শ্যামলা রংয়ের মেয়েটি
‘‘কলকাতা গিয়েছিলুম দুমাসের একটা মেরীন শর্টকোর্স করার জন্যে।
প্রথম দিনেই চোখ মেরে দিয়েছি একজনকে। প্রেম হয়ে গেছে, প্রেএএম।! উত্তরাধিকারসূত্রে পেলুম প্রেমিকা।
কি, হিংসে হয়? *হিইইইংসে হয়? আমার মত হতে চাও?’’
বাংলাদেশ থেকে বাসে চেপে আমরা তিন বন্ধু মিলে বৃষ্টিভেজা দুপুরে কলকাতার সেন্ট্রালের একটা হোটেলে উঠে নাওয়া খাওয়া সেরে পরদিন ভোরে ট্যাক্সি ক্যাব চেপে সোজা গড়িয়ায়। উরিব্বাপশ্ এত্তোদুর! রাস্তা ফাঁকা থাকলে চল্লিশ মিনিটের বেশী লাগেনা কিন্তু রাশ আওয়ারে এক থেকে দেড় ঘন্টা লেগে যায়। গড়িয়ার এই বিশেষ কলেজে পৌঁছে প্রয়োজনীয় ফরমালিটি শেষ করতে করতে প্রায় দুপুর। যদিও এখানে সমুদ্রগামী জাহাজের অফিসারদের স্যাটেলাইট কমিউনিকেশনের উপর ট্রেনিং দেওয়া এবং পরীক্ষা নেওয়া হয়, তবে পুরো বিল্ডিং বাকি দশটা অফিসের মতো। দোতলা। নীচতলায় রিসিপশান, ক্লাশরুম ইত্যাদি। উপর তলায়ও ক্লাশরুম, প্র্যাক্টিক্যাল ইকুইপমেন্ট রুম, ডায়নিং রুম। লাঞ্চ আর সারাদিন চা বিস্কুট মুফতে, অর্থাৎ ফ্রী। আমার ক্লাসে টোটাল স্ট্যূডেন্টস্ এগার জন। এরমধ্যে বাংলাদেশের আরেকজন ছাত্র পেলাম, সব মিলে এখন কলেজে আমরা চারজন বাংলাদেশী। কতৃপক্ষ একজন পদস্থ কর্মকর্তার মাধ্যমে আমাদের জন্য ট্যাক্সী ডাকালেন এবং তাঁকে আমাদের থাকার যায়গায় পৌঁছে সব বুঝিয়ে দিয়ে আসতে বললেন। তিনি আমাদের যেভাবে সব বুঝিয়ে দিলেন তাতে বুঝলাম আমরা মোটামুটি ভিআইপি।
সাউথ ক্যালকাটার পশ্ এলাকা গড়িয়ার বাঘাযতীন শ্রী-কলনীতে ছোট্ট তিনতলা একটা বাড়ী। কর্নার হাউস। ডিটাচড্। দোতলার পুরোটাই আমাদের জন্য বরাদ্দ। আমার রুম রাস্তার দিকের টা। সবদিকে জানালা, খোলামেলা, পর্দা সরালে হুহু বাতাস আর আলো খেলা করে। সাথে লম্বা একটা বারান্দাও আছে। খুব পছন্দ হয়ে গেলো। বাড়ী ভাড়ার সাথে প্রতিদিন একজন ক্লিনার এবং একজন রান্নার ঠাকুর ফ্রী। ক্লিনার প্রতিদিন সকালে সবার বিছানা চাদর আর, বালিশের কভার ইত্যাদি পাল্টে নতুন লাগিয়ে সারা ঘর, রান্নাঘর, বারান্দা আর বাথরুম পরিষ্কার করে এয়ার ফ্রেশনার দিয়ে যায়। রান্নার ঠাকুরকে টাকা দিয়ে দিই সে বাজার করে আমরা যেভাবে চাই সেভাবে সব রেঁধে দেয়। খেতেও বেশ। শুধু গোমাংসের কথা বলা যাবেনা। ঠাকুর ওসব ছোঁয়ও না।
ক্লিনারকে খুব একটা দেখা যায় না কারন তাকে ভোরে আসতে বারণ করেছি। ব্যাচেলরদের প্রাইভেসি নষ্ট। আমরা কলেজে যাবার পর এসে সে তার কাজ করে দিয়ে চলে যায়। কিছু চুরি যাবেনা, এই গ্যারান্টি কলেজের। রান্নার ঠাকুরকে সারাদিন পাওয়া যায়, সন্ধ্যার পর চলে যায়। ওর নাম দুঃশাসন, আমরা ওকে ওই নামে ডাকিনা। ‘ঠাকুর’ বলে ডাকি। আমি যখন খুব রাজসিক ঢংয়ে ডাকি, ‘ঠাকুউউউউর!’ এক দৌড়ে এসেই দাঁত বের করে হেসে বলে, “আজ্ঞে, বলো!” উপরের পাটিতে চারটে, আর নীচের পাটিতে চারটে দাঁত নেই। হাসলে জিভ, পাশের দাঁত আর কালচে-ধুসর মাড়ি দেখা যায়। দেখতে এতো মায়া লাগে! মনেই হয় না বয়স পঞ্চান্ন। বেঁটে খাটো, অনেকগুলো কাঁচাপাকা চুল। গোঁফ আছে ঝাঁকড়া, কাঁচাপাকা।
আমাদের বাড়িটার ঠিক নিচেই রাস্তার একপাশে একটা চাপাকল, কংক্রীট ঢালাই করে সুন্দর ঘাটের মত করে রাখা। এটা এই এলাকার খাবার জলের জন্য। সব বাড়িতে সাপ্লাই পানি থাকলেও খাবার জল আর পূজোর জন্য বিশুদ্ধ জল বলতে ওই চাপাকল। প্রতিদিন সকালবেলায় সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে একে একে জল নিয়ে যায়। দুঃশাসন ঠাকুরকে বললাম এই বিষয়ে চিন্তা না করতে। আমরা পাঁচ লিটার বা দশ লিটার ওজনের অনেকগুলো খাবার জলের ডিব্বা নিয়ে আসবো। দুঃশাসন খুশী হয়, আবার দুশ্চিন্তায়ও পড়ে। বাংলাদেশের মানুষ এত্তো অপচয় করতে পারে? নাকের ডাগায় ফিরিতে (ফ্রী তে) জল, আর এরা কিনা পেলাস্টিকের ডিব্বা ভর্তি জল কিনবে?
