রিভিউ – উপন্যাস: বৃক লেন
লিখেছেন: মণিকা আলী
প্রকাশক: Penguin Random House
ISBN: 9780552771153
“উপন্যাস, ছায়াছবি এবং বিতর্ক”
২০০৭ সালের ঘটনা। বৃটিশ পত্রপত্রিকায় হেডলাইন ছিলো এরকম, ‘বৃক লেন ছায়াছবির রয়্যাল প্রিমিয়ার বর্জন করলেন প্রিন্স চার্লস।’ প্রিন্স চার্লস রয়েল প্রিমিয়ার থেকে বৃক লেন ছবি বাদ দিতে বলেছেন কেননা মণিকা আলীর লেখা এই উপন্যাস বৃটেনের বিশাল বাংলাদেশী জনসাধারনের ভেতর যথেষ্ট ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। এখন এই ছবির রাজকীয় প্রিমিয়ার শো হলে বৃটিশ রাজ পরিবারের ধর্মের প্রতি শ্রধদ্ধাশীলতার বিষয়টি প্রশ্নের সামনে পড়বে, এটা ভেবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। সে বছর সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে লন্ডনের বাংলা পত্রিকার গরম খবর ছিলো এটা।
বৃক লেন উপন্যাসটি প্রকাশিত হবার পর থেকে বৃটিশ বাংলাদেশীরা অভিযোগ করে আসছে যে ওই উপন্যাসে বৃটিশ বাংলাদেশীদের চরম অবমাননা করা হয়েছে এরং পাশাপাশি ইসলাম ধর্ম বিশ্বাসের উপরও আঘাত হানা হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য বৃটেনে বাংলাদেশীদের ৯৫%-ই বাংলাদেরশের সিলেট এলাকার। তারা বলেন এই উপন্যাসে (সিলেট এলাকার) বৃটিশ বাংলাদেশীদের অশিক্ষিত, মূর্খ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে যা চরম অবমাননাকর।
মণিকা আলীর লেখা বেস্টসেলার এই উপন্যাসটিতে একটি নিম্নবিত্ত, বাংলাদেশী মেয়ের জীবনের কথা বর্ণিত হয়েছে যেখানে দেখা যায় মেয়েটির জন্ম মংয়মনসিংহে, ১৭ বছর বয়সে তার চেয়ে দ্বিগুনেরও বেশী বয়সের একজন প্রবাসী বাংলাদেশী ভদ্রলোকের সাথে তার বিয়ে হয় এবং কিভাবে লন্ডনের জীবন যাপনের সাথে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হতে থাকে। ২০০৪ সালে উপন্যাসটি বাজারে আসার পর বৃটেনসহ সারা বিশ্বে খুব কম সময়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে ওঠে এবং বুকার পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হয়। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর অষ্ট্রেলিয়ান লেখক ডি.বি.সি. পিয়েরে’র র্ভেনন গড লিট্ল বইটি শেষ পর্যন্ত বুকার পুরষ্কার পায়। একজন নব্য লেখকের প্রথম উপন্যাস ওই উচ্চতায় চলে যাওয়াও কম কথা নয়।
কিন্তু উপন্যাস নিয়ে উদ্ভুত বিতর্ক এরং পরবর্তীতে ছবি তৈরী করার পরিকল্পনা এসব নিয়ে পূর্ব লন্ডনের বৃটিশ বাংলাদেশী সমাজের আপত্তি চরমে ওঠে এবং স্থানীয় মিডিয়াতে এ নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনাও হতে থাকে। ফলশ্রুতিতে ঘোষনা দিয়েও নির্মিত ছায়াছবি বৃক লেনে-এর রাজকীয় প্রদর্শনী (Royal Gala) থেকে বৃক লেন ছবিটিকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০০৭ এর ২৯ অক্টোবরে অনুষ্ঠেয় রয়েল গালা প্রিমিয়ার শো প্রোগ্রাম বাতিল করার ঘোষনা দেওয়ায় পরিচালক সারাহ্ গ্যাভরণ ২৬ অক্টোবরে লন্ডন ফিলম ফেস্টিভালে এ ছবির প্রিমিয়ার শো করেন।
