পথে হল দেখা…
মিলান থেকে প্যারিস ফেরার পথে ভাবছিলাম যাক, ব্যাকুলতা কমলো তাহলে। আবার টিজিভিতেই প্যারিস ফিরে যাচ্ছি। টি.জি.ভি তে চড়ার স্বপ্ন ছিলো সেই ছেলেবেলা থেকে যখন বিটিভির আটটার খবরে ফ্রেঞ্চ বুলেট ট্রেনের ভূমির উপর সর্বোচ্চ গতির রেকর্ড তোলার কথা বলা হচ্ছিলো। . আমি উম্মাদ টাইপের ট্রেনভক্ত। রেলওয়ের প্রতি এই দুর্বলতার কারনে আমি দেউলিয়া হতে হতে কোনোভাবে বেঁচে আছি। বৃটেনে আর ইউরোপে ট্রেনের টিকেট সবচেয়ে দামী আর প্লেনের টিকেট সস্তা। এখনও ট্রেইন জার্নির উপর কোন টিভি প্রোগ্রাম হলে দেখি কিংবা রেকর্ড করে রাখি পরে দেখার জন্য। অনলাইনে দেখি, ডাউনলোড করি। মানে হুলুস্থুল অবস্থা।
২০০৩ এর মে মাসে আসছিলাম জার্মানীর কার্লসরুয়ে থেকে কোবলেঞ্জ। জার্মান আই.সি.ই. বা আইস (Inter City Express) ট্রেনে চেপে। কোবলেঞ্জ থেকে আবার পাঁচঘন্টা বাস জার্নি করে ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে ফ্লাইট ধরে ব্যাক টু লন্ডন। আইস ট্রেনে গল্প হচ্ছিলো সহযাত্রী ভদ্রলোকের সাথে যিনি একজন প্রোগ্রামার। আইবিএম থিংকপ্যাডে একমনে প্রোগ্রাম ল্যাংগুয়েজ লিখে যাচ্ছেন। তিনি এসেম্বলী ল্যাংগুয়েজ লেখেন লিহ্’বার হেভী লিফট ক্রেনের কন্ট্রোল প্যানেল বা ককপিট সুইচবোর্ডের জন্য। ডয়েচল্যান্ডের নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখছি অথচ ধরতে পারছিলাম না। অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে ডয়েচ সাদা আইস ট্রেন ছুটছে। একের পর এক অপরূপ দৃশ্য হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। এস.এল.আর. (ফিল্ম) ক্যামেরা হাতে একটা ভালো ছবি নিতে হিমশিম খাচ্ছি। (তখনো ডিজিটাল এসএলআর বাজারে আসেনি) ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে শাটার রিলিজ করতে গেলেই স্পট গায়েব, গোটা স্পট ঘুরে যাচ্ছে বা নাকের ডগায় গাছপালার সারি নয়তো অন্য কিচু চলে আসছে। ট্রেনের ভেতরে বসে এই দ্রুতগতি তেমন টের পাওয়া যায় না, বোঝা যায় তখনই যখন ট্রেন ডানে বা বাঁয়ে টার্ন নেয়। ছবি তুলতে গিয়ে বেশ কয়েকবার প্রোগ্রামার ভদ্রলোকের গায়ের উপর পড়তে পড়তে বন্ধুত্ব হয়ে গেলো।
“এত্তো স্পীড, কিছুতেই মনমতো ছবি নিতে পারছিনা।” বিরক্ত হয়ে বললাম।
“আমাদের আইস (ICE) আর কতোইবা স্পীডি, টিজিভিতে প্যারিস থেকে মার্সাই (Marseilles) গিয়েছিলাম গতমাসে, অনেক বেশী স্পীড ওগুলোর।” ভদ্রলোক বলছিলেন।
কথাগুলো মনে পড়ছিলো প্রায় সাত মাস পর। দ্বিতীয়বারের মতো টিজিভিতে চড়া হচ্ছে। প্রথম বার ইউরোষ্টারে লন্ডন-প্যারিস রাউন্ড ট্রিপ, সাত দিনের। ইউরোষ্টার হচ্ছে সরাসরি লন্ডন-প্যারিস বা লন্ডন-ব্রাসেলস্ সার্ভিস। শরীর খুব খারাপ ছিলো। ছেলেবেলার বন্ধু রাসেলের মেরী-ডিজি’র (প্যারিস) নিরিবিলি বাসায় খেয়ে আর ঘুমিয়ে, বিছানায় হেলান দিয়ে আইফেল টাওয়ারের দিকে চেয়ে চেয়ে তাকিয়ে, আর বিকেলবেলা ঘোরাঘুরি করে এক সপ্তাহ কাটিয়ে শরীরে খানিকটা বল নিয়ে ফিরে এসেছিলাম। দ্বিতীয়বার হলেও মনে হচ্ছে এটাই আমার প্রথম টিজিভি ভ্রমন কেননা ইউরোষ্টার ট্রেনগুলো যে টিজিভি ছিলো সেটাই জানতাম না! অশিক্ষিত আর কাকে বলে? তাছাড়া শরীর খারাপ থাকার কারনে গোটা জার্নি কেটেছিলো একটা ঘোরের মধ্যে।
এবারও রাসেলের ফ্ল্যাটে উঠেছি। এর মধ্যে রাসেল ফ্ল্যাট পাল্টেছে, মেরী ডিজি থেকে শিফট্ করে এখন বাস্তিল, ওটা সেন্ট্রাল প্যারিসে। যখন পৌঁছি তখন বিকেল প্রায় পৌনে পাঁচটা। সূর্য্য ডুবেছে বেশ খানিক্ষন আগে। বাসার সামনে ক্যাব থেকে নামতেই দোতালার জানালা থেকে জানান দিলো আমাকে দেখতে পেয়েছে সে। বাস্তিল (Bastille), শহরের মোটামুটি কেন্দ্রে হলেও সেরকম কোলাহল নেই। . সেদিন ৩০ ডিসেম্বর। রাসেলের বাসায় বসেই কথা হচ্ছিলো ছেলেবেলার আরেক বন্ধু দীপুর সাথে। দীপু থাকে ইটালির মিলানে। দীপুর সাথে যখনই ফোনে কথা হয় এক কথা, চলে আয়। আরে বাপ! চলে আসা কি মুখের কথা? তারপরও একই কথা, “চলি আয়, ট্রেইনে করি চলি আয়, রাসেইল্লার বাসার সিঁড়ির তলে ইষ্টিশন।” রাসেলও বললো মিলানের ট্রেন এখান থেকেই ছাড়ে। হাত দিয়ে পেছন দিকের জানালার বাইরে দেখাচ্ছে সে।