আমরা আসার আগে যে গ্রুপ এখানে থাকতো তারা চলে গেছে, রয়ে গেছে নর্থ ইন্ডিয়ান একটা ছেলে। ট্রেনের রিজার্ভেশন পায় নি তাই যাবে আজ রাতে। আমার প্রথম নাম ‘আফলাতুন’ শুনে অনেক হাসলো কারন আফলাতুন মানে পাজি। তারপর আমাদের মধ্যে দ্রুত বন্ধুত্ব হয়ে গেল। ও মারাঠি, হিন্দী এবং উর্দুতে ফ্লুয়েন্ট সে। আমার কাছে হিন্দি, উর্দু সব এক ভাষা। তারচেয়েও বড় কথা আমি ফেণীর ছেলে, আমার মাতৃভাষার সাথে ‘হায়’ লাগিয়ে দিলেই হিন্দী বা উর্দু ভাষা হয়ে যায়, তাই ওর সাথে কথা বলতে কোন সমস্যা হচ্ছিলোনা। ছেলেটার নাম আলতাফ, যদিও সে হিন্দু। আড্ডা ভালোই জমে উঠেছে, আমার গার্লফ্রেন্ড নেই বা কখনো প্রেম-ভালোবাসা করিনি শুনে আমার দিকে এমন ভাবে তাকালো যেন ফকির-মিসকিন দেখছে। নাটক-সিনেমায় অনেক পয়সাওয়ালারা যেরকম পকেট থেকে টাকার তোড়া বের করে গরীবদের মধ্যে বিলিয়ে দেয় অনেকটা সেই ভঙ্গিতে আলতাফ আমাকে বললো,
“ইয়ার আফলাতুউউউন, তু মেরা আচ্ছা দোস্ত হ্যায়, তু মেরা গার্লফ্রেন্ড কো লে লে।” (বঙ্গানুবাদ:- তুমি আমার ভালো বন্ধু, আমার গার্লফ্রেন্ডকে তুমি নিয়ে নাও)
আমি ভাবছিলাম পোলার মাথায় ছিট আছে কিনা। হতভম্ব ভাব কাটিয়ে ওঠার আগেই সে আমাকে যুক্তি দিয়ে বোঝালো যেহেতু সে উত্তরে ফিরে যাচ্ছে এবং আর কখনো বাংলায় আসবেনা সেহেতু ওই মেয়ে আমার গার্লফ্রেন্ড হতেই পারে।
“আমি যেহেতু চলে যাচ্ছি ওই মেয়ে এরকম আরেকটা শর্ট কোর্স করতে আসা ছেলের সাথে প্রেম করবে। সেটা নাহয় তুমি হলে আফলাতুন। তুমিও যাবার আগে আবার কারো হাওলা করে দেবে।” একটু দম নিয়ে আবার বলে, “তাছাড়া, আমিও ওকে এভাবেই পেয়েছি?”
“মানে?” আরেকবার আকাশ থেকে পড়লাম।
“আগের স্টুডেন্ট কোর্স শেষ করে চলে যাবার আগে আমাকে হাওলা করে দিয়ে গেছে।” এবার আমার মাথা ঘুরছে। আলতাফ হঠাৎ তাড়াহুড়ো শ্যূরু করে দিলো।
“লিসেন আফলাতুন, মা’লা ওই জানালার সামনে আসবে, আমি সরে দাঁড়াবো। দোস্ত, তু উসকো আঁখ মার-দেনা। ওকে?”
দোতলার জানালার পর্দা সরিয়ে অদ্ভুতভাবে শীষ দিয়ে এক ধাক্কায় আমাকে বারান্দায় ঠেলে দিলো তারপর চট করে আড়ালে চলে গেলো। আমি বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে আছি। কিংকর্তব্যবিমুঢ়। একটু পর শ্যামলা রংয়ের মেয়েটা এলো। মুখোমুখি বিল্ডং, বেশী দুরে নয়। আমার দিকে না তাকিয়ে জানালার দিকে দেখছে, বোঝা যায় আলতাফকে খুজছে। ব্যাটা আলতাফ রুমের ভেতর সবগুলো জানালার পর্দা টেনে ভেতরে লুকিয়ে আছে মেয়েটা যাতে তাকে দেখতে না পায়। হাল্কা, মাঝারি স্বাস্থের মেয়েটার গোলগাল মুখখানা বড় মিষ্টি। গাঢ় খয়েরী রংয়ের একটা ফ্রকের মত ড্রেস, প্রায় হাঁটু পর্যন্ত। গভীর কালো চুলের সামনের অংশ গলা পর্যন্ত, বাকী অংশ একদম কোমরে গিয়ে ঠেকেছে। হারামী নর্থ ইন্ডিয়ান আড়াল থেকে নীচু গলায় আমাকে বলেই যাচ্ছে,
“আফলাতুউউউন আঁখ মার! আঁখ মার চূতিয়া! আঁখ মার!! আবে ও? আঁখ মার না স্সালা!!!” এ ও কি সম্ভব? কাঁধ ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে একটা ভঙ্গি করলাম যার মানে হচ্ছে,
“আঁখ মারবো? আমি?? আর ইউ ম্যাড??” এবার ও দুহাত জোড় করে হাঁটুর উপর বসে পড়লো,
চিপিয়ে চিপিয়ে, প্রায় ফিশফিশিয়ে মিনতি করে বললো, “এক বার আঁখ মার দে মেরা বাপ!”
আমি ঝট করে ঘুরে মেয়েটার দিকে তাকালাম, বোধ হয় সেকারনে মেয়েটিও আমার দিকে তাকালো। চোখে চোখ পড়তেই দিলাম চোখ টিপে। যা হবার হোক, হয়তো পুলিশ ডাকবে! দেখি না কি হয়? আমাকে শতভাগ বিস্মিত করে মুখটাতে রহস্যময় একটা ভাব এনে, খুব ম্মার্টলি মেয়েটা আমাকে চোখ মেরে দিলো। যেন ক্যামেরা ক্লিক্। তারপর সাঁই করে হিন্দি সিনেমার নায়িকাদের মত উল্টো ঘুরলো। সেই সাথে খয়েরী রংয়ের জামা টা একবার ফুলে উঠে আবার গায়ের উপর বসে গেলো। তারপর ক্যাটওয়াক স্টাইলে হেঁটে ভেতরে চলে গেলো। আমার সারা গা কাঁপছে। মাথা রিমঝিম করছে। জীবনে প্রথম কোন নারীকে চোখ মারলাম। তা ও বিদেশে। ওয়ালাইকুম চোখমারাও পেলাম।
“মেরা কাম হো গিয়া। কনগ্র্যাচ্যূলেশানস্! মা’লা তেরা হো গ্যায়া ইয়ার। উসকা খেয়াল রাখনা ওকে? বহুত আচ্ছা লাড়কী হ্যায় ও।” এ্যারেঞ্জেড ম্যারেজের মতো আলতাফ আমার প্রেম এ্যারেঞ্জ করেছে। যাই হোক, আমারও কিছু প্রশ্ন থাকতে পারে। মাতৃভাষার সাথে ‘হ্যায়’ লাগিয়ে আবার শুরু করলাম,
“হিতি কা নাম মালা, তুই কেন্নে জানছ হ্যায়?”
“মা লা উছকা শর্ট নেইম। পুরা নাম ওরমী মা’লা রাই চোউধ্-রী।”
হিন্দীতে টেনে টেনে কিভাবে সুন্দর নামটার ‘পি’ মেরে দিলো। বিরক্ত হয়ে বললাম,
“উচ্চারণ ঠিকমত কর হ্যায়। ওরমী মা, লা, রাই চোউধ্-রী নেহি, ওইটা ‘উর্মিমালা রায় চৌধুরী’ হইতা হায়, চোউ – ধু – রী। বুইঝলি হায়?” আলতাফের চোখেমুখে এখন প্রশংসার হাসি।
“ওয়াহ্ মেরে দোস্ত, ওয়াহ্! নাম কে লিয়ে কিতনা পেরেশান হ্যায়? উছকে লিয়ে তো জান দে দেগা তু? হাম স্যাটিসফায়েড হ্যায়।”
হায় কপাল, প্রেমিকা আমার হাতে তুলে দিয়ে কি খুশী। পাক্কা দুইদিন ভয়ে ভয়ে ছিলাম। সকালবেলা চোরের মত কলেজে যেতাম, বিকেলে ফেরার সময়ও একই অবস্থা। বারান্দায় যাই না তাই মেয়েটাকে দেখিনি। দেখতেও চাই না। পথেও এদিক সেদিক তাকাতাম না। যদি দেখা হয়ে যায়? বন্ধুরা সবসময় সাথে থাকে, এতে করে খানিকটা সাহস পাই। তারপরও একদিন হয়ে গেলো। মানে দেখা হয়ে গেলো।
* * * * * * * * * * * * * * * * * * *
একদিন এক অলস দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে সামনের রুমে টিভিতে এটিএন চ্যানেলে হাসানের গান দেখছি। তখনও কলকাতওয়ালারা বাংলাদেশী চ্যানেল ব্যান করেনি। হাসান তার লম্বা লম্বা চুল দুলিয়ে দুলিয়ে চীৎকার করে গাইছে,
“এ্যাঁ কাঁ কীঁ – আমি এ্যাঁ কাঁ কীঁ …..”