পূর্ব লন্ডনের বিভিন্ন স্পটে ছবির শূটিংয়ের সময়ও স্থানীয়রা (বাংলাদেশী বৃটিশ) প্রতিবাদ করেছে। বাধার কারনে বৃক লেন এলাকায় কোনো শূটিং করা সম্ভব হয় নি। (যদিও গোটা উপন্যাসে বৃক লেন নামক রাস্তাটির উল্যেখ ছিলো নিছক নগণ্য।) যাই হোক, বৃটিশ রাজ পরিবারের এই সিদ্ধান্তের খবর বৃটিশ পত্রপত্রিকায় আসার পর বৃটিশ বাংলাদেশীদের মধ্যে যারা এই উপন্যাস এবং ছবির বিরূদ্ধে আপত্তি তুলেছিলেন তারা যর পর নাই আনন্দিত। আনন্দিত লন্ডনের বাংলা মিডিয়াও।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে একটা উপন্যাস দিয়ে গোটা সম্প্রদায়কে কতখানি খাটো করা সম্ভব? অথবা, লেখিকা কি আদৌ বাংলাদেশীদের হেয় করার উদ্দেশ্যে ৪০০ পৃষ্ঠার উপন্যাসটি লিখেছিলেন? কি ছিলো ওই উপন্যাসে যার কারনে বৃটিশ (সিলেটী) বাংলাদেশীরা এতো রাগাণ্বিত? এমনকি ছবির শ্যূটিংয়েও বাধা দিয়েছিলেন?
বৃক লেন লিখে মণিকা আলী বেস্ট বৃটিশ ইয়ং রাইটার্স এওয়ার্ড পান এমনকি বানিজি ̈কভাবে প্রকাশিত হবার আগে গ্রান্টা সম্মাননা অর্জন করেন। আমেরিকা-বৃটেন-অষ্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড সহ সারা বিশ্বের প্রভাবশালী পত্রপত্রিকা, সাহিত্য সাময়ীকি এবং ইন্টারনেটে প্রশংসা করে বলা হয় লেখনীর মাধ্যমে ঘটনাগুলো এতোই সাবলীল, গোছানো এবং চমৎকারভাবে উপস্থাপিত যে পড়লে মনে হবেনা এটা লেখকের প্রথম উপন্যাস।
“কি আছে উপন্যাসে?”
‘Seven Seas and the Thirteen Rivers’
সাত সাগর আর তের নদী নাম হবার কথা ছিলো উপন্যাসটির। কিন্তু পরে বইটি বের হল বকৃ লেন নামে। প্রশ্ন আসতে পারে নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্তটি কার? প্রকাশক, নাকি স্বয়ং মণিকা আলীর? উত্তর খুঁজতে গিয়ে সময় ক্ষেপন করেনি কেউ। তবে বৃক লেন নামকরন যথার্থই সার্থক। যদিও গোটা উপন্যাসে বৃক লেন নামের ওই সড়ক আর লোকালয়ের উল্যেখ অতি সামান্য। নামকরনের সার্থকতার মুল কারন হল দুটি শব্দের ছোট একটি নাম ‘বৃক লেন’। শ্রেফ নাম নয়, বৃক লেন তার বহু বছরের ইতিহাস পেরিয়ে নানান হাত বদলে এখন হয়েছে লন্ডন বাংলাটাউনের হৃৎপিন্ড। এই বৃক লেন সারা বিশ্বের ট্যূরিষ্টদের বিশেষ আকর্ষণ যেখানে আছে ইতিহাস, ঐতিহাসিক নিদর্শন, সংস্কৃতি এবং সর্বোপরি বাংলাদেশী খাবারদাবার। বিশ্বের যে কোন প্রান্তে বসে ইংরেজী বইয়ের একজন পাঠক বৃক লেন নাম দেখলেই বুঝবেন এটা পূর্ব লন্ডনের সেই বিখ্যাত ‘বৃক লেন’। বইটা হাতে নিয়ে দু-একটা পাতা উল্টালে পাঠকের আগ্রহ যদি বাড়তে থাকে তাহলেতো কথাই নেই। বর্তমানে বৃকলেন এবং তার আশপাশের এলাকা জুড়ে যে বিশাল সমাজ রয়েছে তার শতকরা ৯৫ ভাগ বাঙ্গালী, খাঁটি বাংলাদেশ। উপন্যাসের সবকিছু বাংলাদেশ আর লন্ডনের বাঙ্গালী সমাজ নিয়েই।
