মোতা মেরিজ?

আমার জাহাজ তখন জাকার্তায়। জেটিতে। লাঞ্চ এবং আফটারনূন টি টাইমের মাঝামাঝি তখন। জাহাজের লাঞ্চ টাইম বেলা ১২টা থেকে ১টা আর টি টাইম দুপুর তিন থেকে সোয়া তিন টা। আমার কেবিনে (রুমে) নক, স্বাভাবিক নক না কেমন ধুপ ধুপ শব্দ।

 

আমার কেবিন একদম উপরতলায়, মানে পঞ্চম তলায় যেখানে ব্রীজ (যেখান থেকে নেভিগেট করা হয়)। আমাকেএভাবে নক করে কে? একটু অবাক হয়ে দরজা খুলে দেখি চিফ কুক এবং সেকেন্ড কুক, দুজনের গলায় মালা।

 

কোরবানীর ঈদের গরুবাজারে গরুর গলায়, শিংয়ের উপর মালা পরানো হয়। ওনাদের গলার মালাগুলো সেরকমের। বলা নেই কওয়া নেই, কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই হুড়মুড় করে উপুড় হয়ে দুজনে একসাথে আমার পা ধরে সালাম করে ফেললো। চকিতে সরারও সুযোগ পেলাম না। হতভম্বব আমি, সেই সাথে অবাক এবং রাগ।

 

“দুই জনই আমার বাবার বয়সী, এটা কি করলেন? এসবের মানে কি?”

দুজন বাংলাদেশি ক্রু। চীফ কুকের বাড়ি সীতাকুন্ড, সেকেন্ড কুকের বাড়ি চিটাগাং এর পটিয়ায়। সেকেন্ড কুক চীফের চেয়ে বয়সে বড়, লম্বা, সুন্দর স্বাস্থ্য, দেখতেও মাশাল্লাহ ভালো, চশমা পরেন। অনায়াসে কোন মহিলা কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল বলে চালানো যাবে। সেকেন্ড চীফ কুকের দিকে চেয়ে আছে সে কখন বলতে শুরু করবে।

 

চীফ কুক সেকেন্ডের দিকে চেয়ে বলে, “ও সেকেন্ড, তুই ক,”

সেকেন্ড গলা পরিষ্কার করে দুই হাত ডলতে ডলতে বলেন, “আঁমাদের জঁইন্য দোঁয়া কইরবেঁন চাঁর।”

জাহাজে প্রচুর ড্রামা হয়, আজকের ড্রামা অসহ্য লাগছে। গলায় গরুর মালা, পা ছুঁয়ে সালাম। মানে কি? চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম, “নাটক বাদ দিয়ে কি বলবেন বলে বিদায় হন।”

“চাঁর আমরা ভিঁয়ে করেছি,” চিটাগাইংগা আঞ্চলিক ভাষায় পটিয়ার এ্যাকসেন্ট পশ্, তবে ইনি আবেগের ঠেলায় সব উচ্চারণে চন্দ্রবিন্দু বসাচ্ছেন।

“বিয়ে করেছেন মানে? জাহাজের মধ্যে কিসের বিয়ে, ফাইজলামি করেন?”

“ফোঁওটে(Port-এ) বিঁয়ে করেছি দে, জাঁহাজে না।” গালভরা খুশীর হাসি। চীফ কুকের দিকে তাকালো, দুজনে সম্মতির দৃষ্টি বিনিময় করে আবার আমার দিকে তাকায়

“কদিন আগে বললেন আপনার মেয়ে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করেছে, দোয়া চাইলেন। আর আপনি, চীফ? আপনারা দুই জনই বিবাহিত সেই সাথে স্ত্রী-সন্তান আছে। এসবের ইলিগাল কাজ কারবারের মানে কি? দেশ থেকে হাজার মাইল দুরে জাহাজে বসে বলছেন ‘ভিঁয়ে’ করেছেন। কয়েকদিন পর জাহাজ এখান থেকে ছেড়ে যাবে। তখন এই বৌয়ের কি হবে? আচ্ছা সব বাদ দিলাম, আপনারা নিজ দায়িত্বে কি করছেন না করছেন আমাকে এসব বলছেন কেন? আমার নার্ভ টেষ্ট করছেন, নাকি চাকরী করতে মন চাইছেনা?” দুটোকেই ফ্লাইট ধরিয়ে বাড়ী পাঠিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।

 