ঠাকুর এলো, কিছু একটা বলবে। কিন্তু এমন গোমড়া মুখ কেন? প্রতিদিনের মতো আজও ঠাকুরের সাথে মজা করতে মন চাইলো। আমি ঠাকুরকে টিভি দেখিয়ে বললাম,
“এটা কোন দেশী চ্যানেল বলতে পারো? কোন ভাষায় গান গাচ্ছে?” ঠাকুর টিভির দিকে এগিয়ে গিয়ে একবার ডান দিকের স্পীকারের কাছে কান নিয়ে, আরেকবার বাঁ দিকের স্পীকারের কাছে কান নিয়ে হাসানের গান শুনছে। টিভিতে হাসান প্রানপনে গাইছে,
“রাত্-রি, ইয়োনেক হো লোও …
চোওখে নেই কো নো ঘুম উম উম উম ম ম…
অপরূপ জো ছো না. . . .
অযাচিতো বে-দোও না . . .”
ভালোমত খানিক্ষন শ্যূনে আমাদের সামনে এসে গম্ভীরভাবে বললো,
“এটা তেলেগু দাদা। তেলেগু, তেলেগু।”
আমার পাশে সিকদার, হাসতে হাসতে ফেটে পড়লাম। হাসানের গানকে বলে তেলেগু। ঠাকুর তখনও আমাদের দিকে বেজার মুখে চেয়ে আছে। টিভির দিকে তাকাচ্ছেনা। সিকদার জিজ্ঞেস করলো,
“কিয়া ঠাকুর? আমাদের দিকে রেনি রইছো কেন? কিছু বইলবা?”
“আজ্ঞে আজ রান্না হবেনা।” চিন্তিত মুখে ঠাকুর বললো। আমি বললাম,
“রান্না না হলে বিরিয়ানী রাঁধো।” ঠাকুর বলে,
“কিচ্ছু হবেনা দাদা। স্টোভ পোম্পু নিচ্ছেনা।”
“কিয়া নিচ্ছেনা?” সিকদার এবার গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো।
“পোম্পু, পোম্পু। স্টোভে পোম্পু দিতে হয় না? পোম্পু ছাড়া স্টোভ চলে?” ঠাকুরের জবাব।
এখন বুঝলাম কোরোসিন স্টোভে পাম্প নিচ্ছেনা। এটা কলকাতা, বাংলাদেশের মত ঘরে ঘরে গ্যাসের লাইন লাগানো থাকেনা।
“ওয়াসার চেঞ্জ করলে ঠিক হয়ে যাবে। একটা ওয়াসার কিনে নিয়ে এসো আমি ঠিক করে দেবো।” ঠাকুরকে বললাম।
“আমি থাকি দমদম। গড়িয়ার কিছু চিনি নে। দিদিমণি আচে নিচে ওর থেকে ঠিকানা নিয়ে ওয়াসার ঠিক করে নিয়ে এসো।”
“দিদিমণি দেবে স্টোভের ওয়াসারের খবর? চল তো, কোন দিদিমণি দেখি!” ঠাকুরকে নিয়ে নিচে নেমে আমি বিমূঢ়। বাসার সামনে দাড়িয়ে সেই শ্যামলা রংয়ের মেয়েটি। মেরুন রংয়ের সালোয়ার কামিজ পরা, ওড়নাও আছে তবে গলায় মাফলারের মত ঝুলে আছে। কিন্তু সে বাসার সামনে এরকম রেডি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে কেন? আমি ঘাবড়ে গেলাম তবে কিছু বুঝতে দিলাম না।
“দিদিমণি ওকে বলে দাও তো এটা কোথায় পাবে?” স্টোভ পাম্প করার পাম্পারের সাথে ক্ষয়ে যাওয়া ওয়াসার লেগে আছে। ওটা এগিয়ে দিলো মেয়েটির দিকে। নির্বিকার, খুব স্বাভাবিকভাবে ওটা আমার হাতে দিতে বললো, ঠিকানা চিনিয়ে দেবে যে কতো না, আবার কেরোসিন মাখানো ওটা ধরে হাত নোংরা করবে? ইংরেজীতে ‘ফলো মি’ বলে হন হন করে এগুতে থাকলো।
আমিও বাধ্য ভৃত্যের মত পিছু নিয়েছি, হাতে পোম্পু দেবার পিস্টন। কেরোসিন মাখানো। আমার হাত এর মধ্যে কেরোসিন লেগে গন্ধ হয়ে গেছে। পেছনে তাকিয়ে আলতাফের কথা জানতে চাইলো, হিন্দি বা উর্দুতে কথা বলছে। জবাবে বললাম,
“হি’জ লেফট। ইটস্ বিন ফোর ডেজ। সরি আই ক্যান্ট স্পীক উর্দু।” উর্দু বলতে পারিনা কথাটা ঠিক না, আমার মাতৃভাষার সাথে হ্যায় লাগালেই হয়।
“ইটস্ হিন্দি, নট উর্দু। হয়্যার আর ইউ ফ্রম?” পিউর ইন্ডয়ান একসেন্ট। এত স্বাভাবিকভাবে বলছে, যেন কিছুই হয় নি। অথচ বাংলাদেশে চোখ মারা চরম শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ভেতরে ভেতরে আমি ভয়ে অস্থির। কোন মতে বললাম, “বাংলাদেশ।”
এবার মেয়েটা অবাক হল, মিষ্টি হেসে বললো, “ওহ্ মাই গড! তুমি বাংলাদেশ থেকে এসচো? আমি ভাবলাম তুমি মরিশান।”
আমি হতবাক! এতই অবাক যে ভয় ডর সব কেটে গেলো। রাগও হল। আমাকে মরিশাসের বাসিন্দার মতো লাগে এমনটি কেউ জীবনেও বলেনি।
“আলতাফ চারদিন আগে চলে গেলো, অথচ জানালোও না। কবে ফিরবে বলতে পারো?” এবার বিরক্ত হলাম প্রথমতঃ আমাকে মরিশান ভেবেছে, দিত্বীয়তঃ তুমি তুমি করে বলছে। কত বড় বেয়াদপ। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, এই মেয়ের সাথে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলবো। ফেণী অরিজিন। (যদিও তুমি করে বলা কলকাতার কালচার, পরে জেনেছি।) একটু ঝাঁঝ দেখিয়ে বললাম,
“ফিরবো কোন তুন? কোর্স শ্যাষ, গেছে গোই। আর আইসতো ন’।” অবাক চাহনী, সুন্দর গোটা গোটা দুটো চোখ দুটো বড় বড় করে আবার বলো,
“ওহ্ মাই গড! বাবা, ঠাকুর্দা আর ঠাম্মা এই ভাষাতেই কথা বলে।”
“কোন ভাষাত কথা বলে?” বেকুবের মত মেয়টার দিকে তাকালাম। আমার ঝাঁঝভাব উধাও।
“এই যে, যেভাবে তুমি বলছো?” এবার আমি তোতলাচ্ছি, “ তোঁ তোঁ তোঁয়ার ঠ ঠ ঠাম্মা আর ঠ্-ঠাব্বা কি ফেণীর তুন নি?”
