reasonable force), পুলিশে সেপর্দ করার আগ পর্যন্ত।

“কোন গ্রাউন্ডে তুমি আমাকে ডিটেইন করেছ?”

“থেফট্, শপলিফ্টিং।” মহিলার রোবটিক জবাব। আমি দাঁড়িয়ে হোটেলের লবিতে, শপলিফ্টিং কিভাবে করবো? এটা কি দোকান যে কিছু একটা তুলে নিয়ে পেমেন্ট না করে চলে যাচ্ছিলাম? হচ্ছে কি এসব? আমি কিছু বলার আগেই মহিলা আমার বুকের উপর হাত রাখলো, আমার কেমন কেমন লাগছে। এই ‘কেমন কেমন’ লাগা অতি গোপনীয়, কাউকে বলা যায় না। বুড়ো হাবড়া যখন কোন যুবতীর প্রতি ছোঁক ছোঁক করে তাকে পার্ভার্ট বলে। আমার হচ্ছে উল্টোটা, আমাকে কি বলে ডাকা উচিত? *জেরান্টোফিলিয়ায় আক্রান্ত? *(https://www.merriam-webster.com/medical/gerontophilia | *Gerontophilia:  sexual attraction to the elderly)

“তুমি আমাদের ইউনিফর্ম চুরি করেছ।” মহিলা এবার বুক থেকে হাত সরালো। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিনা, আমার গায়ে একই রকম সাদা গাউন যেটা মহিলা পরে আছে। বোতাম নেই, ভেলক্রো লাগানো। আমি চোর? কিভাবে চুরি করলাম? মনের ভেতর ঝড় বইছে, কিছুতেই মনে করতে পারছিনা কখন আমি এই গাউন পরলাম, কোথায় পেলাম এটা? পুলিশের সাইরেনের শব্দ শোনা যাচ্ছে অথচ একটা পুলিশ মিনিবাস ঠিক হোটেলের সামনের গাড়ী বারান্দায় দাঁড়িয়ে। ওটার ব্লু-লাইটস্ ফ্লাশ করছে আর নিভছে। কিন্তু শব্দ মনে হচ্ছে অনেক দুর থেকে আসছে, কেন? আসার কথা পুলিশ কার, দুজন অফিসার। মিনিবাসে অন্ততঃ বারোজন অফিসার থাকার কথা, এসেছে মাত্র তিনজন। বাকীরা কোথায়? বয়স্ক মহিলা পুলিশ আসার সাথে সাথে আমাকে ছেড়ে দিলো, ছেড়ে দেয়ায় একটু মন খারাপ হল। তাঁর উষ্ণতার রেশ আমরা গায়ে এখনো রয়ে গেছে। কাছে এসে দুহাতে গাল ধরে নরম করে ডলে দিলো। বললো, “তাড়াতাড়ি বাড়ি এসো।” বলে গট গট করে চলে গেলো। বাড়ি এসো মানে? কার বাড়ি, কেন বাড়ি, কোথায়?

