“খাট” একটি ভেষজ মাদকদ্রব্য
বাংলাদেশে ইদানীং খাট বিক্রি হচ্ছে ফেইসবুকে এই খবর দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আরো ড্রাগ? আচ্ছা, এই ‘খাট’ কি এমন জিনিষ যে আফ্রিকা থেকে আমদানী করে ছাগলের মত চিবুতে হবে? তারপর আসবে তথাকথিত “ফিলিংস” যেটা এনজয় করবে কতিপয় কান্ডজ্ঞানহীন মাদকসেবী। এক থেকে দুই ঘন্টা ধরে ধীরে ধীরে একটি একটি করে পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাওয়া হয়। অ্যামফেটামিন জাতীয় নির্যাস ছড়িয়ে পড়ে দেহে, মস্তিষ্কে। তথাকথিত ‘ফিলিংস’ থাকে চার থেকে ছয় ঘন্টা পর্যন্ত।
পাতা যত তাজা, ফিলিংস তত কড়া। পাতা পুরোনো হয়ে গেলে ফিলিংস হয়না। ‘ফ্রোজেন পাতা চিবুনো অর্থহীন। কিন্তু কি করা? এছাড়া আর যে উপায় নেই। রেফ্রিজারেটেড কন্টেইনারে করে আমদানী হয়।’ – বলছিলো সোমালিয়ান এক খাটসেবী।
মজার ব্যাপার হল এই ‘খাট’ (কিংবা কাট, গাট, বা কাড… আরো যে কত নাম আছে!) বৃটেনে এই সেদিনও বৈধ ছিলো কারন এর মাদকতার মাত্রা বুঝতে বহুদিন সময় লেগেছে। ২০১৪ সাল থেকে এটা ব্যান করা হয়েছে এবং এক ধাক্কায় এটাকে ক্লাস-সি ড্রাগ হিসেবে গণ্য করা হয় কেননা এর প্রভাব অ্যামফেটামিনের মত।
‘খাট’ হচ্ছে ছোট ছোট সবুজ পাতা যেটা আমাদের দেশের এক আঁটি শাকের মত আঁটি আকারে বাজারে বিক্রি হয়। হর্ন অফ আফ্রিকা বা আফ্রিকার শিং বলে পরিচিত উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার ইরিত্রিয়া, জিবুতি, ইথিওপিয়া, সোমালিয়া, কেনিয়া, এবং আরব উপদ্বীপ অঞ্চলের বাহরাইন, কুয়েত, ওমান, কাতার, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব-আমীরাত, সমগ্র ইয়েমেন, ইরাক এবং জর্ডান। এই অঞ্চলে ‘খাট’ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ব্যাবহার হয়ে এসেছে। বর্তমানে ইয়েমেন আর ইসরায়েল ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশে ‘খাট’ অবৈধ এবং ওখানে কিছু কিছু দেশে খাটসহ কেউ ধরা পড়লে তার শাস্তি মৃত্যুদন্ড। এক সময় এসব দেশে ‘খাট’ ছিলো অতি সাধারণ একটা খাবার যা আমাদের দেশের পান-সুপারির মত ব্যাপকভাবে প্রচলিত। কালক্রমে ‘খাট’ এর ভয়াবহতা প্রমাণীত হওয়ায় বিভিন্ন দেশ একে একে ‘খাট’কে অবৈধ ঘোষণা করা শুরু করে। অন্য দিকে পান-সুপারীতে কোন প্রকার মাদকের অস্তিত্ব পাওয়া যায় নি। অতএব পান-সুপারী পৃথিবীর কোথাও অবৈধও নয়।
’খাট’ এর ব্যাপ্তী ঘটেছে বিশ্বব্যাপী। বর্তমান পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ‘খাট’ পাওয়া যায়। বৈধ অথবা অবৈধ উপায়ে।