“আমার বাবার ঠাকুরদার বাড়ী হচ্ছে পূর্ব বাংলায়, চাটগাঁর কাছে, মীরের সরাই।”
“ওরেহ্!” এবার আমি হেসে ফেললাম, “মীর-সরাইর মানুষ ত আন্ডা মত করি কথা বলে।”
“আন্ডা মত করে মানে?”
“আন্ডা মত মানে ‘আমাদের মত’ করি, হাঁস মুরগীর আন্ডার মত না।”
পাড়ার ভেতর দিয়ে বেশ খানিকটা হেঁটে মেইন রোডে উঠতেই কর্নারে বেশ বড় হার্ডওয়্যার শপ, মেইন রোডেও প্রায় সব দোকানপাট বন্ধ। বড় বিধায় হার্ডওয়ার শপ টা খোলা, ওখান থেকে ওয়াসার কিনে একসাথে ফিরছি। কিন্তু এখনও বুঝলামনা দুঃশাসন ঠাকুর স্টোভের পোম্পু দেবার ওয়াসারের সাথে এই মেয়েকে কোত্থেকে জুড়লো? পরে শুনেছি দুঃশাসন গেছিলো মেয়েটার কাছে পোম্পু ওয়াসারের দোকানের খোঁজ নিতে আর তখন মেয়েটি আমার সম্পর্কে একে একে সব জেনে আমাকে ডাকিয়ে ওর সামনে আনিয়েছে কৌশলে। হুমম, বুদ্ধি হ্যাজ!
“ওটা করতে আলতাফ বলেচিলো তোমায়?” সারসরি আক্রমনাত্বক প্রশ্ন মেয়েটার।
“কিয়া কইত্তে?”
“ইউ উইংকড্ মি।” আবার চুপ হয়ে গেলাম। ইন্ডিয়ানদের এই সমস্যা, ঝর ঝর করে ইংরেজীতে কথা বলে। যদিও তাদের নিজস্ব একটা একসেন্ট আছে যেটা সারা বিশ্বের কাছে ইউনিক। অনেকে হাসে, তবে যা বলে নির্ভুল বলে। কিন্তু আলতাফই আমাকে চোখ মারতে বলেছিলো সেটা আমি বলতে যাবোনা, বন্ধুর সাথে বেঈমানী হয়ে যাবে। “লেটস্ টক এবাউট সামথিং এলস্।” ভণিতা না করে সরাসরি প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললাম। আবার নতুন দৃষ্টিতে তাকালো আমার দিকে,
“ইউ হ্যাভ ভেরী স্ট্রং ইংলিশ এক্সেন্ট। অথচ তোমার লোকাল বাংলা শুনলে কেন জানি মনে হয় ইচ্ছে করে আমার সাথে এমন করচো।” একেবারে কেঁদে ফেলার উপক্রম। নাহ্, চোখের পানি নাকের পানি দেখে গলে যাওয়া যাবেনা, স্ট্রং হতে হবে স্ট্রং।
“তোঁয়ার কতার হোন্-মাতা কিছু বুঝিয়ের না…” আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললো,
“এসব কি হচ্চে? কি ভাষা এগুলো?” খুব অপমানিত বোধ করছে সে। সত্যি কেঁদে ফেললো নাকি? কলকাতার শুদ্ধ বাংলার এ্যাকসেন্টের সাথে আমি পরিচিত, কারন আমার দু, দুটো ভাবী পশ্চিমবঙ্গের। উর্মিমালা কথা বলছে সাউথ ক্যালকাটার স্ট্রং বাংলা এ্যাকসেন্টে। যাই হোক, আমি ফেণী ভাষাতেই চালিয়ে যাবো, যা হবার হবে। বললাম,
“আইচ্ছা শুনো? আঁই আবার বইলতেছি। তোঁয়ার কথার আগা মাথা কিছু বুইজতে ফাইত্তেছি না। প্লিজ তুঁই বাসাত যাও, আঁইও যাইয়ের। আঁই ‘কি ভাষায়’ না, আঁর মাতৃভাষায় কথা বইলতেছিলাম। আর হ্যাঁ, দা-বটকির দোকান চিনাইয়া দিবার জইন্য, ধইন্যবাদ।” খুব সময় নীয়ে ধীরে ধীরে বললাম, বোঝালাম আমি শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারিনা, তবে চেষ্টায় আছি। ওড়না দিয়ে চোখ মুছছে মেয়েটা। আমার মনটাও খারাপ হচ্ছে, কিন্তু আমার বাঁদরামী যে লেভেল পর্যন্ত গিয়েছে সেখান থেকে ফেরার উপায় নেই। প্রেম-ফেম আমার সিস্টেমে নেই। সরি। একটু ধাতস্থ হয়ে, মুখের সামনে চলে আসা চুলগুলো সরিয়ে বললো,
“বাসা না, ওটা আমাদের বাড়ী। আর, দা-বটকির দোকান না, ওটা হার্ডওয়্যার শপ।” কথাগুলো যখন বলছিলো কান্নার ভাব তখনও রয়ে গেছে তবে মুখে স্মীত হাসি। মোছার পর ভেজা চোখ আর মায়াভরা মুখখানা দেখতে খুব মিষ্টি লাগছিলো। বাসার সামনের রাস্তায় দাঁড়ানো আমরা, একদিকে আমার অন্যদিকে ওদের। পুরো এলাকা নিঝুম, জনশূন্য, খাঁ খাঁ করছে একেবারে। ভাতঘুমের সময় কলকাতার আবাসিক এলাকাগুলো এমনই হয়।
“আমি ঊর্মি। ঊর্মিমালা রায় চৌধুরী।” বলে হাত বাড়িয়ে দিলো হ্যান্ডশেক করার জন্য। মুখে মিষ্টি হাসি। নিজেকে পুরোপুরি সামলে নিয়েছে।
“সো সরি। কি বলি দুঃখ্খ ফ্রকাশ করমু বুইঝতাম ফারিয়ের না। আঁর হাতে কেরাসি লাগি গিয়েছে। হেনশিক কইল্লে তোঁয়ার হাতে কেরাসি লেগে যাবে যে? গন্ধ!” স্টোভের পিষ্টন ধরা ডান হাত দেখালাম।
“হেনশিক না, হ্যান্ড শেক। আচ্ছা ঠিক আচে, আরেকদিন তাহলে। কিন্তু তোমার নাম বললে না?”
“ওহ্, আমি সাগর। সাগর চৌধুরী।” চোখ বড় করে হেসে দিলো,
“এতো সুন্দর নাম? তোমার কথার স্টাইলের সাথে একদমই যায় না।”
“তোঁয়ার নামও সোন্দর। উর্মি মালা, মানে ঢেউ নেকলেস।” হাসতে হাসতে পড়ে যাচ্ছে যেন মেয়েটা, তারপর দুহাতে মুখ ঢেকে স্বাভাবিক হল।
“এতো চমৎকার ট্রান্সলেশান আগে শ্যূনিনি। আচ্চা শোনো, একটা রিকোয়েস্ট করি, রাখবে?”