আমি একটা সোফায় বসে আছি, হেলান দিয়ে বেশ আরাম করে বসে আছি। পুলিশগুলোও অন্য সোফাগুলোতে এখানে ওখানে বসে আছে। নিজেদর মধ্যে কথা বলছে আর হাসছে। আমাকে কেউ এ্যারেষ্ট করেনি এখনও, কারো গরজ নেই। কেউ জানতেও চাচ্ছেনা আমি কি করেছি। সাদা গাউন চুরির অপরাধে আমাকে এ্যারেষ্ট করে, গাউন জব্দ করে এভিডেন্স ব্যাগে ভরার কথা। স্টাফদের কাছ থেকে স্টেটমেন্ট নিয়ে সিসিটিভি ফুটেজ রেকর্ড করে, কন্ট্রোলকে রেডিওতে ডেকে কাষ্টডিতে একটা সেল-স্পেইস এর জন্য রিকোয়েস্ট করবে। আমি কেমন আসামী, আমার তরফ থেকে কোন প্রকার রিস্ক আছে কিনা সেটা এ্যাসেস করবে। সবার আগে আমার নাম, জন্ম তারিখ, ঠিকানা ইত্যাদি নিয়ে পুলিশ ন্যাশনাল কম্পিউটারে চেক করার কথা, আমার অতীত কোন অপরাধ আছে কিনা সেটা দেখবে। কিন্তু না, আমার দিকে কেউ তাকাচ্ছেনা। পাত্তাই দিচ্ছেনা, যেন আমি সেখানে নেই। সবকিছু দুর্বোধ্য ঠেকছে। কাউকে চিনতে পারছিনা, এটাও কেমন জানি অস্বাভাবিক। ওদের সবাইকে তো আমার চেনার কথা, ওরাও আমাকে। পকেটের উপর হাত দিয়ে ওয়ারেন্ট কার্ড টা আছে নিশ্চিত হয়ে নিলাম। পরিচয় দেবো? না থাক, দেখিনা কি হয়? শপ লিফ্টিংয়ের অপরাধে ওরা কি আমাকে এ্যারেষ্ট করে কাষ্টডিতে নিয়ে যাবে? কাষ্টডি সার্জেন্ট আমাকে দেখে হা হয়ে যাবে। এমনও হতে পারে কাষ্টডি সার্জেন্টও আমাকে চিনবেনা, আমাকে দেখে তার প্রফেশনাল দায়িত্ব সুঁচারু রূপে পালন করে যাবে,

“মিষ্টার ছাউদুড়ি (Chowdhury), আপনি কি জানেন কেন আপনি এ্যারেস্ট হয়েছেন?” আমি বলবো, “হ্যাঁ আমি জানি আমি কেন এ্যারেষ্ট হয়েছি।” সার্জেন্ট বলবে, “থ্যাংক ইউ। আমি এখন এ্যারেষ্টিং অফিসারের সাথে কিছু কথা বলবো। ততক্ষন, প্লীজ বেয়ার উইথ আস্।” – – এরপর কাষ্টডি সার্জেন্ট এ্যারেস্টিং অফিসারকে একে একে প্রশ্ন করে যাবে, আর জবাব কম্পিউটারে লোড করবে,

প্রঃ “টাইম অফ এ্যারেষ্ট?”

উঃ “জিরো সেভেন ফাইভ জিরো আওয়ারস্, সার্জ (সার্জেন্ট)।”

প্রঃ “টাইম অফ এ্যারাইভাল?”

উঃ “জিরো এইট থ্রী জিরো আওয়ারস্, সার্জ।”

প্রঃ “ডিড ইউ কাফ্ হিম অফিসার?”

উঃ “নো সার্জ।”

প্রঃ “হোয়াই নট?”

উঃ “নো রিস্ক, হি ওয়াজ কম্প্লাইয়েন্ট, সার্জ।” প্রসংশার চোখে অফিসারের দিকে তাকাবে সার্জেন্ট। হ্যান্ডকাফ না পরানো এক রকম ভালো যোগ্যতা। বেটার কাস্টমার সার্ভিস। প্রতিটি আসামী একেকজন কাস্টমার। কাস্টমারদের সুখ পুলিশের সুখ।

প্রঃ “টেল মি এ্যাবাউট দ্য সারকামসট্যান্সেস হোয়াইল ইউ ওয়্যার এ্যারেষ্টিং হিম?”

উঃ “হোটেলের একজন স্টাফ মেম্বার তাকে ডিটেইন করে। এ্যালেগেশান, সে এই জামাটি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো। (এভিডেন্স ব্যাগে ভরা সাদা গাউনটি সার্জেন্টকে দেখাবে) সেজন্য তাকে চুরির দায়ে গ্রেফতার করেছি, সার্জ।” – – অফিসারের দিকে সরু চোখে তাকাবে কাস্টডি সার্জেন্ট,

প্রঃ “থেফট্? কোন সেকশান?”