শোনার সাথে সাথে সেকেন্ড কুক ‘আৎ’ করে পান খাওয়া লাল টকটকে জিভ কামড়ে ধরে ইতস্ততঃ দুদিকে মাথা ঝাঁকিয়ে খানিক অধৈর্য আর বোঝানোর ভঙ্গিতে কিছু বলার আগেই চীফ বলতে শুরু করেছে, সেকেন্ডের জিভ তখন আবার ভেতরে।

“স্যার ইলিগেল বইলতেছেন। এই বিয়া ইলিগেল না। পুরা শরীয়ত মোতাবেক, এবং ইহা হালাল।”

জিভ মুখের ভেতরে পুরে সেকেন্ড এতক্ষন দম আটকে রেখেছিলো, হা করে দম দিয়ে এবার তার বক্তৃতা শুরু করলো,

 

“দ্যাঁশে ত লোকজন দেনমোঁহরের ফইসা ইসতিরি কে বুঁঝাই দেয় না। বাসর রাইতে বৌয়ের পাঁ দরি বলে মাফ করি দ’, মাফ করি দ’। নতুন বৌ, শরমে ফড়ি হোউক অথবা শঁরীল গরম করি হোউক, তাড়াতাড়ি কয় ‘মাফ! মাফ! মাফ!’ তারফঁরে মাফ কইরবার লগে লগে জামাইয়ে আর নতুন বৌ একটারে একটায় বেড়াই ধরে।”

 

বলে থুতনির দুপাশে হাত দিয়ে আলতো দুটো টোকো দেয়, তওবা-তওবা টাইপ টোকা। তারপর আবার বলে, “এই খানে সেই সিস্টেম নাই চাঁর। আগে দেন মোহর কিলিয়ার, তারফরে কবুল।” একদিকে মাথা কাত করে বুঝিয়ে দিলো এটা যা তা কোন বিষয় নয়।

“স্যার, আন্নেও ফাইরবেন।” এবার চীফ কুক বলছে।

বুকটা হঠাৎ ধ্বক করে উঠলো। এবার আমারও বিয়ে দেবে? আমারও গরুর মালা পরা লাগবে?, “কি পারবো আমি?”

“মুতা মেরিজ স্যার।”

“মেরিজের মধ্যে মুতে কেমনে, ছিঃ! আর এসব বাজে কথা বলছেন কেন বিয়েশাদী নিয়ে?”

“ওরে স্যার আন্নে কি বুইঝতে কি বুইজ্জেন। মেরিজে মুতা না, এইটা হইলো মুতা নিকাহ্। শাদী, বিবাহ। জং এ গেলে কিংবা বৈদেশে গিয়া মুসাফির হইলে এইটা কইত্তে হয়। নাইলে পুরুষ মানুষ হারাম কাজে লিপ্ত হয়।” চীফ কুক অত্যন্ত গুরুত্ব দেখিয়ে কনফিডেন্সের সাথে লেকচার দিচ্ছে। আমার মেজাজ খারাপ দেখে সামান্যও ভয় না পেয়ে ঠান্ড মাথায় বলে যাচ্ছে, “এইটা শরীয়ত সম্মতঃ। এইখানে গুনার কোনো সুযুগ নাই স্যার। হাজার বছরের পুরান ঐতিহ্য এইটা। নবীজির আমলে যুদ্ধে গেলে সাহাবীরা মুতা-মেরিজ কইত্তো। ঊঁটের ফিঠে দুর ফরবাসে ব্যাবসা বা… ”

“আমরা এইখানে কোন যুদ্ধে আসছি? আর কোন উটের পিঠে সাঁতার কেটে জাকার্তা এলাম?”

এবার সেকেন্ড বলে, “চাঁর, আমরা যুদ্ধ না তো কি কইত্তেছি? ফঁরিবার ফঁরিজন ছেঁড়েঁ এঁসেছি। দঁইজ্জার মইধ্যে উত্থাঁল-পাত্থাঁল কত বিপঁদ। আঁ-হারে কষ্ট। আমাদের দুঁখ্খের কোন সীমা আছে চাঁর?” শেষের দিকে গলা ধরে এলো তার, যেন কেঁদে ফেলবে। মোটা ফ্রেমের চশমার পেছনে চোখে চকচক করছে জল।

 

