নটিং হিল কার্নিভাল ২০১৮। নটিং হিল, লন্ডন।

 

দশ লক্ষাধিক মানুষের সমাগমে উদযাপিত হয়েছে এবারের নটিং হিল কার্ণিভাল। লাখ লাখ মানুষ দারুন সব পোষাক পরে শোভাযাত্রার সাথে বাঁশী, ব্যান্ড, উদ্দাম নাচ আর উম্মাদনা নিয়ে দিনব্যাপী এই আনন্দ মিছিলে অংশ নেয়। বোববার ২৬ অগাস্ট চিলড্রেন, সোমবার ২৭ অগাস্ট (ব্যাংক হলিডে) প্রধান কার্নিভালে অংশগ্রহনকারী দর্শনার্থি সবমিলে ছিলো দশ লাখেরও উপরে। সোমবারের প্যারেডে প্রায় পনের হাজার ডিজাইনের উজ্জ্বল সব ড্রেস/কস্টিউম পরে উৎসবে মেতে ওঠে ওয়েষ্ট ইন্ডিজ বেইজড্ এই কার্নিভালের অংশগ্রহনকারীরা। কনসার্ট অন হুইলস্ – লরীর উপর শক্তিশালী কনসার্ট সাউন্ড সিস্টেমে ছিলো লাইভ মিউজিক, অত্যন্ত ধীর গতিতে কার্নিভালে নটিং হিলের অলিগলিতে প্রদক্ষিন করেছে নাচে আর গানে। মেতেছে সবাই ক্যালিপসো, র‍্যাগে, আর সালসা মিউজিকে। উপরি পাওনা হিসেবে ছিলো আফ্রিকান মিউজিক। লন্ডনের নটিং হিল এলাকায় অগাস্টের শেষ সোমবার এই বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা উদযাপিত হয়ে আসছে ১৯৬৪ সাল থেকে। সেদিন ইংল্যান্ডে থাকে সরাকরী ছুটি অর্থ্যাৎ ব্যাংক হলিডে।

.

এক সময় এই কার্নিভাল শুধুমাত্র ওয়েষ্ট ইন্ডয়ান ইমিগ্র্যান্টদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো। তখন নটিং হিলের ল্যাডব্রোক গ্রোভ (Ladbroke Grove) এলাকায় এই শোভাযাত্রা হত এখন গোটা নটিং হিল এলাকায় সুবৃহৎ পরিসরে অনুষ্ঠিত হয়। ক্রমে এটা পরিনত হয় ক্যারিবিয়ান বর্ণিল আনন্দ মিছিলে যেখানে সবাই যেমন খুশী সেজে অংশ নেয় বাদ্য-বাজনা, নানান ধরনের ভেঁপুবাঁশী, আনন্দ-চীৎকার আর নৃত্যের তালে তালে। সাথে থাকে শক্তিশালী সাউন্ড সিস্টেম এবং বিখ্যাত ক্যারিবিয়ান স্টিল ড্রামতো আছেই।

.

এতো বিশাল জনমাবেশকে কেন্দ্র করে নিরাপত্বা ব্যাবস্থারও কমতি ছিলো না। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে পাঠানো হয় সাত হাজার ইউনিফর্ম পরা পুলিশ, হর্স গার্ড আর অগণিত আন্ডারকভার পুলিশ। সাথে দুটি হেলিকাপ্টার আকাশে। প্রতিটি রাস্তায় আরো ছিলো এ্যাম্বুলেন্স আর ছোট হাসপাতাল (Treatment Centre)।

.

বিগত বছরগুলোতে নটিং হিল কার্ণিভাল ক্রমে আরো বড় আকার ধারন করেছে। এখন এটা ত্রিনিদাদিয়ান বা ক্যারিবিয়ান নয়, সারা বিশ্বের সকল জাতি তাদের সংষ্কৃতি তুলে ধরতে পারে এই মিছিলের মাধ্যমে। গোটা লন্ডনের মাল্টিন্যাশণাল কালচারের প্রতিফলন দেখা যায় এখানে। দলে দলে অংশ নেয় আফগান, কুর্দি, বাংলাদেশী, ফিলিপিনো, বুলগেরিয়ান, রাশান, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান, ব্রাজিলিয়ান, আফ্রিকান, ক্যারিবিয়ানস্, মধ্য ও দক্ষিন আমেরিকান, ইউরোপিয়ান (ইস্ট এন্ড ওয়েস্ট), স্কটিশ, ওয়েলশ্ এবং ব্রিটিশ জনগণ।

.