বাসা থেকে বেরিয়ে একটু হাঁটলে প্যারিস গার-দ্য-লিওঁ (Gare de Lyon) ষ্টেশন। ভাগ্য ভালো থাকলে সস্তা টিকেট মিলতে পারে। টিজিভিতে করে মাত্র সাড়ে সাত ঘন্টয় প্যারিস থেকে মিলোন যাবো. . . . ভাবছি। আবার এটাও ভাবছি সেই মিলান থেকে দু-দিন পর আবার প্যারিস ফিরে তারপর আবার লন্ডন ফেরার জন্য ফ্লাইট ধরতে হবে। কিন্তু টিজিভিতে চড়ে মিলান যাবার লোভও সামলাতে পারছিনা।
এবারের মত তেলেসমাতি ট্যুর প্ল্যান আগে কখনো করিনি। যেখানেই গেছি রাউন্ড ট্রীপ টিকেট কেটেছি। অথচ এবার পয়সা বাঁচানোর জন্য লন্ডন থেকে প্যারিসে ওয়ান-ওয়ে বাস, ফেরার পথে ইজি-জেট এয়ারলাইন্সের প্যারিস-লন্ডন সস্তা টিকেট কেটেছি। এতই সস্তা যে টিকেটের দামের সাথে কয়েক পেনি যোগ করলে এক বোতল মিনারেল ওয়াটার কেনা যাবে। তবে ভুলেও প্যারিস থেকে ট্রেনে মিলান যাবার কথা ভাবিনি।
আগেই বলেছি ইউরোপ-আমেরিকায় সবচেয়ে সস্তা হচ্ছে এয়ার টিকেট, বাস ভাড়াও খারাপ না, ট্রেনভাড়া সবচেয়ে বেশী। এখানে অবশ্য কথা আছে, অনেকদিন আগে অনলইনে যদি বাজেট এয়ারলাইন গুলো থেকে টিকেট কিনে ফেলা হয় তাহলে পানির চেয়েও কম দামে যে কোন টিকেট পাওয়া যায়। তারপরও, ট্রেনের টিকেট সবসময়েই দামী। গোটা ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে বেশী ট্রেনভাড়া গুনতে হয় বৃটেনে। যদিও বৃটেনেই ইউরোপের (সম্ভবতঃ) সবচেয়ে ফালতু রেলওয়ে সার্ভিস।
রাসেলকে বললাম কি করবো এখন? রসেল বলে তোর ইচ্ছা। বাসা থেকে নেমে আধা মিনিট হাঁটলে ট্রেন স্টেশন, ওখান থেকে ছাড়ে আমার সাধের টিজিভি, সারা দুনিয়ার সবচেয়ে দ্রুতগামী ট্রেন। আর আমি আইফেল টাওয়ারের তলায় শ্যাম্পেনের গ্লাস হাতে নিয়ে “কিঁ-উ. . . মিঁউঁ . . .” চীৎকার করতে করতে থার্টি-ফার্স্ট নাইট উদযাপন করবো প্যারিসে? কেন? আগামী বছর আসা যাবেনা? ঘ্যান ঘ্যান করতে করতে স্টেশনের দিকে যাচ্ছি।
রাসেল প্রথমে “তোর ইচ্ছা” বললেও এখন খোঁচাখুচি শুরু করে দিয়েছে।
“এইচ্চা কইল্লে আমার এইখানে আর আসিওনা, দীপ্পার কোলে বসি-বসি থার্টি-ফার্স্ট কইরবা তো প্যারিস আইলা কিল্লাই? মিলানেই ডাইরেক্ট ফ্লাই করি চলি যাইতা? মিলানে কি এত আরাম? গত বছরওতো মিলানে থার্টি ফার্স্ট কইল্লা, তার আগের বছরও…”
“ওই তার আগের বছর জুরিখে” – বলে মুখের কথা কেড়ে নিই আমি।
“বুইঝলাম, দীপ্পার লগেইতো!” রসেল গলায় ঝাঁঝ।
সত্যি কথা বলতে গতবারের আগেরবার মিলান থেকে সুইস ট্রেনে করে সুইজারল্যন্ডের জুরিখ গিয়েছিলাম থার্টি-ফার্স্ট করতে। দীপুদের সাথেই। শুধু তাই না, ইটালী থেকে সুইজারল্যান্ড হয়ে জার্মানী পর্যন্ত চলে গেছিলাম। থেকেও এসেছি প্রায় পাঁচ দিন।
বিশাল ষ্টেশন গার দ্য লিওঁ, কিন্তু পরিবেশ নিতান্তই ঘরোয়া। রাত বেশী হয় নি, দশটা-বিশ। হই হুল্লোড় নেই, নেই সীমাহীন ব্যাস্ততা। শান্ত পারিবেশ দেখে ষ্টেশনের বিশাল আয়তন উপলব্দি করার উপায় নেই। টিকেটের সবকটা কাউন্টার বন্ধ। অবশ্য কাউন্টার রাখার আদৌ প্রয়োজন আছে কিনা কে জানে? জায়গায় জায়গায় অটোমেটেড টিকেট মেশিন। কী-বোর্ড, জয়স্টিক সব আছে। গন্তব্য, তারিখ, সময়, দাম ইত্যাদি ছাড়াও ঠিক কোন সীটে বসবো সেটাও একদম চুলচেরা হিসাব করে নেয়া যায়। এবার সমস্যা হচ্ছে, টিকেট আছে তবে শুধু ফার্স্ট ক্লাসের। ফেরার সময় স্ট্যান্ডার্ড ক্লাসের টিকেট আছে কিন্তু সীট কনফার্মড না। সব মিলে ২৪০ ইউরো (তখন প্রায় ১৬০ পাউন্ড)।
রাসেল শেষবারের মত মাথা থেকে ভূত নামাতে বলে। আমি বললাম, “দোস্তো, আগামী বছর পর্যন্ত যদি না বাঁচি?” হাল ছেড়ে দিলো সে, কিন্তু মেজাজ চালিয়ে যাচ্ছে,
“দীপ্পার কোলে বেশী আরাম! আমার কোল কোল না? যা, হেতের লগে ডলাডলি করগোই, আর জীবনে যদি প্যারিসের নাম মুখেদি আইনছত, প্যারিস তোর হো….”