এরা দু’জন মিলে আমাকে যা বোঝালো তা হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়া একটা মুসলিম প্রধান দেশ, এখানে ৮৭ পার-সেন্ট মুসলমান। শুধু তাই নয় তারা কঠোর ইসলামিক আইন কানুন মেনে চলে এবং ‘দুইন্নার তাবৎ’ মুসলমানদের জন্য বিশেষ ব্যাবস্থা রাখা হয়েছে। সেই বিশেষ ব্যাবস্থা হচ্ছে মুতা বিয়া বা মুতা নিকাহ্ বা মুতা ম্যারেজ। এর মাধ্যমে আপনার সাথে একজন নারীর বিবাহ দেওয়া হবে। বিবাহের ক্ষেত্রে সকল নিয়ম শৃংখলা মেনে চলা হবে। কাজি আসবে, বিয়ে পড়াবে, কবুল বলার সাথে সাথে ধার্য্যকৃত দেন মোহর পরিশোধ করে ফেলতে হবে। এখন তাহারা স্বামী-স্ত্রী।

‘স্বামী এবং স্ত্রী পরষ্পর পরষ্পরের জইন্য হালাল।’

যে কয়দিন বন্দরে জাহাজ থাকিবে সেই কয়দিন আপনার ‘হালাল’ ইস্তিরির সহিত সংসার করিবেন। “বসবাস” করিবেন। জাহাজ ছাড়িবার পূর্বে নিয়ম মোতাবেক, উভয়ের সম্মতিক্রমে আনন্দের সহিত তালাকের মাইদ্দমে বিবাহ বিচ্ছেদ হইবে। সন্তান-সন্ততির ঝামিলা নাই, গ্যারান্টি। পাত্র এবং পাত্রীর গুনা হইবে না, গ্যারান্টি। সবচেয়ে বড় কথা এই পবিত্র বৈধ সুযোগ হেলায় ফেলা উচিত নয় তাই স্যারেরও উচিত মুতা বিবাহ করা।

 

সেকেন্ড তার লেকচার কন্টিনউ করছে,

 

– “জাঁহাজের খাঁবার উইন্নতমানের খাঁবার। সঁমুদ্রের বাঁতাস চঁর্বিযুক্ত বাঁতাস। শঁরীলের মইদ্দে পাঁওয়ার হান্দাইতেছে অথঁছ বাঁইর হইতে ফাঁইত্তেছেনা। আঁটকি থাঁইকতেছে। এই পাঁওয়ার বাঁইর কইত্তে হবে। নাইলে মন খাঁরাবির দিকে দাঁবিতো হঁয়। চাঁর আঁপনি মেঁহেঁরবাঁনী করি ছিঁন্তা কঁরেন। আঁবার কবে না কবে জাঁহাজ এই পবিত্র দ্যাঁশে আঁসে ঠিঁক আঁছে?” –

 

দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে সেকেন্ড কুকের দম শেষ হয়ে এসেছিলো। আবার হা করে লম্বা নিঃশ্বাস নিলো। বড়সড় পেট ফুলতে ফুলতে আমার অনেকখানি কাছে চলে এসেছে।

 

বারবার নিজেকে মনে করিয়ে দিচ্ছি মেজাজ গরম করে উল্টোপাল্টা কিছু বলা যাবেনা। অধীনস্থ হলেও এরা আমার চেয়ে বয়সে বড়। তাদেরও মান সম্মানবোধ আছে। মুতা-মেরিজ না হুতা-মেরিজ, এসব ওদের ব্যাক্তিগত ব্যাপার। ওসব নিয়ে হেডমাষ্টারি করার দরকার নেই। নিজেকে যতখানি সম্ভব শান্ত রেখে গম্ভীর কন্ঠে বললাম,

“দেখেন, আপনারা পোর্টে নেমে কি করছেন না করছেন এসব একান্ত আপনাদের নিজস্ব ব্যাপার। আমাকে কখনও বলতে আসবেন না, আমারে বলার প্রয়োজন নেই। যে কারনে আপনারা দুজন দোয়া চাইতে এসেছেন ওটা আমার জন্য অস্বস্তিকর, অগ্রহনযোগ্য। তারপরও, এসব নিয়ে কিছু বলাতো দুরে থাক, ধরে নিচ্ছি আমি কিছুই শুনিনি। যার যার কাজ, কর্ম, ডিউটি এসব ঠিকমত চললেই হবে। আপনারা এখন আসুন। আবারও বলছি, আমি কিছুই শুনিনি, আমি কিছুই জানিনা, ওকে? এবার আপনারা আসুন, সদা সুখী হোন”

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বিড়বিড় করে একে অন্যকে কি বলছে পুরো না শুনলেও এটা বুঝলাম তারা বলাবলি করছিলো, “স্যারের ভালোর জইন্য আইসলাম উল্টা চিল্লাচিল্লি কইল্লো।”

 

ধর্মের নামে বদমায়েশির এক উদাহরণ প্রত্যক্ষ করলাম।

 