৪০০’র কিছু বেশী পৃষ্ঠার এই বইটির মুল চরিত্র নাজনীন নামের একটি মেয়ে। যার জন্ম ১৯৬৭ সালে মংমনসিংহ জেলার কোনো এক গাঁয়ে।
স্বল্পশিক্ষিত গ্রামের মেয়ে নাজনীনকে তার বাবা দেখেশুনে বড়ই আনন্দচিত্তে লন্ডন প্রবাসী চানুর সাথে বিয়ে দেন। নাজননীন আঠারো আর চানু চল্লিশের কোঠায়। ওরা পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস এ একটা ব্লকড বিল্ডিংয়ের ফ্ল্যাটে সংসার শুরু করে। গ্রামের ভোলাভালা, ইংরেজী না জানা তরুণী নাজনীন কিভাবে প্রচুর সময় নিয়ে, ধীরে ধীরে স্বাধীন হয়ে নিজেকে বৃটিশ পরিবেশে প্রতিষ্ঠিত করে, বৃক লেন উপন্যাসটিতে সেটাই চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন মণিকা আলী।
ছোট্ট গন্ডগ্রামে অপরিণত অবস্থায় নাজনীনের জন্ম হয়। বাঁচার কোনো আশা ছিলোনা শিশু নাজনীনের, তবু বেঁচে ওঠে, বেড়ে ওঠে। তারপর বয়েস আঠারো হবার আগেই চানুর সাথে বিয়ে দেন নাজনীনের বাবা। চানুর বয়স বেশী, তবে খুব একটা বেশী নয়, এই ধরুন চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশের মধ্যে। নাজনীনের বয়সের দ্বিগুণের চেয়ে সামন্য বেশী! যদিও সে আমলে বাঙ্গালী সমাজে বিয়ের ক্ষেত্রে বয়সের এই বিশাল ব্যাবধান স্বাভাবিক ছিলো না, আবার অস্বাভাবিকও নয়।
নাজনীনের সাথে তার ছোটবোন হাসিনার পত্র যোগাযোগ ছিলো। বিয়ের কিছুদিন পর নাজনীন জানতে পারে হাসিনা তার প্রেমিকের হাত ধরে বাড়ী থেকে পালিয়েছে। বিষয়টা নাজনীনের মনে রেখাপাত করে।
লন্ডনে বাক্সের ভেতর নাজনীন আর চানুর ছোট্ট সংসার। চানু আবার বেশ বড়, মোটাসোটা। মানুষটা ভালো তবে সবসময় খানিকটা হতাশ কেননা তার মনপ্রান জুড়ে থাকে কর্মক্ষেত্রে একটি প্রমোশন যেটা তাকে আরেকটু উপরে তুলবে, তারপর আরো একটু। গোটা ঘর জুড়ে এখানে ওখানে চানুর কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট সযতনে সাজানো। এগুলো সে দেশে থাকতে অর্জন করেছে। চানু শিক্ষিত বটে তবে তার নিজের ধারনা সে একটু বেশী শিক্ষিত।
ভিনদেশ, ভিন্ন সমাজ এমনকি একেবারেই ভিন্ন আবহাওয়ায় এসে নাজনীনের সংসার জীবন ওই কাউন্সিল ফ্ল্যাটের বাক্সে বন্দী হয়ে যায়। কিন্তু বোন হাসিনার সাথে চিঠিতে যোগাযোগ হয়, তখন মনে হয় বোন হাসিনা না জানি কতোই না আনন্দে আছে। স্বাধীন, পছন্দের ছেলেকে পলিয়ে বিয়ে করেছে, সেই ছেলের কবল থেকে আবার পালিয়ে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে কাজ করছে। সেখানে নানান ধরনের মানুষের সাথে মিশছে, পৃথীবিটাকে নিজের মত করে দেখছে। এখন একজন ধনী গার্মেন্টস ব্যাবসায়ীর রক্ষিতা হিসেবে আছে।