এদিকে সব ঠিকঠাক করে টিকেট কেনার জন্য কার্ড ঢোকালাম, একি কান্ড? আমার কার্ড নিচ্ছেনা? আকাশ থেকে পড়লাম। আমার কার্ডে টাকা নেই, এটা অসম্ভব! পাশের একটা ক্যাশ মেশিনে চেক করে দেখি কার্ডে সমস্যা নেই। সমস্যা টিজিভি অটোবুথে, ওরা নন-ইউরোপিয়ান কার্ড নেয় না। বৃটিশরা কিন্তু ইউরোপিয়ান নয়, ওরা বৃ্ট-ঠিশ্। কি আর করা, কাঁচুমাচু মুখে রাসেলের দিকে তাকালাম। তারপর রাসেলের কার্ড দিয়ে টিজিভির টিকেট কাটলাম, অন্যদিকে আমার কার্ড দিয়ে ক্যাশ তুলে রাসেলকে দিয়ে দিলাম। শালার টিজিভির টিকেট মেশিন লন্ডনী মাষ্টারকার্ড নিলোনা? মানে কি? থাক, এখন চিন্তা করার টাইম নাই। এখন সারারাত প্রিয়বন্ধুর সাথে সারারত ম্যারাথন আড্ডা চলবে। তারপর খু-উ-উ-ব ভোরে ফ্রান্সের প্যারিস থেকে ইটালীর মিলান যাত্রা।
এস.এন.সি.এফ এর রূপোলী আর নীল রংয়ের বিশাল ট্রেনটি গুরুগম্ভর ভঙ্গিতে প্ল্যাটফরমে দাঁড়ানো। (SNCF – Société Nationale des Chemins de fer Français, ইংগানুবাদঃ– French National Railway Company)| শেষমেষ খাঁটি ফরাসী টিজিভিতে যাত্রা হল শুরু। পরদিন ভোরে। প্যারিস থেকে মিলান। ফুটানি না, উপায় না থাকায় ফার্স্ট ক্লাসে করে যাচ্ছি। ট্যূরিষ্টদের জন্যে ফার্স্ট ক্লাস রীতিমতো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আর আমার অবস্থা ভাতের অভাবে বিরিয়ানী খাবার মতো।
যাই হোক, ফার্স্ট ক্লাস মানেই ফার্স্ট ক্লাস – রাজকীয় কাজ কারবার। সুপরিসর সীট, পা ছাড়িয়ে আরামে বসার ব্যাবস্থা, সামনে টেবিল, সেখানে বাহারী টেবিল ল্যাম্পও আছে। আছে 110/220V সকেট। ল্যাপটপ ইউজারদের জন্য। আমার ডান দিকে, ঠিক পাশে নয় অন্য সারির সীটে মধ্য বয়সী, হেভী সেক্সী ড্রেস পরা একজন ভদ্রমহিলা চমৎকার মিষ্টি হেসে বললেন বোঁজো! (Bonjour অর্থাৎ good day বা hello) আমিও সম্ভাষন জানালাম। সঙ্গীর জন্যে তিনি দুটো টিকেট কেটে দুটো সীট নিয়েছেন, মুখোমুখি টেবিলের ওপাশে। একটা সীটেও সে বসেনি, বসেছে সীটের সামনে টেবিলের নীচে। বিশাল এক সাদা নেকড়ে কুকুর।
“ইজ ইট হি অর শি?” কুকুরটার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলাম।
“ইট ইজ এ হি, হিজ নেইম ইজ্ মরিস” ফ্রেঞ্চ টানে মধুর কন্ঠে ইংরেজীতে বললেন ভদ্রমহিলা। ফ্রেঞ্চ একসেন্টে ইংরেজী শুনতে খুব ভালোলাগে আমার।
“হ্যান্ডসাম কুকুর,” বললাম।
“মেহসি” (Merci, অর্থাৎ থ্যাংক ইউ) আমারও সুমধুর হাসি হাসলেন মিনিস্কার্ট আন্টি।
ফ্রেঞ্চ, ইটালীয়ান আর ইংরেজীতে এনাউন্স করে ঠিক সাতটা চার মিনিটে গার দ্য লিওঁ (Gare de Lyon) থেকে ট্রেন ছাড়লো। সাজুগুজু করা আঁটসাঁট পোশাকের চোখ ধাঁধানো স্ট্যুয়ার্ডেসরা যখন ব্রেকফাস্ট নিয়ে এলো ততক্ষনে প্যারিস পেরিয়ে দুর্দান্ত গতিতে ছুটছে টিজিভি। ফার্স্ট ক্লাসে ব্রেকফাস্ট ফ্রী, শ্যাম্পেনও ফ্রী। তাই বলে সাত সকালে কিসের শ্যাম্পেন?
