ঘর হইতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
বছর পাঁচেক আগে এক আমেরিকান পর্যটককে বলছিলাম ইউরোপের পদে পদে (on every step) আছে ইতিহাস। তখন আমরা টাওয়ার ব্রীজের পূব দিকে টাওয়ার অফ লন্ডনের সামনে দাঁড়ানো। “এই যেখানে তুমি দাঁড়িয়ে, এরও একটা ইতিহাস আছে। এর ঠিক নিচেই আছে রাজা প্রথম এডওয়ার্ডের আমলে বানানো ওয়াটার গেট যা পরে ট্রেইটরস্ গেট হিসেবে নাম পায়।” আমেরিকানরা খুব সহজে ইমপ্রেসড হয়, সেও হল।
আমার বাসা যেখানে সেখানেও আছে ইতিহাস। বাসা থেকে বের হয়ে থেমস নদীর ধারে হেঁটে বেড়ানোর একটা যায়গা আছে যার নাম থেমস পাথ (নর্থ-ইষ্ট এক্সটেনশন)। জায়গাটা জেমসটাউন ওয়ে সংলগ্ন আবাসিক এলাকায়, নদীর ধারে। এখানে রয়েছে একটি স্মৃতিস্তম্ভ; নাম ভার্জিনিয়া সেটলারস্ মন্যূমেন্ট (Virginia Settlers’ Monument)।
বর্তমান যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের গল্পের শুরু এখান থেকে।
এই স্মৃতিস্তম্ভটি তাদের স্মরণে যারা ১৬০৬ খ্রীষ্টাব্দে পাড়ি জমিয়েছিলো আমেরিকায়, নতুন বসতির আশায়। গভীর আটলান্টিক পেরিয়ে পৌঁছেছিলো আজকের ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের জেমসটাউন বীচে। তৎকালীন ইংল্যান্ডের পূর্ব লন্ডনে, থেমস নদীর পাড়ে, ঠিক এখানে যে জাহাজঘাট তার নাম ছিলো ‘ব্ল্যাকওয়াল কী’ (Blackwall Quay)।
যে তিনটি ছোট ছোট জাহাজের সমন্ময়ে এই ক্ষুদ্র নৌবহর ব্ল্যাকওয়াল ঘাট ছেড়েছিলো সেগুলো হচ্ছে সুজান কনষ্ট্যান্ট, দ্য গডস্পীড এবং দ্য ডিসকভারি। ১৬০৬ সালের ১৯ ডিসেম্বরে মোট ১০৫ জন এ্যাডভেঞ্চারার্সদের নিয়ে ক্যাপ্টেন উইলিয়াম নিউপোর্ট সুজান কনষ্ট্যান্ট, ক্যাপ্টেন বার্থোলোমিও দ্য গডস্পীড এবং ক্যাপ্টেন জন র্যাটক্লিফ দ্য ডিসকভারি নিয়ে প্রথম ল্যান্ড করেন ২৬ মে ১৬০৭ সালে ভার্জিনিয়ার কেইপ হেনরী উপকুলে। পরে জেমসটাউনে পৌঁছায় ১৩ মে তে। এই ১০৫ জন এ্যাডভেঞ্চারার্স দের মাধ্যমে আমেরিকায় প্রথম স্থায়ী ইংলিশ কলোনি গঠিত হয়। সুপ্রীম কমান্ডে ছিলেন ক্যাপ্টেন উইলিয়াম নিউপোর্ট। ভয়েজের মাঝামাঝি কোনো এক সময় একটি ঘটনা ঘটে যেখানে ক্যাপ্টেন জন স্মীথ নামের একজন অভিযাত্রী যে কিনা একজন অকুতোভয় সৈনিক এবং এ্যাডেঞ্চারার, তাকে বিদ্রোহের দায়ে অভিযুক্ত করা হয় এবং উপকুলে পৌঁছানো পর্যন্ত বন্দী রাখা হয়। কিন্তু আমরিকায় পৌঁছানোর পর রাজকীয় আদেশ সংক্রান্ত সীলগালা মারা দলিলের বাক্স খুলে দেখা যায় নতুন কলোনীর কাউন্সিলর হিসেবে জনকেই মনোনীত করা হয়েছে। যাই হোক, পরে ওই ইংলিশ কলোনীর নাম জেমসটাউন রাখা হয়।
জেমসটাউনে পৌঁছে ক্লান্ত বিধ্বস্থ অভিযাত্রীরা রেড ইন্ডিয়ানদের উপর্যুপরি আক্রমন, রোগ বালাই আর দুর্ভিক্ষের কারনে মাত্র দুই বছরে অভিযাত্রীদের সংখ্যা ১০৫ থেকে কমে ৬০ জনে নেমে যায়। ১৬১০ সালে ক্যাপ্টেন জন রলফ্ তামাক বীজ নিয়ে এই কলোনীতে যোগ দেন এবং ক্রমে জেমসটাউন একটি তামাক নির্ভর কলোনী হিসেবে খ্যাতি পায়।