দুবোনের একে অন্যের কাছে লেখা চিঠির ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজী অনুবাদ গল্পে আলাদা সৌন্দর্য এনেছে। দারিদ্রসীমার অনেক নীচে থাকা একটি শ্রেণীর জীবনের জন্যে যে যুদ্ধ, সে যুদ্ধের বর্ণনা পাঠকদের ধারনা দিয়েছে কিভাবে আমাদের দেশের মানুষেরা বাচাঁর তাগিদে বিভিন্ন পেশায় নিজেদের জড়ায়। দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন, আন্দোলন, ভাংচুর, হর্তাল কিভাবে সাধারন মানুষের জীবন যাপনের উপর প্রভাব ফেলে সেটাও ফুটিয়ে তোলা হয় সুনিপুনভাবে।
চানু তার কর্মক্ষেত্রে সামনে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আয়ের টাকা, সরকারী অনুদান (বেনিফিট), সরকারী কাউন্সিল ফ্ল্যাট, এসব সত্বেও দুটি কন্যা নিয়ে চানুর সংসার চালানো দায়। (নাজনীন আর চানুর প্রথম পূত্রসন্তান রকীব জন্মের কিছুকাল পর মারা যায়)। সংসারের আয় বাড়ানোর কথা ভেবে চানুর সম্মতি নিয়ে নাজনীন সিদ্ধান্ত নেয় ঘরে বসে
সেলাই করবে। লন্ডনের তৈরী কাপড় ব্যাবসায়ী নাজনীনকে কাজ দেয়, নানজনীন ঘরে বসে কাপড় সেলাই করে। ব্যাবসায়ীর ছেলে করিম, তার বয়স আঠারো, সে সময়মতো কাপড় আনে। আবার রেডী হয়ে থাকা তৈরী কাপড় নাজনীনের কাছ থেকে নিয়ে যায়। করিম একজন কঠোর ইসলামপন্থী তরুন (সন্ত্রাসী নয়)। নিয়ম মত নামাজ আদায় করে। শুধু তাই নয় সব সময়
ইসলাম, ঈমান-আহকাম, সারা দুনিয়ার মুসলিম উম্মাহর বর্তমান অবস্থা
(বিশেষকরে প্যালেস্টাইন, আফগানিস্তান, লেবানন, ইসরাইল) নিয়ে
আলোচনা করে। নাজনীন কে দাওয়াত করে তাদের ইসলামী আলোচনায়
অংশ নেবার জন্যে।
ইংরেজী ভাষাজ্ঞানে নাজনীনের সম্বল মাত্র দুটি শব্দ, ‘সরি’ আর ‘থ্যাংক ইউ’। তারপরও, একদিন করিমের ডাকে ইসলামী আলোচনায় যায় নাজনীন। কেন জানি একটু সুন্দর কাপড় পরে, পরিপটি হয়ে ওই আলোচনায় গিয়ে দেখে করিম বলছে সারা বিশ্বে আজ মুসলিম ভাই বোনেরা কি পরিমান নিপীড়ন আগ্রাসনের স্বীকার হচ্ছে… …
নাজনীন যতটা না শোনে তারচেয়ে বেশী দেখে করিমকে। করিমের বয়স নাজনীনের চেয়ে কম, প্রায় পনের বছরের ছোট। গণ্ডগ্রামের অল্প শিক্ষিত মেয়ে নাজনীন, অতশত রাজনীতি বোঝে না। কিন্তু নিয়মিত নামাজ পড়ে, কোরান শরীফ তেলাওয়াৎ করে। ধার্মিক, মনে প্রানে একজন বাঙ্গালী মুসলমান। করিমের প্রতি প্রচন্ড আকর্ষণের কাছে কঠোর ধর্মীয় বিধিনিষেধ কিভাবে যেন হার মেনে যায়। এমনকি কঠোর ধার্মিক করিমও ………
ধীরে ধীরে করিমের সাথে সম্পর্ক যখন সকল হিসেব নিকেশের বাইরে চলে যায় তখন নিজেকে আবিষ্কার করে, সে এক অন্য নাজনীন। স্বামী, সংসার, সন্তান, বাংলাদেশ? নাকি করিম?