প্রথম স্টপেজ শ্যামবেরী (Chamberry) যেটা মুলতঃ আল্পস্ পর্বত এলাকায় সেভোই ডিপার্টমেন্টের প্রধান শহর। বাংলায় যেটাকে বিভাগ বলি ফরাসিরা সেটাকে বলে ডিপাখ্তেমো (Département)। শীতকালে সারা দুনিয়া থেকে ট্যূরিষ্টরা আলপস পর্বত এলাকায় আসে স্কী করার জন্য। গোটা ইউরোপে স্কী করার অনেক স্পট আছে এরমধ্যে ফ্রান্সের শ্যামবেরী বেশ নামকরা। এরপর সাঁ জ্যাঁ দ্য মোঘেঁ (Saint-Jean-de-Mourienne; ভাই রে, লেখা একরকম আর আওয়াজ আরেক রকম। এই হইলো ফ্রেঞ্চ ভাষা), তারপর মোদানে এবং মোদানে টানেল, এরপর ইটালীল শুরু। ওউলক্স (Oulx) ছোট্ট ছিমছাম ইটালীয়ান বর্ডার টাউন, প্ল্যাটফর্মে দেড়-হাঁটু স্নো জমে আছে। তারপর তুরিন (Torino Porta Susa) এবং ভার্সেলী হয়ে মিলান (Milano Porta Garibaldi)। গোটা পথ সারাক্ষন বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। যতখানি দেখা যায়। শ্যামবেরী থেকে ইটালীর টরিনো-পোর্তা-সুযা পর্যন্ত দুর্গম আল্পসের সারি। এর ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলেছে টিজিভি, হইস্পীডের ক্যারিশমা তখন অবশ্য দেখাতে পারছিলোনা। কিন্তু এর আগে এবং পরে ভূমির উপর সর্বাধিক গতির এই অভিজ্ঞতা, মনে হচ্ছিলো অন্য কোন জগতে আছি। দেশে থাকতে জানতাম পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুতগামী ট্রেন সার্ভিস জাপানে। এ নিয়ে প্রচুর লেখাও পড়েছি। জাপানের ট্রেন সার্ভিস দ্রুতগামী তবে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগামী নয়। জাপানী শিনকানসেন টেস্ট ড্রাইভে বেশ কয়েকবার বিশ্ব রকর্ড করলেও নিয়মিত প্যাসেঞ্জার-সার্ভিস স্পীডিংয়ে ফ্রেঞ্চ টিজিভিই এখনও এগিয়ে। তবে জাপানই সর্বপ্রথম দ্রুতগামী প্যাসেঞ্জার ট্রেন সার্ভিসের প্রচলন করে। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগামী ট্রেন চায়নীজদের। সাংহাই ম্যাগলেভ (magnetic levitation) ট্রেন। তিনদিন মিলানে কাটানোর পর আরেক সুন্দর সকালে মিলান সেন্ট্রাল রেলওয়ে স্টেশন (মিলানো চেন্ত্রালে) থেকে প্যারিসের ট্রেন ধরলাম। ইন-ফ্যাক্ট সকালটা মোটেও সুন্দর না। মেঘলা, ভেজা, স্যাঁতস্যাঁতে আর কনকনে ঠান্ডা। এবার আর ফার্স্ট ক্লাস নয় (পাগল নাকি!) এবং সীটও কনফার্মড না তবে সামনের আট নম্বর কোচে বসতে বলা হয়েছে। বেওয়ারিশ সীট পেলে বসতে পারবো। নয়তো এক্সট্রা সীটে বসতে হবে। সৌভাগ্যবশতঃ সীট পাওয়া গেলো, এক্সট্রা সীট নয়। ফেসিং উইন্ডো সীট। কিন্তু প্রথমে উঠেছিলাম ভুল কোচে কেননা সেটা ছিলো স্মোকিং কোচ। (এখন আর কোন যাত্রীবাহি যানে ধুমপান করা যায় না।) নেমে আসবো ঠিক তখনই পরিষ্কার বাংলায়,
“বাঙ্গালী নি ভাইসাব? বসেন, এইখানে বসেন…”
একটু চমকে তাকালাম। বুকে দুহাত বেঁধে জানালার পাশের একটা সীটে বসা। কথায় স্পষ্ট সিলেটি টান। বললাম,
“জ্বী না ভাইসাব, এটা আমার কোচ না, ভুলে উঠে পড়েছি।”
“আরে বসিয়া ফড়েন। আসেন, আমার ফাশে বসেন…”
মৃদু হেসে নেমে পড়লাম। স্মোকিং কোচে জার্নি করার প্রশ্নই ওঠেনা। বাসায় গেলে দেখা যাবে মোজা, আন্ডারওয়্যার সব কিছুতে সিগারেচের বোঁটকা গন্ধ।
ট্রেন ছাড়ার মিনিট দশেক পর ভাবলাম নাস্তাপানি, চা-কফি কিছু খাওয়া দরকার। ঘুম থেকে উঠে ভোঁ-দৌড় দিয়ে ষ্টেশনে আসতে হয়েছে। খাবার গাড়ী আরো পেছন দিক, ওখানে যেতে হলে বেশ ক’টা কোচ পেরিয়ে যেতে হয়। লম্বা রাস্তা, তাছাড়া এটাতো ফার্স্ট ক্লাস না যে একটু পর পর ফরাসী সুন্দরী স্ট্যূয়ার্ডেস আসবে অর্ডার নিতে। আসা যাওয়ার সময় বাংগালী ভদ্রলোকের সাথে চোখাচোখি হয়, আমি মৃদু হাসি। কি যেন বলতে চান ভদ্রলোক, আমি অমায়িকভাবে এড়িয়ে যাই (এটা ইংলিশদের কাছে শিখেছি)। লাঞ্চে যাবার সময় এবার আমিই ডাকলাম কিন্তু ভদ্রলোক ক্ষুধার্ত নয় বলে জানালেন। লাঞ্চ সেরে ফেরার সময় ইংলিশ স্টাইল হাসি দিয়ে রক্ষা পেলামনা। শক্ত করে হাত ধরে আমাকে তার পাশের সীটে বসালেন।
“ফেরিশোও যাইবেন, না-নি ভাইসাব?” বললেন তিনি।
“জ্বী ভাই প্যারিস যাচ্ছি। আপনিও? নিশ্চই বেড়াতে?”