“অবশ্যই অবশ্যই। কিয়া বইলবা বল?” কাঁদিয়ে দেবার পর কিছু একটা করার সুযোগ পেয়ে ছ্যাবলা বনে যেতে আপাততঃ আপত্তি নেই।
“চলো একসাথে কোথাও যাই। তুমি আমার বাবা-ঠাকুর্দার ভাষায় কথা বলো, তাই তোমার সাথে কথা বলতে, গল্পো করতে ইচ্চে হচ্চে। রিকশা বা অটো নেয়া যেতো। দেখতেই পাচ্চো কিচু নেই আশেপাশে। হাঁটা ছাড়া উপায় নেই, এ সময়ে কখনো কিচু পাওয়া যায় না।”
ভেতরে ভেতরে দমে গেলাম। দেশে আমি যে পরিবেশে বড় হয়েছি সেখানে কোন অপরিচিত ইয়াং মেয়েদের সাথে এত দীর্ঘ সময় কথা বলার প্রচলন নেই। একসাথে রিকশায় কোথাও যাওয়া? ওরে বাবা, অসম্ভব। অবশ্য এখানকার অবস্থা ভিন্ন, ওর সাথে যাওয়া যায়। দু’মিনিট সময় নিয়ে বাসায় গিয়ে পোম্পু-পিস্টন দুঃশাসন ঠাকুরকে দিয়ে হাত ভালো করে ধুয়ে একটু ফেটিং-ফুটিং করে বেরিয়ে পড়লাম।
কোথায় যাচ্ছি জানিনা তবে বুঝতে পারছি দক্ষিন বরাবর হাঁটছি আর কথাবার্তা বলছি। অদ্ভুত ব্যপার হল, মেয়েটা আমার অঞ্চলিক ভাষার প্রায় পুরোটাই বুঝতে পারছে আর সমানে কথা বলে যাচ্ছে। নাকতলা রোড প্রথম দিকে সোজা দক্ষিনে গেলেও শেষের দিকে বেশ ঘোরানো। আমার বাসা পড়েছে বাঘাযতীন শ্রী কলোনীতে, এটা দক্ষিন কলকাতার মোটামুটি পশ্ এলাকাগুলোর একটা। ঘরবাড়ীগুলো সুন্দর, প্রায় নতুন। রাস্তাঘাট আর আশপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। বাড়িগুলো সব তিন থেকে পাঁচতলা, সব আলাদা, ডিটাচড্। প্রতিটি বাড়ীতে কমপক্ষে দুটো করে গাড়ী। তার মধ্যে একটা মডেল কমন, সুজুকি-মারুতির ওমনি। অতিশয় ক্ষুদ্র মাইক্রোবাসের মত দেখতে। খুব আগ্রহ নিয়ে গল্প করছে মেয়েটা। জানা নেই, পরিচয় নেই একজন বিদেশী ছেলের সাথে পাশাপাশি হাঁটছে, কথা বলছে অনেকক্ষন ধরে। দিনের অন্য সময়ে এই পথে হাঁটার উপায় থাকেনা, প্রচুর ট্রাফিক। কিন্তু ভাতঘুমের সময়ে পুরো এলাকা নীরব থাকে। অনেক বিষয়েই কথা হচ্ছিলো তবে বেশীরভাগই ওর দাদা-দাদী (ঠাম্মা, ঠাকুর্দা) আর বাংলাদেশ নিয়ে। দাদা-দাদী এমনই এক ছবি ওর মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে যেন পৃথিবীর সব সৌন্দর্য, মায়া আর ভালোবাসা রয়েছে বাংলাদেশের ‘মীরের’ সরাইয়ে। যদিও দেশে আমরা ‘মীরের’ সরাই বলিনা, বলি মীরসরাই। সীতাকূন্ড পাহাড় আর বাড়ব কূন্ডের ‘কূন্ড’ এখনো দেখেনি সেজন্য ওর পুরো জীবনটাই বৃথা। নাকতলা রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে দক্ষিনে যেতে যেতে এক পর্যায়ে নাকতলা দূর্গাবাড়ী পর্যন্ত চলে গেলাম। ওরে বাবা, অনেকদুর চলে এসেছি। এটা নেতাজী নগরের শহীদ নগর কলনী। এখানেই নাকতলা রোড শেষ। ডানে মোড় নিয়ে দূর্গাপ্রসন্ন পরমহংস রোডে উঠতেই হাতের ডানে দেয়ালঘেরা বিশাল মন্দির। ওটা দূর্গাবাড়ি। আরো দেড়মাস পর দূর্গাপুজো, অথচ সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। আরেকটু সামনে এগিয়ে গেলে শহরের ব্যাস্ত সড়ক নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু রোড। এখানে যানবাহনের আনাগোনা ভালোই। এবার যেতে হবে। ইতিমধ্যে ভাতঘুমও শেষ, নিশ্চই এলাকা ব্যাস্ত হয়ে গেছে। বললাম,
“বহুত হাঁইটলাম, এবার বাসাত যাই গোই।”
“আরেকটু হাঁটি না, প্লীজ।” আমার ইতস্ততঃ ভাব দেখে আবার বললো, “তোমাকে একটা ব্রীজ দেখাবো, দারুউউউন! এই সামনেই।”
বাঁয়ে মোড় নিয়ে নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসু রোড ধরে সামান্য এগিয়ে রোড ক্রস করে কয়েকটা গলি হয়ে একটা ব্রীজের উপর উঠলাম। ব্রীজের ওপারে শাহাপাড়া-ফার্তাবাদ রোড। ব্রীজে উঠে মেজাজ খারাপ হবার বদলে হাসি পেলো। আমি ভেবেছিলাম নদী বা খালের উপরে ব্রীজ, যেখান থেকে নিচে দেখা যাবে পানি, দুই পাড়ে সবুজ গাছপালা, পানিতে হাঁসেরা খেলে বেড়াচ্ছে। অথচ এই ‘দারুউউউন’ ব্রীজ হচ্ছে কলকাতা মেট্রো রেললাইনের উপরে একটা ছোটখাট সেতু। আমরা যেদিকে তাকিয়েছি তার উল্টোদিকে মেট্রো রেল ষ্টেশন, নাম গীতাঞ্জলী। গীতাঞ্জলী ষ্টেশনের ওপারে আরেকটা বড় ব্রীজ আছে নাম বান্টি ব্রীজ, অনেক ব্যাস্তও। আমার ভাবলেষহীন মুখ দেখে এবার সে আমাকে বান্টি ব্রীজের উপর নিয়ে যাবে। আমি এখানেই থাকতে চাইলাম কারন এটা একদম নিরিবিলি। ভীড়ভাট্টা নেই। টুরিষ্ট গাইডের মত করে উর্মিমালা বলছিলো এটার উপর থেকে কলকাতার মেট্রোরেল দেখা যায় যেগুলো বেশীরভাগ মাটির তলার সুড়ংগ দিয়ে চলে। আমি বলছি কম শুনছি বেশী। তাছাড়া ক্ষিদে পেয়েছে। গীতাঞ্জলি মেট্রো স্টেশনের পাশে শাহাপাড়া-ফার্তাবাদ রোডের উপর কিছু কফি শপ, স্ন্যাকস্ বার ইত্যাদি আছে। বিকেলের নাস্তা খাওয়ানোর অফার দেওয়া যেতে পারে।
“চা কদ্দুর খাইবা নি, কেইক দি?” চোখ গোল করে তাকিয়ে বললো,
“কেক দিয়ে চা খাবো?” আমি আবার বললাম,
“ওকে, ওকে, আই মীন চল আমরা চা নাশতা খাই। তারপর তোঁয়ার আদরের বান্টি ব্রীজ হাঁটি পার হমু। ওই ফাড়েত্তুন রিকশা নাইলে টেক্সী লই যামু, ওকে?”