উঃ “সেকশান-ওয়ান-ব্র্যাকেট-ওয়ান থেফট্ এ্যাক্ট নাইনটিন সিক্সটি-এইট, সার্জ।”

প্রঃ “ডেফিনিশন বলো অফিসার।”

উঃ “একজন ব্যাক্তি চুরির অপরাধে অপরাধী; যদি সে ‘অসৎভাবে’ এবং ‘উদ্দেশ্যমূলকভাবে’ ‘কারো মালিকানাধীন’ ‘প্রপার্টি আত্মসাৎ’ করে ‘স্থায়ীভাবে নিজের দখলে নিয়ে অপরকে বঞ্চিত’ করে। সার্জ”

প্রঃ “এক্ষেত্রে পাঁচটা পয়েন্ট প্রুভ করতে হবে অফিসার, একটা পয়েন্টও যদি বাদ পড়ে থেফট্ কম্প্লিট হবেনা। সেগুলো কি কি?”

উঃ “উমম.. ‘অসৎভাবে,’ ‘আত্মসাৎ,’ ‘প্রপার্টি,’ ‘কারো মালিকানাধীন’ এবং ‘স্থায়ীভাবে নিজের দখলে নিয়ে অন্যকে বঞ্চিত করা।’ সার্জ!” অফিসারের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা যাবে, আর সার্জেন্টের মুখে বিদ্রুপের হাসি।

প্রঃ “অফিসার, থেফট্ কি কম্প্লিট হয়েছে?”

উঃ “ন-ন-ন-না সার্জ”

প্রঃ “রিল্যাক্স অফিসার, বুঝিয়ে বলো আমাকে।” সার্জেন্টের মুখের হাসি এখন আর বিদ্রুপের নয়, স্নেহের। উঃ “সার্জ, তাকে এই গাউন পরা অবস্থায় ডিটেইন করে আমাদের হাতে তুলে দেয়া হয়। সে একবারের জন্যেও বলেনি এটা তার, কিংবা এই গাউন সে বাড়ি নিয়ে যেতে চায়। সে প্রেমিসেস থেকে বের হয়ে যায় নি বা আমাদের সামনে থেকে পালানোর কোন এ্যাটেম্পটও নেয় নি। থেফট্ হ্যাজ নট বিন কম্প্লিটেড।”

প্রঃ “এর অর্থ কি দাঁড়ালো অফিসার?”

উঃ “ইললিগ্যাল এ্যারেষ্ট, সার্জ।”

প্রঃ “মিনিং?” উঃ “ইললিগ্যাল এ্যারেষ্ট সার্জ। আই এ্যাম ইন ট্রাবল।”

—এগুলো সব আমার অনুর্বর মস্তিষ্কের ফ্যান্টাসী, ডে-ড্রিমস। আসল কথা হল কাষ্টডি সার্জেন্ট আমাকে এ্যাকসেপ্ট করবেনা। লো লেভেল ক্রাইম, সাদা জামা চুরি। এর দাম পঞ্চাশ পাউন্ডও না। এই মামলা কোর্টে গেলে ম্যাজিষ্ট্রেট পুলিশকে প্যাঁদাবে। কোর্টের মূল্যবান সময় নষ্ট করার জন্য এ্যারেষ্টিং অফিসারকে ভৎসনা করবে। বাদী পক্ষের কাউকে দেখতে পাচ্ছিনা। কাউকে না কাউকে তো স্টেটমেন্ট দিতে হবে, সিসিটিভি ফুটেজের কি হবে। সবচেয়ে বড় কথা এই হোটেলের নাম কি? আমি আসলে কোথায়? পুলিশগুলো এখনও আমার দিকে তাকাচ্ছেনা, কিছু বলছেওনা। নিজেদের মধ্যে আড্ডা দিচ্ছে। একজনের হাতে দেখি দুই কাপ কফি। আমার দিকে এক কাপ এগিয়ে দিলো,

“কফি খাবে, মেইট?”

“থ্যাংকস।” কফি আমি খাই না, গন্ধটা মন মাতানো, খেতে কুৎসিত। আমি আজন্ম চা-খোর।

“তোমরা সবাই কি করছো এখানে?” আমাকে এ্যারেষ্ট করতে দেরী করছে কেন সেটা নিয়ে কিছু বললাম না।

“আমরা ব্রেক নিচ্ছি, উই আর হ্যাভিং এ ব্রেক!” এই বলে ওরা তিনজন একে অন্যের দিকে তাকালো, তারপর হো হো হো করে একসাথে হেসে উঠলো। এ্যারেষ্ট করতে এসে ব্রেক?