আমি অস্থির বোধ করছি। এদের বিষয়টা কেমন উদ্ভট ঠেকছে। সবকিছু আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। এসবের মানে কি? আমার সাথে এমন করছে কেন ওরা। হঠাৎ তীব্র অপমানবোধ হল। আচ্ছা! ওরা আমাকে অপমান করছে না তো? কিন্তু অপমান করবে কেন? ওরা না চাইতেই মাস শেষে বেতনের তুলনায় প্রায় দ্বিগুন পেমেন্ট করি ওভারটাইম বোনাস ইত্যাদি দিয়ে। আমার টিম আমাকে অনেক পছন্দ করে, সম্মান করে। ওদের যে কোন সুখ দুঃখে আমাকে পাশে পায়। সবচেয়ে বড় কথা এরা সবাই ভালো মানুষ। কিন্তু আজ কি হচ্ছে। আমার কেবিনের নীচে ক্যাপ্টেনের কেবিন। এক নজর তাকিয়ে দেখলাম। আমার কেবিনের দরজার সামনের সিঁড়ি নেমে যেখানটায় থেমেছে, তার উল্টোদিকে ক্যাপ্টেনের কেবিনের দরজা। দরজা বন্ধ। ভেতরে ক্যাপ্টেন একা নন, ওনার স্ত্রী এবং চার বছর বয়েসী একটা ছেলে আছে। ওরা জানলে? এদের কি লজ্জ্বা বা সংকোচ হচ্ছেনা? এমন না যে আমি নতুন অফিসার। কিন্তু আজকের অভিজ্ঞতা আগে কখনো হয় নি, কেউ মুতা-বিবাহ বিষয়ে কিছু বলেও নি। আবার মনে হল প্রায় সাড়ে সাত বছরের সমুদ্রজীবনে এটাই আমার প্রথম বাংলাদেশী ফ্ল্যাগের জাহাজ। বাংলাদেশী ফ্ল্যাগ মানে এই জাহাজের পোর্ট অফ রেজিষ্ট্রেশন চট্টগ্রাম। এই সেদিন চিটাগাং পোর্টে যখন জাহাজ বাঁধা ছিলো, আমি, ক্যাপ্টেন, চীফ মেট, চীফ ইঞ্জিনিয়ার আর এজেন্সী অফিসের লোকজন আগ্রাবাদের সিজিও (Chittagong Govt. Offices) বিল্ডিং-এ গিয়ে ফুল সেট ক্রু রিক্রুট করে নিয়ে এলাম। বাংলাদেশ ফ্ল্যাগওয়ালা শীপে বাংলাদেশী ক্রু সিজিও বিল্ডিং থেকে রিক্রুট করতে হয়। সরকারী নিয়ম। অফিসার রিক্রুটমেন্টে সেই বাধ্যবাধকতা নেই (এখন চেঞ্জ হয়েছে কি না জানিনা)। অতীতে ফরেন ফ্ল্যাগের জাহাজে মিক্সড ক্রু ছিলো। বাংলাদেশী, পাকিস্তানি বা অন্যান্য মুসুলমান অফিসার বা ক্রুরাও ছিলো। হয়তো কেউ করেছে, কিন্তু আমি বুঝিনি বা টের পাই নি।

 

দেখে শুনে ভালেমানুষগুলোকেই এনেছি। এদের সাথে ভয়েজ করেছি কয়েকটা। সেই সিংগাপুর থেকে অস্ট্রেলিয়া। সেখান থেকে কার্গো নিয়ে চিটাগাং, আমার সিংগাপুর, মালয়শিয়া, কোরিয়া হয়ে মিডল-ইস্ট। কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব ওমান আর দুবাই ঘুরে আবার সিংগাপুর হয়ে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা পোর্ট। কারো ভেতর এসব পাগলামো দেখিনি, অথচ জাকার্তায় আসার পর বিয়েশাদী শুরু হয়ে গেলো। তা-ও আবার প্রাচীন আইয়ামে জাহিলিয়া আমলের নিকাহ্-মুতাহ্। আজিব কাজ-কারবার!