উর্মি আর কথা বাড়ালোনা। কিন্তু কোনো কফি শপ বা স্ন্যাকস্ বারে ঢুকতে দিলোনা। সে আনিসের চিকেন চাও খাবে। ওদের সব খাবার ‘দারুউউউন’। একেবারে কাছে, স্টেশনের ওই পাড়ে। বান্টি ব্রীজ পার হবার সময় পা ফেলা যাচ্ছিলোনা, রাস্তায় এত গাড়ী আর মানুষ। হারিয়া যাবো এই অজুহাতে উর্মির হাত ধরতে গিয়েও ধরলাম না। দক্ষিন কলকাতার বিকেলের ভীড় শ্যূরু হয়ে গেছে। চায়নীজ খাবার এবং রোল, দোকানের নাম আনিস না অণীষ সেটাই ঠাহর করতে পারছিনা। ইংরেজীতে লেখা ‘ANISH’। উপরে রংচংগা সাইনবোর্ড আর নিচে ধোঁয়াটে তেলতেলে দেয়ার আর আসবাব পুরোনো ঢাকার কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু চিকেন চাওমিন খেতে এতো স্বাদ, মনটা ভরে গেলো। বিকেল গড়িয়ে রাত হয়ে গেছে, রিকশা নেওয়া যেতো কিন্তু আমি অটো নিলাম, ভালোই দেরী হয়ে গেছে। বাসার সামনে নামিয়ে বিদায় নেবার সময় খুব করে রিকোয়েস্ট করলো ওর ঘরে যাবার জন্য।
“তুমি আমার বাড়ী আসবে, অবশ্যই আসবে। ঠাম্মা-ঠাকুর্দা তোমায় দেখে অনেক খুশী হবে। চা-জলপান না খাইয়ে আসতেই দেবেনা! ঠাকুর্দা এখনও মীরের সরাই চলে যেতে চায়। নিজের জন্মভূমির কথা, ছেলেবেলার কথা বলে আর বিমর্ষ হয়। এ্যাই, তুমি আমাদের বাড়ী আসবে তো?”
“আসুম আসুম, কথা দিলাম তোমার ঠাম্মা আর ঠাদ্দার লগে দেখা করুম।”
“ঠিক আচে, পরে দ্যাখা হবে, ক্যামোন?” সাঁই করে ঘুরলো, মেরুন রংয়ের কামিজটা এবার আর ফুলে উঠলো না, গভীর কালো চুলগুলো ছড়ালো দুপাশে আবার, বসে গেলো পিঠের উপর। ভালোই লম্বা চুল।
পিতলের ঘটিহাতে উর্মিমালা জল নেবার ছলে আমার বাড়ীর পাশে নীচের কলতলায় আসতো। এলাকার সব বাড়ীতেই জলের ব্যাবস্থা আছে, ওরা বলে ‘শাপ্লাই জল’। তবে খাবার জল বলতে পুরো মহল্লার জন্য এই চাপাকল। আমাদের কারো কলতলায় যেতে হত না, দুঃশাসন সবার জন্য মিনারেল ওয়াটারের ‘ডিব্বা’ কিনে রাখতো। আমি থাকতাম দোতলার জানালাওয়ালা ঘরটিতে। সে আসতো বাঘাযতীন শ্রীকলনী যখন গভীর ভাতঘুমে। পুরো এলাকা নীরব। দোকানপাট বন্ধ, রাস্তাঘাট ফাঁকা। তখন সে আসতো, নীচে থেকে আস্তে করে মিষ্টি কিনকিনে স্বরে মালা আমায় ডাকতো,
“সাগোরদা! সাগোরদা” আমিও জানালার কাছে গিয়ে বলতাম,
“আইছো নি? খাড়াও, আইয়ের।” তারপর আমরা বেরিয়ে পড়তাম। যাবার আগে বলতাম বাসায় বদনা রেখে আসার জন্য।
“বদনা বলো ক্যানো সবসময়? এটা ঘটি!”
“ঘটি বইলতে লইজ্জা করে।”
“লইজ্জা… মানে লজ্জ্বা করে? ক্যানো?”
“এইটা একটা বর্ণবাদী শব্দ, রেসিস্ট।”
“রেইসিস্ট? ক্যানো, রেইসিস্ট ক্যানো?”
“আমরা কইলকাতার মানুষকে ঘটি বলি।” অপরাধীর মত মুখ করে বললাম।
“আরে ধ্যাৎ, ঘটি মোটেও রেইসিস্ট ওয়ার্ড না। এটা আমাদের কলকাতার মানুষদের মধ্যে দুটো সাব-গ্রুপ। ঘটি আর বাঙ্গাল। ওসব বাদ দাও, আর তুমি প্লীজ কোইলকাতা বলবে না, কলকাতা বলবে। ওকে?”
ভাতঘুমের সময় রিকশা বা অটো কিছু পাওয়া যায় না। অগত্যা আমরা হেঁটই অনেকখানি যেতাম। সেই রামগড় লেক নয়তো বৈষ্ণবঘাটা জোড়ামন্দিরের পাশে পদ্মশ্রী লেকের ধারে। মাঝে মাঝে ট্যাক্সী নিয়ে ময়দানে চলে যেতাম। আবার হাওড়া ব্রীজের ধারে।
অনেক গল্প করতাম আমরা। মালার সব আগ্রহ বাংলাদেশকে নিয়ে। বাংলাদেশের আকাশ কেমন, বাতাস কেমন, মানুষজন, পরিবেশ কেমন, দূর্গাপুজোর সময় কি হয়। আমি বলতাম,
“আবহাওয়া, ফরিবেশ, নদী নালা সব হুবহু তোমাদের কইলকাতার মতন। কতা হইলোযেন, আমরা লাইন ধরি ফানি থুক্কু জল আনিনা। সবাইর ঘরে ঘরে চাপাকল আছে। নিজস্ব চাপাকল, এজমালি না। আর দুর্গাপুজা? হে হে, আমাদের ফেণীতে যত বড় করি দূর্গাপুজা হয়, তোমাদের কলিকাতার মানুষ এত সুপারহিট দূর্গাপুজা জীবনে দেইখছে কিনা সন্দেহ।”
কলকাতার দূর্গাপুজা আমি দেখিনি। সত্যি কথা বলতে, ফেণী শহরের বাইরে আর কোথাও দূর্গাপুজা আমি দেখেনি। তাতে কি? আমাদের ফেণীর সবকিছু পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ।
ও বলতো, “সাগোর দা, আমি কিন্তু অনেক কথা বলি, কিন্তু যখন তোমার সাথে থাকবো আমি মিউট। তুমি শ্যূধু কথা বলবে, আমি শ্যূনবো। তোমার কথাগুলো এত্তো ডিফেরেন্ট, এত্তো কিউট, খুব ভালো লাগে, শ্যূধু শ্যূনতে ইচ্চে হয়!”
মনে হচ্ছিলো মালা একটু বাড়িয়ে বলছে। আমি বললাম,
“টনটনায় নি?”
“টনটনায়? হোয়াট ডু ইউ মিন সাগোর দা?”