“তোমাদের ব্রেক শুরু হল কখন?”

“আমাদের শিফট্ যখন শুরু হয় তখন থেকে আমাদের ব্রেক শুরু হয়। শিফট্ শেষ হলে ব্রেকও শেষ! হা হা হা…”

হোটেলের রিসিপশান বড়, উঁচু ছাদ। ওদের হাসির শব্দ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে আসছে চারদিক থেকে। হঠাৎ মনে হল আমি পুরোনো কোন কাসলের ভেতরে আছি। সবকিছু কেমন যেন, রহস্যময়। স্বপ্নীল। হোটেলের সদর দরজার সামনে সকালে দেখা সেই লোকটিকে দেখলাম, আমার দিকে এগিয়ে আসছে। বেল মাথা, চেখে চশমা, কালো টি-শার্ট, বুকে বড় রূপোলী ‘সুপারড্রাই’ লোগো। হাঁটছে বাচ্চাদের মত। এরমধ্যে চারপাশ কেমন উজ্জ্বল হয়ে আসছে। দিনের বেলা হলেও হোটেলের ভেতরে ফ্লোরোসেন্ট আর ঝাড়বাতির মিষ্টি আলো জ্বলছিলো। কিন্তু এখন চারপাশটা কেমন যেন বেশী উজ্জ্বল, গ্রীষ্মের সকালের সূর্য্যের কড়া রোদের মত। লোকটি এগিয়ে আসছে আর ক্রমে ছোট হয়ে যাচ্ছে। ছোট হতে হতে একদম ছোট বাচ্চা ছেলে হয়ে গেলো। সে যখন আমার হাত ধরলো তখন দেখি ওর চোখে চশমা নেই, বেল মাথা নয় মাথায় কালো চুল তবে ছোট করে ছাঁটা। মুখটা খুব আপন, অনেক বেশী পরিচিত। আমি তখন সোফায় চিৎ হয়ে আরাম করে শোয়া, সবকিছু কেমন যেন। ঢুলু ঢুলু, ঘুম ঘুম। ঘাড় ঘুরিয়ে আবার আশপাশটা দেখলাম। অনেক আলো, উজ্জ্বল। পুলিশ অফিসারগুলো রিল্যাক্স করছে, আমার কাছাকাছি যে আছে সে মোবাইলে গেইম খেলছে।

বাচ্চা ছেলেটা যখন একেবারে আমার মুখের সামনে, চারপাশে তখন অনেক আলো, চোখ ধাঁধানো সূর্য্যের আলো। মুখে হঠাৎ ফ্রেশ ঠান্ডা বাতাসের ছটা লাগলো, হাইওয়েতে গাড়ি চলার সাঁই সাঁই শব্দও কানে আসছে। “লেটস্ গো বাবা! লেটস্ গো! ওয়েক আপ!!” – ও আমাকে বাবা ডাকছে কেন? একি! এ তো আমার ছেলে? আমার ছেলে এখানে কেন?

* * * * * * * *

আমার আড়াই বছর বয়সী ছেলে আমার ডান হাত ধরে টানছে। রাতে স্টাডি রুমের বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকাল বেলা এসে ওদের মা এসে জানালার ব্লাইন্ড একদম উপরে তুলে দিয়ে জানালাও খুলে দিয়েছে। সকালের বাতাস আর কড়া রোদ সারা ঘরময়। বাইরে থেকে গাড়ীর শব্দ আসছে, হঠাৎ হঠাৎ হাইওয়ের ওপাশের নদী থেকে আসছে বোট কিংবা লঞ্চের হুইসেলের শব্দ। ছেলে আর মেয়ে যথারীতি বিছানার উপর উঠে লাফালাফি শুরু করে দিয়েছে। গাঁজাখোরি স্বপ্নের শেষে সুন্দর, মিষ্টি এক সকালের শুরু।

* * * * * * * *

আফলাতুন হায়দার চৌধুরী (সাগর চৌধুরী) ২৩ অক্টোবর ২০১৮

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Post comment