 

শীপ জেটিতে থাকলে যতখানি সম্ভব ঘুরে বেড়িয়ে, এক্সপ্লোর করে সময় কাটাই। জাকার্তা বিশাল এক মেগাসিটি। বহু কিছু দেখার, ঘোরার আর শেখার আছে। শপিংএর জন্যেও আদর্শ, জিনিষপত্রের দাম সিংগাপুর, মালয়শিয়া বা অস্ট্রেলিয়ার মত আজাইররা এক্সপেন্সিভ না। সত্যি কথা বলতে বিশাল ব্যাস্ত রাজধানী শহর জাকার্তা চার ভাগের একভাগও ভালোমত দেখতে পারিনি অথচ যাবার সময় হয়ে গেলো।

 

জাহাজ জেটি ছাড়লো, আবার বিশাল সমুদ্র। গন্তব্য দক্ষিন কোরিয়া। ওয়েষ্টার্ন প্যাসিফিক ধরে উপর (NorthEast) দিকে যাবে। সাউথ চায়না সী, তাইওয়ান স্ট্রেইট (প্রণালী), ইষ্ট চায়না সী, ইয়েলো সী তারপর পোর্ট অফ ইনচোন যেটা রাজধানী সোউল থেকে কাছে। টাইফুনের সিজন চলছে কিন্তু কোর্সলাইনের ডানে বোর্ণিও আইলআন্ড আর ফিলিপিন্স যতক্ষন থাকবে সমুদ্র মোটামুটি শান্ত পাওয়া যাবে। তাইওয়ান স্ট্রেইট থেকে বাকি রাস্তা আছাড়-পিছাড় খেতে খেতে যাওয়া লাগবে।

 

বোর্ণিও আইল্যান্ডের চার ভাগের তিন ভাগ ইন্দোনেশিয়ার। বাকি এক ভাগের নয় ভাগ মালয়শিয়ার, এক ভাগ হচ্ছে ছোট্ট অথচ খুব ধনী রাষ্ট্র ব্রুনেই। ইন্দোনেশিয়ান পার্টের নাম কালিমান্তান। সাবাহ্, সারাওয়াক আর লাবুয়ান নিয়ে মালয়শিয়ান পার্ট। আর ব্রুনেই হচ্ছে ব্রুনেই। তিরতির করে নীল সাগরের বুক চিরে এগিয়ে যাচ্ছে জাহাজ। ভিজিবিলিটি ক্লীয়ার। মাইলের পর মাইল স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। প্রচুর বাহারি ইন্দোনেশিয়ান ফিশিং বোট। প্রতিটি ফিশিং বোটের পেছন পেছন উড়ছে সী-গাল, এ্যালবাট্রস আর আরো নাম না জানা সামুদ্রিক পাখীর ঝাঁক। আশেপাশে ডলফিনেরা ইতিউতি ডাইভ দিচ্ছে। একসাথে তিন, ছয় কিংবা নয়টা। অসম্ভব সুন্দর আবহাওয়া আর পরিবেশ সাগরের বুক জুড়ে। বোঝা যাচ্ছে আবহাওয়া আগামী কয়দিন ভালো থাকবে। ডান দিকের উইংয়ে দাঁড়িয়ে দুরের বোর্ণিও আইল্যান্ডের সবুজ বন আর চোখ জুড়ানো সুন্দর পাহাড় চুড়োর দিকে তাকি ভাবছি ওটা নিশ্চই মাউন্ট কিনাবালু। ব্রীজে ডিউটিতে সেকেন্ড অফিসার। অটো পাইলট এ্যাংগেজড, তবু রাডার অন করে চোখ কান খোলা রাখতে হচ্ছে আশপাশের ফিশিং বোটগুলোর কারনে। ওগুলো বেশী কাছে চলে এলে কন্ট্রোল হাতে নিতে হবে, যদিও সম্ভাবনা কম। ওদেরও রাডার আছে। ওসব বাদ দিলে এখন অলস দুপুর, জাহাজ সী তে থাকলে এসময়ে সেকেন্ড মেটের সাথে খোশগল্প করে সময় কাটাই।

“মুতা মেরিজ মানে কি?” জিজ্ঞেস করতেই হেসে উঠলো সেকেন্ড অফিসার।

“ওরে বাবা, আপনার কাছেও খবর চলে গেছে?”

“খবর চলে গেছে বললে কম হবে, আমার কাছে চীফ আর সেকেন্ড কুক গলায় বিয়ের মালা পরে হাজির। এক্কেবারে কেবিনের সামনে। কথা নাই বার্তা নাই বাপের বয়সি দুই বুইড়া আমার পা ধইরা সালাম করে বসে।”

হাসতে হাসতে সেকেন্ড অফিসার পরে যা বললো, শুনে আমি আরো অবাক। জাহাজের ক্রুদের অনেকেই নাকি গেছে। এসব দেখে সেকেন্ড অফিসার অভ্যস্থ, তার গা সওয়া হয়ে গেছে।

 

কিন্তু আমার কষ্ট অন্য যায়গায়। ভণ্ডামীর আর কত নমুনা দেখতে হবে ছোট্ট এই জীবনে?

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Post comment