মণিকা আলী
* * * * * * * *
১৯৬৭ সালের ২০ অক্টোবর মণিকা আলীর জন্ম হয় বাংলাদেশের ঢাকায় (তৎকালীণ পূর্ব পাকিস্তান)। মণিকার পিতার নাম হাতেম আলী যার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ময়মনসিংহ জেলায়, মা বৃটিশ ইংলিশ। বৃটেনে এসে হাতেম আলীর পরিচয় এবং পরিনয় হয় জইস এর সাথে। তারপর আলী এবং জইস এর সংসারে আসে মনিকা। মনিকার বয়স যখন তিন তখন তাঁরা সপরিবারে ইংল্যান্ডের বল্টন এলাকায় চলে আসেন স্থায়ীভাবে বসবাস করবার জন্যে। বল্টনে স্কুলিং শেষে মণিকা অক্সফোর্ডের ওয়াড্হাম (Wadham) কলেজ থেকে রাজনীতি, দর্শন এবং অর্থনীতির উপর ডিগ্রী নেন। বর্তমানে দক্ষিন লন্ডনে নিজ বাড়ীতে আছেন স্বামী সায়মন এবং দুই সন্তান ফিলিক্স আর সুমিকে নিয়ে।
“প্রসংসা, বিতর্ক এবং তৃতীয় বাংলার তোপ”
কোন সন্দেহ নেই বৃক লেন লিখে অতি দ্রুত মনিকা রীতিমত স্টার রাইটারদের কাছাকাছি অবস্থানে চলে আসেন। ঘাঘু বোদ্ধারাও মনিকার লেখনশৈলীকে ক্রেডিট দিতে এতটুকু দ্বিধা করেন নি। প্রথম উপন্যাস লিখে দারুন সাফল্যর পাশাপাশি বেশ সমালোচনার মুখে
পড়েন মণিকা আলী। বৃটেনের বাংলাদেশী বাঙ্গালী কমিউনিটি অভিযোগ
করেন যে তার লেখায় সিলেটি বাঙ্গালীদের উদ্দেশ্যমূলকভাবে ছোট করা হয়েছে এবং তাদের খুব নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। উপন্যাসে (কিছু ডায়ালগের মাধ্যমে) সিলেটিদের অশিক্ষিত, বিশৃংখল, মুর্খ এবং কুটিল বলা হয়েছে। অন্যদিকে বাঙ্গালী মুসলমানদের ধর্মীয়
অনুভুতিকেও হাল্কা করে দেখানো হয়েছে বলে তাঁদের অভিযোগ। (এক দিকে করিম আর নজনীনকে পরহেজগার হিসেবে দেখানো আবার তাদের ভেতরকার অনৈতিক সম্পর্ককে পজিটিভলি দেখানোর বিষয় প্রসঙ্গে)। এছাড়া বাংলাদেশী বৃটিশদের চরম দারিদ্র তুলে ধরা হয়েছে যা কিনা পুরোপুরি সত্যি নয়। বৃটিশ (সিলেটি) বাংলাদেশী সমাজ একাধিকবার প্রতিবাদ এবং র্যালী করে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছে। অবস্থা এতোই চরমে ওঠে যে ৩০ জুলাই ২০০৬ এর এক র্যালী শেষে প্রকাশ্যে বৃক লেন উপন্যাসটির কপি পোড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অবশ্য পরে সে পরিকল্পনা বাদ দিতে হয় পুলিশ ওয়ার্নিং এর কারনে।
বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী বাস করছে বৃটেনে যার বেশীরভাগ এসেছেন বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট এলাকা থেকে। সর্বাধিক বাংলাদেশী জনসংখ্যা পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটস এলাকায় তাই একে বাংলা টাউন এবং তৃতীয়- বাংলা বলা হয়। স্থানীয়দের অভিযোগ বৃটেনে অনেক অনেক বাংলাদেশী আছেন যারা শিক্ষা-দীক্ষা, কর্মক্ষেত্র কিংবা ব্যাবসায় ভালো করেছেন এবং বৃটেনের অর্থনীতিতে অবদান রেখেছেন, এখনো রাখছেন। এছাড়া বৃটিশ বাংলাদেশীরা সর্বাধিক রেমিট্যান্স দেশে প্রেরণ করে থাকে। অথচ মণিকা ভালোটা না লিখে খারাপটা লিখলো কেন? এ প্রসঙ্গে বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মণিকা বলেন, “স্বাধীনতা নিয়েই লেখকরা লেখে, কেউ যদি অর্থ-বিত্তবানদের নিয়ে লিখতে চায় সেখানেতো কোনো বাধা নেই!”
বৃক লেন উপন্যাসের বিরুদ্ধে কোনো প্রকার আইনি অভিযোগ দাঁড় করাতে পারেনি কেউ, এমনকি ওই উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ছবির বিরুদ্ধেও। বৃটেনে বৃক লেন ছবির শুভমুক্তি হয় শুক্রবার, ১৬ নভেম্বর ২০০৭-এ। ছবির পরিচালক সারাহ্ গ্যাবরন জোর দিয়ে বলেছিলেন এই ছবিতে বাংলাদেশীদের (সিলেটি) খাটো করা হয়নি মোটেও। তিনি আরো বলেন, “প্রতিবাদকারিরা যে বিষয়গুলো নিয়ে আপত্তি করেছিলেন তার কোনোকিছু রাখা হয়নি ছবিতে।” তবে বাঙ্গালী সমাজ এটা মানতে নারাজ।
“মনিকা আলীর লেখনশৈলী”
বাংলাদেশ এবং বাঙ্গালী সমাজের বাইরে বসে মণীকা আলী যেভাবে বাংলাদেশীদের চাল চলন, মানসিকতা, সামাজিকতা নিয়ে লেখেছেন এটা অবশ্যই প্রশংসনীয়। এই উপন্যাসে চমৎকার ভাবে তিনি বাংলাদেশ, এই দেশের ভাষা, আঞ্চলিকতা, সাহিত্য, লোকগাঁথা, সঙ্গীত, ইতিহাস, ব্যাবসা, রাজনীতি, রাজনীতির পালাবদল সাবকিছুরই উল্যেখ করেছেন এবং দক্ষভাবে ইংরেজী উপন্যাসে বাংলা শব্দের প্রয়োগ এবং ব্যাবহার করেছেন যেটা পড়ে বিদেশী ভাষাভাষীরা ইংরেজী হরফে বাংলার খুটিনাটি জেনেছে। যেমন বাংলা প্রবাদ, “The jackfruitis still on the tree but already he is oiling his moustache” (গাছে কাঠাল গোঁফে তেল), “A bald man does not like to walk under the bell-fruit tree twice” (ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায়), “Can’t get mangoes from the amra tree” (আমড়া গাছে তো আর আম ধরে না!), “Sinking, sinking, drinking water” (ডুবে ডুবে জল খাওয়া); এছাড়া খাঁটি বাংলা শব্দ দিয়ে উপন্যাসকে অলংকৃত করা হয়েছে যেমন, পরোটা(Parata), সাধু (Shadhu), হর্তাল, লাড্ডু, পান, ঘোল, বাউল, নেংটি, ফযর, নামায, দোয়া, চৌকি, ফকির, মাহুত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, মেমসাহেব, কর্ণেল ওসমানী, বঙ্গবন্ধু, জয়বাংলা, আওয়ামি লীগ, বি.