“মানে কোনো খান দিয়া ব্যাথা-ব্যাদনা করে নি কোনো?”
“না না, ব্যাথা করবে কেন?” মালা ব্যাস্ত হয়ে পড়ে, “তোমার এই সুন্দর ভাষার জন্যেই তোমায় এতো ভালোবাসি। এত্তো সুইট, এত্তো সেক্সী ভয়েস! উফফ আই লাভ ইউ সাগোরদা!”
কত সহজে বলে ফেললো, “ভালোবাসি”।
মনে মনে ভাবি, “রং এক্কেরে বাই বাই হড়ের।“
দুপুরের একটু পর থেকে প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘোরাঘুরি আর চলতো। একবার লম্বা হাঁটা দিয়ে বিশ্ববাংলা উদ্যানে গিয়ে উঠলাম। ওখানে চমৎকার একটা লেক আছে। আছে, আছে সেতু, ফোয়ারা আর বসার জায়গা। একবার গল্প করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে রাত হয়ে গেলো, মাথার উপর ভরা পূর্ণিমার চাঁদ। এজন্যেই আজ উর্মীমালা বেশ প্রগলভ, হেলানওয়ালা বেঞ্চে আমার মাথায় বুক রেখে সে তার অতীত ভালোবাসার গল্প শোনাচ্ছে, সিরিয়াল প্রেম…
“তোমার আগে আলতাফ, তার আগে ভালোবাসতুম এক শিখ ছেলেকে, ও পাঞ্জাবী ভাষায় কথা বলতো। আমি বুঝতুম না তাই ইংরেজীতে বাৎ-চিৎ চলতো।”
“বাত্ বুইঝলাম, চীত্ ও হইছিলা নি হেতের লগে?” খানিকটা আহত কন্ঠে জানতে চাইলাম। সে বললো,
“না না সাগোর দা! ওটা কথার কথা। তুমিও না!…. ওই শিখ ছেলেটের আগে ভালোবাসতুম এক মারাঠীকে, মুম্বাইয়ের। পিওর উর্দুতে কথা বলতো। ওর সাথে আমার তেমন অসুবিধা হোতো না।”
“আঁরও খুব একটা হয় না। আঁর মাতৃভাষার লগে ‘হায়’ লাগাই দিলেই কাম চলে। তার আগে কার লগে ফ্রেম কইচ্ছ?” “তারও আগে যাকে ভালোবাসতুম, সে ছিলো সাউথের। ওর ভাষার বিন্দুবিসর্গও বুঝতুম না। তাই সব সময় ইংরেজীতেই বাৎ-চিত্ চালাতে হোতোগো সাগোরদা!”
“আবার চীত্?” বলতেই আমার দিকে এমনভাবে তাকালো, যেন ছেঁচবে। তাড়াতাড়ি বললাম, “আইচ্ছা আইচ্ছা, হেতের ভাষা এক শব্দও বুইঝতানা মানে কিয়া? উদাহরণ দ’ চাই?” ঊর্মি বললো,
“একটা খালি দুধের টিনের ভেতর একটা বা দুটো পাথর ঢুকিয়ে খুব জোরে নাড়লে কেমন শব্দ হয় বলতে পারো?” বললাম,
“দুধের ডাব্বাত্তে হাত্তর ডুকাই গুডুর গুডুর কইত্তাম আঁই? আঁ-কে কি হাগলা কুকুরে কাম্বিয়েছে?” একটু শুদ্ধ বলারও চেষ্টা করেছি।
“ইউরেকা! সগোর দা!! তুমি ঠিক ধরেচো। ওর ভাষাই ছিলো এরকম, গুডুর গুডুর, ভুডুর ভুডুর, ইন্ডা মিন্ডা, আন্ডেলে পান্ডেলে, একদম ওরকম। ওরা যে সাউথ ইন্ডিয়ান সাগোর দা!”
“হেতের আগে কার লগে ফ্রেম কইচ্ছ?” একেকজনের কথা বলে আর প্রতিবার আমার বুকের উপর ওর মাথার ওজন বাড়ে। আমার কি হিংসে হচ্ছে? হিইইইংসে?
“ওহ্ তার আগে? দাড়াও মনে করে নিই।” হঠাৎ বুক থেকে মাথা তুলে আমার দিকে তাকালো। বুকের ভার কমাতে আরাম লাগছে, বড় একটা নিশ্বাস নিলাম। “হুমম মনে পড়েচে, ও ছিলো মিডল্-ইষ্টার্ন। ও যখন কথা বলতো মনে হতো সুর ছাড়া কোর-আন রিসাইট করচে।” আমি বললাম,
“তোঁয়ার তো কোরআন তেলাওয়াত বুঝার কতা ন, কেন্নে বুঝেছো গো? কেন্নে কেন্নে?” আরইব্বা প্রেমিক শ্যূনে একটু আবেগ চলে এসেছিলো। “আইও, আবার বুকে মাতা থোও, তারফরে বল”। আবার বুকে মাথা রাখলো।
“কি যে বলোনা সাগোর দা, এ্যাসপ্লানেডের পাশে কতো বড়ো মাছ্-জিদ। আমার কালেজ ওই মাছ্-জিদের পাশেই। ফ্রাইডেতে কতো শ্যূনেছি। সো সুইট এন্ড মেলোডিয়াস।” মনে মনে ভাবি, দুম্বাল্যান্ডের রাজপূত্রও বাদ যায় নি। তাহলে আমি কত নম্বর? পঁচ, ছয়, সাত কিংবা দশ?
“কলেজরে ‘কা-ল্যাজ’, মসজিদেরে ‘মাছ্-জিদ’ বইলতেছ কিল্লাই জানু? সোন্দর করি বল। বল ‘কলেজ’, ‘মসজিদ’। হেসে ফেললো উর্মিমালা, বড় সুন্দর সে হসি।
“আমরাতো এভাবেই বলি। ওকে বলচি, ‘কওলেজ’, ‘মসজিদ’। হয়েছে?”
“হইছে, বহুত সুন্দর হইছে। কালেজের তুন কওলেজ আরো সোন্দর।” আশ্বস্ত করে বললাম। ডাবল আশ্বস্ত করার জন্য একটা শ্লোক বানিয়ে শোনালাম,
“তুঁই সোন্দর কওলেজ সোন্দর
সোন্দর তোঁয়ার রং
আরো বেশি সোন্দর তোঁয়ার
‘চরং – বরং’।”
আবার হাসলো, প্রশংসা আর স্বীকৃতির মিষ্টি হাসি। দুরের ল্যাম্প পোস্টের আধমরা আলো নাকি পূর্ণিমার চাঁদের আলো জানিনা, শুধু জানি অদ্ভুত এক আলো উর্মিমালার শ্যামলা মুখে দ্যূতি ছড়াচ্ছে। কি যে মিষ্টি মুখখানা!
“তুমি কবিতা বানালে? আমায় নিয়ে?”
“কবিতা ন’, ষোল্লক।”
“কি?”
“ষোল্লক, ষোল্লক। মানে কিচ্ছা গাইলাম তোঁয়াকে নিয়ে।”
আমার কথা বুঝলো কিনা জানিনা তবে তার দুচোখ ভিজে গেছে আবেগে আর আনন্দে। আমার বুকে ওর মাথা। গভীর কালো নরম চুলগুলো, সামনের দিকে গলা পর্যন্ত, পেছনদিকে কাঁধ আর পিঠ ছাড়িয়ে প্রায় কোমর পর্যন্ত লম্বা। হাত বুলোতে ভালো লাগছে। কোনটা বেশী ভালো লাগছে… নরম চুল না শরীর? যেখানে হাত যায় সেখানেই ভালো লাগে। মনে মনে বললাম, “ও আল্লাহ্ । কি হচ্ছে এসব?”