আমার প্রশ্নের উত্তরের ধারেকাছেও গেলেন না তিনি। “আফনে কুনানে থাকোইন? মিলানো, নাকি ফ্যারিশো?”
“জ্বী আমি লন্ডনে থাকি।”
“লন্ডনে! হাঁছা? খাগজ হইয়া গেছে, না-নি?”
মনে মনে ভাবি, কাগজ… এই শব্দটা আমি বৃটেন ছাড়া ইউরোপের যতগুলো দেশে গেছি সবখানে শুনেছি। যে কোন বাংলাদেশী ভাইবোন দের সাথে পরিচয় হলেই প্রথমে জানতে চায় কাগজ হয়েছে কিনা। বন্ধুদের এর মানে জানতে চাইলে বলে ‘ধুর! বলিস হ্যাঁ হ্যাঁ আছে আছে।’ ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে একটু কনফিউজন টোনে জানতে চাইলাম,
“কাগজ…. ঠিক বুঝলাম না।”
“বুইরাইননা নি? খাগজ! বিঠিশ ফাসফুর্ট। লন্ডনী কইন্যা বিয়া করছেন?” মেজাজ খারাপ হতে গিয়ে হঠাৎ শব্দ করে হেসে ফেললাম, “আমাকে দেখে বিবাহিত মনে হয় আপনার? আর বিবাহিত হলে এভাবে একা ঘুরতে বের হতাম?”
“খাগজ কিতা আফনার?”
“ভাই আমার বাংলা কাগজ। ১০০% বাংলাদেশী পাসপোর্ট। আপনার কথা বলেন, আপনি কোথায় থাকেন, কি করেন?” আবারও প্রশ্ন এড়িয়ে গেলেন তিনি। বয়স আমার চেয়ে বেশী হবেনা। লম্বায়ও আমার সমান। স্বাস্হ্য মাঝামাঝি। গায়ের রং আমার চেয়ে উজ্জ্বল, দেখতেও আমার তুলনায় অনেক ভালো। হঠাৎ হঠাৎ এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। স্থির হয়ে থাকতে পারছেন না।
“ট্রেইন কিতা অনো ফ্রান্সো নি?”
“এখনও না। সামনে একটা টানেল আছে সেখান থেকে ফ্রান্সের শুরু হবে।”
“কিতা আছে?”
“টানেল। সুড়ঙ্গ, পাহাড়ের ভেতর সুড়ঙ্গ, এক মাথা দিয়ে ট্রেন ঢুকবে আরেক মাথা দিয়ে বের হবে।”
“ও ভাই, ভিতরে হামাইলে কিতা হগলতা আন্ধার নি?” বলে আমার ডান হাতের বাহু এমন জোরে খামচি দিয়ে ধরলেন, ব্যাথা পাচ্ছিলাম। বিরক্ত হয়ে বললাম,
“ট্রেনের মধ্যে ইলেক্ট্রিসিটি আছে, লাইটের ব্যাবস্থা আছে। জোক বুঝেন না? এত ভয় পাচ্ছেন কেন? আপনি সত্যি পুরুষ তো?”