পোকাহন্টাস উপাখ্যানঃ-
কাহিনী আছে যে ক্যাপ্টেন স্মীথ রেড ইন্ডিয়ানদের হাতে ধরা পড়লে পোকাহন্টাস নামের এক তরুণী তার জীবন রক্ষা করে। এই তরুণী দুর্ধর্ষ পওহাটান-ইন্ডিয়ান চীফের কন্যা। এর মাঝে ইংলিশ আর পাওহাটানদের মধ্যে সম্পর্ক যে পুরোপুরি মিটে যায় তা কিন্তু নয়। এই ঘটনার তিন বছর পরে, ক্যাপ্টেন স্মীথ চিকিৎসার জন্য ইংল্যান্ডে ফেরার পর ইংলিশ-পাওহাটানদের মধ্যেকার যুদ্ধে ইংলিশরা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পোকাহান্টাসকে আটক করে এবং পাওহাটানদের দাবী জানায় ইংরেজ যুদ্ধবন্দীদের মুক্ত করে দেবার জন্য। ইংরেজদের কাছে আটক অবস্থায় পোকাহন্টাস ইংরেজী শেখে এবং বাইবেল রপ্ত করে। পরে সে ব্যাপটিজমের মাধ্যমে খ্রীষ্টধর্মে গ্রহন করে। ইংরেজ মন্ত্রী আলেক্সান্ডার হুইটেকার তার খ্রীষ্টিয় নাম রাখেন ‘রেবেকা’। পবিত্র বাইবেলে রেবেকা হচ্ছেন ইয়াকুব এবং ইসহাক (Jacob and Esau) -এর মা যার দুই সন্তান দুটো জাতিকে রিপ্রেজেন্ট করে। তেমনি পোকাহন্টাসকে রেবেকা নামকরনের মাধ্যমে সেই ইংগিত দেয়া হল। ইংরেজদের কাছে আটক থাকা অবস্থায় পোকাহন্টাসের পরিচয় হয় জন রলফ্ এর সাথে যে কিনা অত্যন্ত ধার্মিক এবং সজ্জন ব্যাক্তি। এই বিয়ের মাধ্যমে ইংরেজ-পাওহাটান দন্দ্ব আপাততঃ বন্ধ হয়। পোকাহন্টাস পরে স্বামীর সাথে ইংল্যান্ডে আসে এবং ভার্জিনিয়ায় আরো বেশী সেটলার পাঠাতে এবং ফান্ড রাইজিংয়ে অনেক সাহায্য সহযোগিতা করে।
পোকাহান্টাসের খ্রীষ্ঠধর্ম গ্রহন ইতিহাসের এক বিশেষ অধ্যায়ের সূচনা। ইতিহাসবেত্তাগণ মনে করেন এর মাধ্যমে বুনো পশ্চিমের বুনো ইন্ডিয়ানদের মাঝে জ্ঞানের আলো, ধর্মের আলো ছড়ানো শুরু হয়েছে। পোকাহন্টাসকে বিশ্বের প্রথম রেড ইন্ডিয়ান খ্রীষ্টান নারী মনে করা হয়।
উনিষ এবং বিশ শতকে পোকাহন্টাসকে নিয়ে বেশ কিছু ছবি নির্মিত হয়েছে। ১৯২৪ সালে প্রথম বায়োস্কোপ (শব্দহীন মুভি) নির্মিত হয়, আধুনিক এ্যানিমেশন ফিল্ম রিলিজ করে ডিজনী কার্টুন ১৯৯৫ সালে যেটা সারা বিশ্বে সুপারহিট হয়। এখানে উল্যেখ্য, ফিল্মগুলোতে পোকাহন্টাস আর ক্যাপ্টেন জন স্মীথের রোমান্সের দিকেই ইংগিত দেওয়া হয়েছে যদিও এর কোন বাস্তব ভিত্তি নেই।
দুই বছর ইংল্যান্ডে থাকার পর নিজ জন্মভূমিতে ফেরার সময় লন্ডনের অদুরবর্তী গ্রেভস-এন্ডে পোকাহন্টাস অসূস্থ্য হয়ে পড়ে এবং পরে মারা যায়। পোকাহন্টাস আর জনের একমাত্র ছেলের নাম টমাস রলফ্। গ্রেভস এন্ডের সেইন্ট জর্জ’স চার্চের সামনের ইয়ার্ডে পোকাহন্টাসকে সম্মানের সাথে সমাহিত করা হয়।
আজও গ্রেভস এন্ডের সেইন্ট জর্জ’স চার্চের সামনে শোভা পাচ্ছে প্রিন্সেস পোকাহন্টাসের প্রতিকৃতি।