একটা একটা করে খাটপাতা চিবুতে থাকলে আস্তে আস্তে এর প্রভাব আসে। প্রথমে হাঁসিখুশী ভাব আসে, সব কিছুতে আনন্দ কিংবা মজা। অনেক কথা বলা, পেট খালি কিংবা মন উজাড় করে সব বলে ফেলা। নিয়মিত খাট সেবন করলে ঘুম কমতে কমতে শূণ্যের কোঠায় নেমে আসে। খাবার দাবারের প্রতি অনীহা চলে আসে আর মনে দ্বিধা এবং অনিশ্চয়তা বিরাজ করে। সারাক্ষন বিরক্ত বা ক্ষিপ্ত থাকা, কথায় কথায় রেগে যাওয়া এমনকি আক্রমনাত্বক আরচণও খাটসেবীদের মধ্যে চলে আসে। ‘খাট’ এবং গাঁজা (Harbal Cannabis), এই দুই নেশার প্রভাবের মধ্যে প্রচুর মিল পাওয়া যায়।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় সেই বারো’শ খ্রীষ্টাব্দ থেকে উত্তর-পূর্ব আফ্রিকান, ভূ-মধ্য সাগরীয় আর আরবরা ‘খাট’ এর ব্যাবহার করে আসছে। তখন বিষন্নতা এবং দূর্বলতা দুর করার জন্য আলকেমিস্টরা খাট চিবুতে বলতো। দিন মজুর বা ক্ষেতমজুররাও তখন খাট ব্যাবহার করতো লম্বা সময় ধরে কাজ করার জন্য। যদিও প্রাচীনকাল থেকেই খাট এর ব্যাবহারকে ধর্মীয় এবং সামাজিক দিক থেকে অশোভন বলে সমালোচনা করা হত।
“খাট” আধুনিক বিশ্বের ইথিওপিয়া, সোমালিয়া, জিবুতি, কেনিয়া, উগান্ডা, ইসরায়েল (যেখানে এর নাম গাট), থাইল্যান্ড, এবং *ইয়েমেনে বৈধ। ইসরায়েলে বৈধ কারন সেখানে প্রচুর পরিমানে ইয়েমেনি ইহুদির বসবাস। আবার ইয়েমেনে ব্যাপক পরিমানে খাট চাষ হয় যেটা সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং বলা হয় একবার দুর্ভিক্ষের সময় ইয়েমেনের অর্থনীতিতে বিশেষ সহায়কের ভূমিকা রাখে এই ভেষজ মাদকদ্রব্য ‘খাট’।
.
তবে ইসরাযেল সকারের এন্টি-ড্রাগ অথরিটি ‘খাট’ দিয়ে বানানো কোন এ্যালকহলিক পানীয় উৎপাদন বা বিক্রি ২০১২ সালের জুন মাস থেকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। অর্থাৎ দক্ষিন ইসরায়েলের জনপ্রিয় এ্যালকহলিক পানীয় আরাক (৪০-৬০% এ্যালকহল সমৃদ্ধ স্পিরিট)-এর সাথে কুচিকুচি করে কাটা কাঁচা ’খাট’ আর আঙ্গুরের রস মেশানো প্রবল শক্তিশালী পানীয় এখন সেখানে আর বানানো যাবেনা। তার পরও, ‘খাট’ দিয়ে বানানো প্রচুর জুস ইসরায়েলে এখনও বর্তমান এবং জনপ্রিয়।
বিশ্বের আর সব দেশগুলোতে সরকারীভাবে ‘খাট’ বৈধ নয়।
বৃটেনে কারো কাছে যদি ‘খাট’ পাওয়া যায় আর সেটা যদি প্রথমবারের মত হয় সেক্ষেত্রে তাকে লিখিতভাবে Khat Warning দেওয়া হবে। দুই বছরের দিত্বীয়বার একই ব্যক্তির নিকট ‘খাট’ পাওয়া গেলে তাকে ৮০ বৃটিশ পাউন্ড জরিমানা করা হবে। একই ভাবে তৃতীয়বার পাওয়া গেলে তাকে এ্যারেষ্ট করে কোর্টে পাঠানো হবে। সেক্ষেত্রে ‘খাট’ সাথে থাকার জন্য (Possession) দুই বছর পর্যন্ত, আর চালান, বিক্রী বা উৎপাদনের উদ্দেশ্য (Supply and production) প্রমাণীত হলে চৌদ্দ বছরের জেল হতে পারে।
বাংলাদেশে ‘খাট’ এখনও লিষ্টেড নারকোটিকস এর তালিকায় পড়েনি। তবে গত কয়েক মাসে বিশাল আকারের ‘খাট” ধরা পড়া এবং আফ্রিকান দেশগুলোর সাথে যোগাযোগ বেড়ে যাওয়া আর আঁটি আঁটি ‘খাট’ আমদানী কতৃপক্ষের নজর এড়ায় নি।
আশা করছি কতৃপক্ষ এই নতুন মাদক ‘খাট’ কে সরকারীভাবে অবৈধ ঘোষণা করবে এবং এর বানিজ্য বা বিতরণের সাথে যারা জড়িত তাদের শাস্তির আওতায় নিয়ে আসবে।
আর কোন নতুন উপদ্রব চাই না।