আমার বাহু তখনো বজ্রমুষ্ঠিতে ধরে আছেন তিনি। একেতো জোর করে পাশে বসিয়ে খোশ আলাপ চালাচ্ছেন আবার আমার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছেন। প্রবলেম কি এই লোকের? রাগী চোখে তার দিকে তাকালাম। দেখি পাথর চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে লোকটা। মনে হচ্ছে প্যানিক এ্যাটাক। যেন যমদূত তার সামনে। ভয়র্ত, হতবিহ্বল।
❊ ❊ ❊ ❊ ❊ ❊ ❊ ❊ ❊ ❊ ❊ ❊ ❊ ❊ ❊
ভদ্রলোক যেদিকে চেয়ে আছে আমিও তাকালাম সেদিকে। টিকেট চেকার এবং তার সঙ্গী, সম্ভবতঃ সিকিউরিটি।
“ভাই গো, এ্যারা ফাসফুর্ট দ্যাখতে চাইবোনি? ও ভাই – আমি শ্যাষগো ভাই।”
প্রচন্ড কাঁপুনিতে দাঁত কপাটি অবস্থা। হঠাৎ নিজেকে গাধা মনে হল। টানেলের গপ্পো শুনে নয়, ইউনিফর্ম পরা টিকেট চেকার আর সিকিউরিটি দেখে ভয় পেয়েছেন ভদ্রলোক। এত আতংকিত হবার কারন কি? এবার সত্যি মেজাজ খিঁচড়ে গেলো।
“পাসপোর্ট দেখতে চাওয়ার ওরা কে? টিকেট চেকার টিকেট দেখতে চাইবে, পাসপোর্ট নিয়ে কোন প্রশ্ন কারার রাইট ওদের নেই। ভালো কথা, আপনি বিনা টিকেটে প্যারিস রওয়ানা দিয়েছেন নাকি?” হতবিহ্বল ভদ্রলোক উত্তেজনায় দাঁড়িয়েগেলেন,
“আছে আছে, টিকেট আছে!” বলতে বলতে জ্যাকেটের পকেট থেকে টিকেট বের করে আমাকে দেখাতে লাগলেন। কি আজব! আমি চেকার নাকি? ভদ্রলোক উদ্ভ্রান্তের মত আচরণ করছেন। ভালো যন্ত্রনাতো! অনেক্ষন হল ওনার সাথে আটকা পড়ে আছি। ওদিকে আমার ল্যাপটপ, ক্যামেরা সব বাইরে, সীটের উপরে। ব্যাগও মনে হয় খোলা।
“ভাই, ফাসপুর্ট জিগাইলে কিতা মাতরাম? ভাই, ও ভাই, কিতা কইরাম?” যেন কেঁদে ফেললেন। ইংলিশ ভদ্রতার ক্ষ্যাঁতা পুড়ি, মেজাজ আমার সপ্তমে। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
“পাসপোর্ট দেখতে চাইলে প্যান্টের চেইন খুইলা দেখাইয়া দিবেন। টিকেট চেকার কোন ✽✽✽ যে পাসপোর্ট দেখতে চাবে?” বাজে কথা বলে ফেললাম। লম্বা একটা দম নিয়ে রাগ কমানোর চেষ্টা করছি। আবার বললাম,
“টিকেট চেকার টিকেট চেক করবে, পাসপোর্ট দেখতে চাওয়ার ওরা কে? তাছাড়া এক দেশ থেকে আরেক দেশে যাচ্ছেন, ইমিগ্রেশনের লোকজন পাসপোর্ট, ভিসা এসব দেখতে উঠতেই পারে। আপনার প্রবলেম কি? পাসপোর্ট দেখায়ে দিবেন?”
বছর তিনেক আগের একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেলো। সাউথ কোরিয়ার ইনচোন শহরের আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেন স্টেশনে। দেশী এক ভাইর সাথে পরিচয়, কথা বলতে বলতে এগুচ্ছি হঠাৎ ‘মামু! মামু!!’ বলে উল্টোদিকে দৌঁড় দিয়ে পালালো। পরে শুনেছি সে ইলিগ্যাল, ষ্টেশনের ইউনিফরম পরা স্টাফকে পুলিশ মনে করে পালিয়েছে। এসব বিষয় আমার গায়ে লাগে, ইলিগ্যাল হয়ে বিদেশে যেতে হবে কেন? মালয়শিয়া, সিংগাপুর আর জাপানেও এমন দেখেছি। দেশের ভালোমানুষগুলো বিদেশে এমন চোরের মত থাকে দেখলে মনটা ছোট হয়ে যায়। নিজেকে সামলাতে কষ্ট হয়। – কোথায় যেন শুনেছিলাম, “জালিম জাতিকে আল্লাহ্ জালিম শাসক পাঠিয়ে শায়েস্তা করে।” আমরা জালিম না, আমরা সরল এবং কষ্ট সহিষ্ণু। জালিম হচ্ছে শাসকেরা, ওদের জন্য ডাবল-জালিম পাঠাও আল্লাহ্!
ততক্ষনে চেকার আমাদর কাছে চলে এসেছে। আমি ভদ্রলোক থেকে টিকেট নিয়ে আমারটা সহ এগিয়ে দিলাম। পাঞ্চ করে “গ্রাৎসে” বলে হনহন করে ইটালীয়ান টিকেট চেকার চলে গেলো। এখন দেখি ভদ্রলোক সীটে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন।
“আমি ইলিকেল গো ভাই, আমি ইলিকেল। খাগজ নাই, ফত্র নাই। দরা খাইলে হগলতা শ্যাষ আমার। আমার ভাই আমারে নিতো ফ্যারিশোও আইবো। আমার বা-আ-ই, আমার বা-আ-ই…” এবার হেউ হেউ করে কাঁদছেন — “দেকা যদি না হয়?”