সেদিন বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় নয়টা বেজে গিয়েছিলো। ভদ্রতা করে রাতের খাবার কোন ভালো রেষ্ট্যুরেন্টে খেতে বলেছিলাম, মানা করেছে।
* * * * * * * * * * * * * * * * * * *
পরদিন থেকে শুরু করে একেবারে শেষদিন পর্যন্ত কলেজে সকাল-সন্ধ্যা ব্যস্ত ছিলাম। কোর্স শেষের দিকে, তাই কঠিন হচ্ছে দিনে দিনে। বন্ধের দিনগুলোতেও লাইব্রেরী ওয়ার্ক করেছি। পরীক্ষা যেদিন শেষ পারলে সেদিনই দেশে চলে আসি। সামনে দূর্গাপুজো, কলকাতা ভয়াবহ ব্যাস্ত। দুর্গাপূজা বাঙালি হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। তবে ভারতের অন্যান্য প্রদেশের অবাঙালিরাও ভিন্ন ভিন্ন নামে এ উৎসব পালন করে। পাঁচদিন ব্যাপী বিশাল এই পুজো অনুষ্ঠান শুধু কলকাতা নয়, গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে পালন করা হয়ে থাকে। এটা বাঙ্গালিদের হিন্দুদের প্রানের উৎসব। চারিদিকে সাজ সাজ রব আর শপিংয়ের তোড়জোড়। প্রতিদিন ভীড় বাড়ছে কলকাতায়। পুজোর আগে আমাকে অবশ্যই দেশে ফিরতে হবে তা না হলে পূজো শেষ হওয়া অব্দি কলকাতায় থাকতে হবে। তখন আবার অনেক বেশী দেরী হয়ে যাবে।
কোর্সওয়ার্ক, পরীক্ষা, পরীক্ষা শেষে সার্টিফিকেট আদায়, পুজোর ডামাডোল আর আমার ফেরার প্রস্তুতি এতোসব ব্যাস্ততার মাঝে কিভাবে জানি মন থেকে হারিয়ে গেলো উর্মিমালা। দেখা করাতো দুরে থাক, ওকে নিয়ে ভাবার বিন্দুমাত্র সময় পাইনি। সার্টিফিকেট হাতে পাবার পর এক মুহুর্তও থাকতে ইচ্ছে করছিলোনা। বাক্স-পেঁটরা গুছিয়ে ট্যাক্সী নিয়ে সেদিনই অনেক রাতে সোজা বেনাপোল রওনা হলাম। হরিদাসপুর বর্ডার, ইমিগ্রেশন কাস্টমস এসব পার হয়ে যখন বাসে করে ঢাকার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি তখন প্রায় সকাল আটটা। একটু আগে অনেকখানি বৃষ্টি হয়েছে। নাকে আসছে আমার বাংলাদেশের বর্ষার মিষ্টি বাতাসের গন্ধ। বাসে ছাড়ার মিনিটখানেকের মধ্যেই তলিয়ে গেলাম গভীর ঘুমে …
“সাগোর দা, সাগোর দা, শোনো! এ্যাই সাগোর দা! মা গো! এ্যাত্তো ঘুম? ওঠো, ওঠো!” ঘুমের ঘোরে টের পাই এটা উর্মিমালা। চোখ খুলে দেখি সেই প্রথমদিন দেখা খয়েরী রংয়ের জামা পরা, সেই ওড়না দিয়ে ঘোমটা। কিন্তু বৌ সেজে আছে কেন? কপালে লাল টিপ আর তার দুপাশে ছোট ছোট সাদা ক্রীম স্পট সারা মুখে হয়ে থুতনিতে গিয়ে শেষ হয়েছে। শ্যামলা মিষ্টি মুখখানা, কি যে সুন্দর লাগছে! ওমা, উর্মিমালা আমার বৌ যে। উপুড় হয়ে বুকের উপর সেঁটে আছে রূপসী বধু আমার। কিন্তু মাথার ঘোমটাটা হঠাৎ বদলে গিয়ে লাল ক্যাপ হয়ে গেলো কেন?
বড়সড় একটা নৌকার মধ্যে আমরা, বাসের সীটের মত সীট। আশেপাশে অনেক যাত্রী। জানালার দিয়ে বাইরের গাছপালা দেখা যাচ্ছে। চোখে মুখে ফ্রশ বাতাসের ঝাপটা লাগছে। নৌকা মাটির উপর দিযে চলছে নাকি? হতেও পারে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, আমাদের দেশেও এখন হোভারক্রাফট চলে। আমাদের কি বিয়ে হয়ে গেছে? আজ কি আমাদের বাসর রাত? বাইরে দিনের আলো কেন? এটা তাহলে বাসর দিন। ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।
“সাগোর দা, সাগোর দা!…… হ্যালো, হ্যালো। এই যে মিষ্টার… হ্যালো…”
আবার তাকালাম। একি, উর্মিমালা এটা কি ড্রেস পরেছে? আর্মি ইউনিফরমের মত। মাথার লাল ক্যাপ টা আগের মত। তবে মুখমন্ডল বেশ ফর্সা। কিন্তু উর্মিমালার নাকের তলায় গোঁফ কেন?
“হ্যালো মিষ্টার হ্যালো! এই যে সাহেব, আমরা বর্ডার গার্ডস। আপনার ব্যাগ চেক করবো।” ঘুম ভেঙ্গেছে মাত্র। সম্বিত ফিরে স্বপ্ন থেকে বাস্তবে এলাম,
“অবশ্যই, অবশ্যই।”
ধড়ফড় করে সোজা হয়ে বিনয়ের সাথে বললাম। পথে কোথাও চেক হচ্ছে। বর্ডার ক্রস করার পর চেকিং হয়। বিজিবি জওয়ানের ফর্সা মুখে গোঁফ না থাকলে মেয়ে বলে ভ্রম হত।
মধুমতী নদীর উপর কামারখালী ব্রিজ পর হয়ে বাস এখন পূর্ণ গতিতে ঢাকার দিকে যাচ্ছে। আকাশ মেঘলা তবে বাইরে উজ্জ্বল দিনের আলো। সকাল দশটার মত বাজে। ঢাকা পৌঁছতে বেলা প্রায় চারটা বেজে যাবে।
বাঘাযতীন শ্রীকলোনীতে তখন বাজবে বেলি সাড়ে তিনটে। সবাই গভীর ভাতঘুমে। পুরো এলাকা নীরব। দোকানপাট বন্ধ, রাস্তাঘাট ফাঁকা। শ্যামলা রংয়ের মেয়েটি নীচে কলতলার পাশে দাঁড়িয়ে, দোতলার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে মিষ্টি কিনকিনে স্বরে হয়তো ডাকবে,
“সাগোরদা! সাগোরদা!”
কেউ হয়তো শুনবে, কিছু বুঝবে না। পর্দা সরিয়ে নীচে তাকাবেনা। মেয়েটি আরো কিছুক্ষন অপেক্ষা করবে, হয়তো বা।
তারপর ফিরে যাবে শ্যামলা রংয়ের মেয়েটি।
* * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * *
*হিইইইংসে হয়? আমার মত হতে চাও? – এই লাইনের স্বত্ব শেফুদা কর্তৃক সংরক্ষিত।