এন.পি. এরশাদ, গুণ্ডা, জামদানি শাড়ী, নাকফুল, নিরামিষ, (শিল্পাচার্য) জয়নুল আবেদীন, কৃষ্ণচূড়া, রাধা, কৃষ্ণ, সরস্বতী… এরকম আরো অনেক শব্দ সুনিপূণভাবে ইংরেজী ভাষায় প্রয়োগ করেছেন। বিদেশী পাঠকেরা এগুলোকে মোটেও অর্থহীন, দুর্বোধ্য (Jargon) ভাবেন নি সুগঠিত বাক্য প্রয়োগের গুনে। (যেমন, “How many rakahs for the isha prayer?” এশার নামাজে কয় রাকাত? অথবা, “Ershad! You goonda!” এরশাদ, তুই গুণ্ডা!)। আর আমাদের দেশী পাঠকেরাও পেয়েছেন সহজপাঠ্য ইংরেজী ভাষায় ঘরোয়া উপন্যাসের স্বাদ।
পৃথীবির বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মণিকা তাঁর প্রথম উপন্যাসের ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছেন। এর মূল কারন একটা চমৎকার বিষয় যেটা পাঠকদের আগ্রহী করে তুলেছে লেখনীশক্তির কল্যাণে। লন্ডনভিত্তিক গার্ডিয়ান পত্রিকায় বলা হয়েছে, “জটিল চরিত্রের সমাবেশ করা হয়েছে চমৎকারভাবে, এই উপন্যাস অদৃষ্ট আর মুক্তির মহাসম্মিলন।” নিউজিল্যান্ড হেরাল্ড বলেছে, “এটা এমনই একটি উপন্যাস যেটা শুরু করলে শেষ না করা পর্যন্ত থাকা যায় না।” আমার ক্ষেত্রে এটা সত্য বলে প্রমাণীত হয়েছে। নিউ ইয়র্ক টাইমস মণিকা আলীকে শক্তিমান লেখক হিসেবে উল্যেখ করে লিখেছে, “প্রথম উপন্যাস হিসেবে এটা খুবই সুগঠিত, সফল।” লন্ডন অবজারভার মণিকা আলীকে তাঁর জেনারেশনের যথার্থ লেখক হিসেবে উলে ̈খ করে।
মণিকা আলীর বৃক লেন নিয়ে অভিযোগ যতই থাকুকনা কেন এই উপন্যাসে সবুজ বাংলার আপরূপ রূপ তুলে ধরা হয়েছে যথার্থভাবে। সেই সাথে আমাদের খাঁটি বাংলা সংস্কৃতিকে। ছায়াছবিতেও রয়েছে সেই সবুজের স্পর্শ। আর নেতিবাচক যা কিছু আছে সবই কি ডাঁহা মিথ্যে, বানোয়াট? আরেকটু ভাবুন প্লীজ!
[এই লেখাটি ২০০৭-এ সাপ্তাহিক ২০০০ (আধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক বিচিত্রা) ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিলো। সময়ের সাথে সঙ্গতি রেখে খানিকাটা এডিট করে নিয়েছি।]