ইলিগাল কে ইলিকেল বলছিলেন তিনি। তার কান্নার শব্দে আশপাশের লোকজন তাকাচ্ছে আমাদের দিকে। মহা বিব্রতকর অবস্থা। এমন পরিস্থিতি হবে জানলে জিন্দেগীতেও এই পাবলিকের পাশে বসতামনা। শান্ত্বনা দেবার অভিজ্ঞতাও নেই।
“দেখেন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন হবার পর থেকে এদের বর্ডার কন্ট্রোল আস্তে আস্তে উঠে যাচ্ছে। এছাড়া এসব ট্রেন সার্ভিসে অতীতেও সব সময় ইমিগ্রশন পুলিশ উঠতো না। কালে ভাদ্রে উঠে পাসপোর্ট চেক করতো। চিন্তা কইরেন না তো! চলেন কফি খেয়ে আসি… ওহ্ না, একট অপেক্ষা করেন, আমার ডাব্বায় গিয়ে দেখে আসি জিনিষপত্র সব আছে নাকি গেছে।”
প্রতিক্রিয়া আরো ভয়াবহ। দাঁড়িয়ে সামনে এগুনোর মুহুর্তেই ঝাঁপিয়ে কুঁজো হয়ে আমার কোমর জড়িয়ে ধরলেন তিনি,
“আমারে একলা থুইয়া যাইয়েন না গো ভাই, ও ভাই।”
আমি জানিনা আমার কি অবস্থা। তবে আশপাশের সব যাত্রীরা হতভম্বব। অতি কষ্টে হাত ছাড়িয়ে তাকে আমার পেছন পেছন আসতে বললাম।
সীটের উপর আমার ল্যাপটপ আর এসএলআর ক্যামেরা পড়ে আছে। দুটোই দামী। পাশাপাশি একটা আরবী পরিবার থাকায় ভাবলাম এই যাবো আর আসবো। উনারাও দেখে রাখবেন বলেছিলোন। তাই বলে এতক্ষন? উনাদের কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সবকিছু ব্যাগে ঢুকিয়ে ভদ্রলোককে সাথে নিয়ে (বুফে কার) রেষ্ট্যূরেন্টে এসে কফি আর চকোলেট কেক নিয়ে একটা সিঙ্গেল টেবিলে মুখোমুখি বসলাম আমরা।
টিজিভির জানালাগুলো এমনিতেই বেশ প্রশস্থ, বুফে কারের জানালা আরো বড়, বিশাল। ট্রেন তার দুর্দান্ত গতিতে প্যারিসের দিছে ছুটছে.. বাইরে ঝকঝকে দিনের আলোয় অপরূপ ফ্রান্স। একের পর এক দৃশ্যের পরিবর্তন। কখনো দ্রুত কখনো ধীরে। দুরে হয়তো কোনো ছোট শহর, মাইলের পর মাইল গ্রীন হাউস করা ফসলের ক্ষেত, লেক নয়তো নদী, বন্দর, রাস্তা, ছুটন্ত গাড়ী, মাঠের ওপারে দুর প্রান্তে চার্চ, শ্যাতু (Château বা প্রাসাদ), আবার হঠাৎ সব সাদা। তুষারের ঢাকা প্রান্তর। আল্পসের সারি, জমে থাকা ছোট নদী কিংবা ধবধবে সাদা বন। জানুয়ারীর শুরু, স্নো। সবখানে শুধু সাদা আর সাদা। কফির মগ হাতে দেখছি আর দীর্ঘশ্বাস ফেলছি, কতো ছবি তুলতে পারতাম!
ভদ্রলোকের বাড়ী সিলেটের গোপালগঞ্জে। রাজনীতি করতেন, যুবলীগ। যতদিন ক্ষমতায় ছিলেন ভালো ছিলেন, পাওয়ারফুল ছিলেন। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর এলাকায় বসবাস করা অসম্ভব হয়ে পড়লো। দালালকে ক্যাশ সাড়ে নয় লাখ টাকা দিয়ে তড়িঘড়ি পাসপোর্ট বানিয়ে প্রথমে তিউনিসিয়া আসেন। সেখানে সপ্তাহ দুয়েক থেকে স্থানীয় দালালচক্রকে এগারো’শ ডলার দিয়ে কার্গো জাহাজের খোলের মধ্যে লুকিয়ে গ্রীস। গ্রীসে কিছুদিন থেকে ইউম্যান ট্রাফিকারদের আরো সাড়ে তিন হাজার ডলার নগদে দিয়ে লরীতে করে ইটালীর উদ্দেশ্যে অগ্যস্ত যাত্রা। গ্রীস তখনো ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে স্থান পায় নি।
বড় লরীর সীটগুলোর নীচে ইঞ্জিনের উপরে যেটুকু ফাঁকা জায়গা আছে সেটাকে বাক্সের মতো করে নেওয়া হয়। একটা ছোট মুখ দিয়ে যাদের পাচার করা হবে তাদের একে একে ওখানে ঢোকানো হয়। বারো থেকে পনেরো ঘন্টার জার্নি। শর্ত হল জার্নির পুরো সময় ভেতরেই থাকতে হবে। বের হওয়া যাবেনা। খাওয়া-দাওয়া, পানি এমনকি প্রাকৃতিক কর্মকান্ড সারারও কোন উপায় নেই। বাক্সে কোনো বাতাস চলাচলের ব্যাবস্থা নেই। কয়েকটা ছোট ছোট ফুটো আছে। ইঞ্জিনের উপরে হওয়ায় বাক্স গরম হয়ে থাকে সারাক্ষন। গাদাগাদি করে ওরা চারজন ওই দোযখ বাক্সে কতক্ষন ছিলো বলতে পারেনা। ‘কেউ কেউ ওই বাক্সের মইধ্যে ফেশাব-ফায়খানা করিয়া দেয়।’ অনেকে সহ্য করতে না পেরে মারাও যায়। এই ক’দিন আগে সমুদ্রে একটা নৌকা ডুবে অনেক মানুষ মারা গেলো। তারাও ইটালী নয়তো গ্রীস যাচ্ছিলো। ওদের মধ্যে অনেক বাঙ্গালী ছিলো। একটা জংলা, সুনসান যায়গায় লরী ড্রাইভার ওদের নামিয়ে দিয়ে বলেছিলো এটা ইটালী। আঙ্গুল দিয়ে একদিকে দেখিয়ে বললো ওই বরাবর গেলে লোকালয় পাওয়া যাবে।
বুদ্ধিমান ভদ্রলোক, এক সময় রাজনীতি করতেন, আওয়ামীলীগ (তাই অনেক বুদ্ধি)। বুদ্ধি করে পকেটে কিছু খুচরো ইউরো এনেছিলেন। প্রথমে প্যারিসে ফোন করেন পাবলিক ফোনবুথ থেকে। তারপর ভাইর পরামর্শ অনুযায়ী ইটালীর মিলানো শহরে এক পরিচিত নোয়াখাইল্লা ভাইর নাম্বারে ‘ঘুরাইয়া’ উনাকে পাওয়া গেলো। তারপর খানিকটা বাসে, খানিকটা ট্রেনে, খানিকটা পায়ে হেঁটে মিলানো শহর পর্যন্ত এলেন। মিলানোতে ওই নোয়াখাইল্লা ভাই ওনার কত বিরাট উপকার করেছেন সেটা হয়তো আপন রক্তের ভাইও করতো না। মিলানোতে ওই ভাইর সাথে ছিলেন পাক্কা ‘চাইর মাস’। এখন নতুন বছরের এই সময়ে ট্রেইনে ইমিগ্রেশন চেক খুব একটা হয় না। প্যারিস থেকে ভাই একথা বলেছে ফোনে, সেজন্যইতো এই সময় বেছে নেওয়া প্যারিস যাবার জন্য।
এই ছিলো ভদ্রলোকের গল্প। আমি বললাম,
“দেশে রাজনীতি করতেন, আপনার প্রতিপক্ষ এখন ক্ষমতায়। যতদিন ক্ষমতায় ছিলেন, দৌর্দন্ড প্রতাপে ছিলেন। এখন ওরা ক্ষমতায়, কয়দিন? আবারতো সেই আপনারাই আসবেন, এভাবেই চলে আসছে। দল বদল হয়, গুন্ডামির প্যাটার্ন চেঞ্জ হয় ন। সাড়ে নয় লাখ টাকা, এগারো’শ ডলার তারপরে আরো সাড়ে তিন হাজার ডলার খরচ করে, জান হাতে নিয়ে, হাগা মুতা করতে করতে এভাবে বিদেশে এলেন। এত পাওয়ারফুল লোক, অথচ আজ আপনি আমার মত হাভাইত্তার কোমর প্যাঁচাইয়া কাঁদতেছেন। তার চেয়ে এটা ভালো না, মাটি কামড়াইয়া দেশে থাকতেন তারপর ক্ষমতায় এসে এম.পি হয়ে আবার আরারম করতেন! এবার দ্যাখেন তো? দেশের আরামের সাথে এই জীবনের তুলনা কেমন?”
হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন আবার,
“আল্লায় না করুক ভাইসাব। এত কষ্ট করিয়া কেউ যানি জান হাতে নিয়া দালালেরে টাকা-ফইসা দিয়া বিদ্যাশো না আসে। দালালেরে সব মিলাইয়া যত টাহা দিলাম, ওই টাহা দিয়া দেশে বানিজ্য করলে রাজার হালে থাকতে পারতাম রে ভাই……”
আবার গার দ্যা লিওঁ, প্যারিস। ট্রেন যখন স্লো করছে তখন ভদ্রলোক আমার কোচে হাজির। বললাম,
“ট্রেনতো চলে এসেছে, সীটে যান, লাগেজ রেডী করেন।”
“এইখান তাকি আফনার লগে নামিয়া যাইবো। আমার লগে আর কিছু নাই।”
“কিছু নাই মানে? এক কাপড়ে প্যারিস এসেছেন?”
“জ্বী-অয় ভাইসাব, এক কাফড়ে। আল্লায় বাচাইলে ভাইর লগে দেখা হইলে ত আর চিন্তা নাই। যদি দেহা হয় আর কি!” ভদ্রলোকের শংকা এখনো কাটেনি,
“ভাই, ট্রেন থুন নামিলে ফাসফুর্ট চেক হয় না-নি?”
“না ভাই, ওসব কিছু হয় না। আপনার ভাই আসার কথা না?”
“জ্বী-অয় ভাইসাব। আমার বাই তাকবো।” এই প্রথম ভদ্রলোককে হাসতে দেখলাম।
ট্রেন থেকে নামার সময় জোর করে আমার ছোট প্লাস্টিক ব্যাগ ভদ্রলোক হাতে নিলেন। ওখানে আমার ক্যামেরা আর গলার স্কার্ফটা আছে। ভদ্রলোক আমার ব্যাগটা দিচ্ছেনা। আমি যতই বলি আপনার ভাই নিশ্চই আশেপাশে আছে, এক্ষুনি এসে পড়বে। তারপরও ভদ্রলোক নাছোড়বান্দা,
“আরেকটু খাড়াউক্কা ভাইসাব, আরেকটু, আল্লাহর দোহাই লাগে।”
কয়েক মুহুর্ত… তারপর ওওও আমার ভাই রে…. বলে দুহাত প্রাসারিত করে ভদ্রলোক সামনের দিক থেকে আগুয়ান আরেকজনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আমার ক্যামেরাসহ ব্যাগটা ষ্টেশনের পাথুরে মেঝেতে পড়ে গেলো। আমার গলা দিয়ে আর্তনাদের মত একটা শব্দ বেরিয়ে এলো। আমার এত দামি ক্যামেরা! ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায় নি তো?
কত বছর পর ওদের দেখা হল যেন? মনে করতে পারছিনা। ব্যাস্ত রেল ষ্টেশন, হাজার হাজার মানুষ যাচ্ছে, আসছে। বিশাল জন-অরণ্যের গভীরে দু-ভাই একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে হু-হু করে কাঁদছে। আশ্চর্য! আমার আমার চোখে পানি আসছে কেন? শুধু তাই না, হঠাৎ খুব ক্লান্ত আর অবসন্ন লাগছে। ব্যাগটা এখনও পড়ে আছে। কোনোমতে পা টেনে টেনে সেদিকে এগিয়ে গিয়ে ব্যাগটা হাতে নিয়ে ষ্টেশন থেকে ধীরে ধীরে বের হচ্ছি। খুলে দেখবো? ক্যামেরাটা গেলো কিনা! ইচ্ছা করছে না। রাসেলের বাসায় যেতে বড়জোর মিনিটখানেক লাগবে। ঘরে ঢুকেই ঘুম দিতে হবে। লম্বা ঘুম।
ষ্টেশন থেকে বের হবার আগে কি মনে করে আবার ঘুরে তাকালাম। এর মধ্যে ভীড় কমে গেছে তাই ষ্টেশন চত্বর ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।
দুভাই এখনো আছে। কাঁদছে।