রং বেরংয়ের পোষাকসহ বাঁশী, সোকা, স্টিল ব্যান্ড, ফুল মিউজিক ব্যান্ড সেটআপ আর সাউন্ড সিস্টেম নিয়ে দলে দলে ভাগ হয়ে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার পথ প্রদক্ষিন করে এই মিছিল। শুরু হয় বেলা এগারোটার দিকে এবং চলে সন্ধ্যা আট টা পর্যন্ত। চলমান (On the wheel) সাউন্ড সিস্টেমের পাশাপাশি কমপক্ষে আরো ৪৫টি সাউন্ড সিস্টেম বিভিন্ন স্থানে রয়েছে যার মাধ্যমে বিশেষভাবে প্রাধান্য পায় সোকা, র‍্যাগে, জ্যাজ, সোউল, হিপ-হপ্ এন্ড ফাঙ্ক, হাউজ, গ্যারেজ ইত্যাদি। যে কোন ধরনের পোষাক আর সঙ্গীত নিয়ে যে কোন দল এখানে অংশ নিতে পারে। এক্ষেত্রে কোনো প্রকার বাধ্যবাধকতা রাখা হয় নি। আরো থাকে সব ধরনের ড্রিংকস আর পাগল করা বার-বি-কিউ। সারা বিশ্বের ট্যূরিষ্টদের বিশেষ আকর্ষণ এই নটিং হিল কার্নিভাল।

.

ত্রিনিদাদ থেকে লন্ডন:

আঠারো’শ শতকের গোড়ার দিকের কথা। কলোনিয়াল রাষ্ট্র ব্যাবস্থা আর নোংরা বর্ণবাদের রমরমা সংষ্কৃতি তখন সারা দুনিয়া জুড়ে। ক্যারীবিয় দ্বীপরাষ্ট্র ত্রিনিদাদে তখনও দাসপ্রথা পুরোদমে চলছে। সে আমলে কালো বা রঙ্গীন (Black or Coloured, সাদা ইংরেজদের ভাষায়), যারা কিনা দাস ছিলো, তাদের কোনো প্রকার বাদ্যযন্ত্র বাজাতে দেওয়া হত না। এমনকি দাসদের নিজেদের পছন্দমতো পোষাক পরার স্বাধীনতা ছিলো না। দাসদাসীদের সন্ধ্যার পর বের হওয়া নিষেধ ছিলো, বিশেষ প্রয়োজনে মণিব ওদের সাথে নিলে তবেই বেরুতে পারতো।

.

১৮৩৪ সালে যখন এই নোংরা আইন অন্যায্য এবং বাতিল ঘোষণা করা করে দাসপ্রথা উচ্ছেদ করা হয় তখন আনন্দিত ত্রিনিদাদিয়ান দাসেরা দলে দলে রাস্তায় নেমে ইচ্ছেমতো নেচে গেয়ে, ভেপূঁ বাঁশী-বাদ্য বাজিয়ে স্বাধীনতার স্বাদ নেয়। এতোদিনে সাদা মণিবেরা কোনো প্রকার বাদ্যযন্ত্র শেখার বা বাজাবার অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখেছিলো। তাতে কি? যে যেভাবে পেরেছে গোপনে শিখেছে। শুধু তাই নয়, স্থানীয়রা মুখে সাদা রং মেখে, স্যূট-টাই লাগিয়ে বা স্কার্ট-হ্যাট পরে কিম্ভুত সাজে সাহেব-বিবিদের অণুকরন করে পথে পথে মার্চ করে। অর্থাৎ, “দেখো, শয়তানগুলো দেখতে কি কিম্ভুত!” আঠারো’শ শতকের সেই দিন থেকে প্রতিবছর ত্রিনিদাদে কার্ণিভালের মাধ্যমে মুক্তির সেই দিন স্মরণ করা হয়ে আসছে।

.

পঞ্চাশের দশকে (১৯৫০-৬০) ত্রিনিদাদিয়ান অভিবাসীরা লন্ডনের নটিং হিল এলাকায় বসতি গড়ে তোলে। যদিও আজকের নটিং হিল লন্ডনের অত্যন্ত ধণী, নামকরা এলাকা। এটা সে আমলে দরিদ্র, কালো অধ্যূষিত এলাকা ছিলো যখানে হিংসা হানাহানি ছিলো নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। ত্রিনিদাদিয়ান অভিবাসীরা যে উন্নত জীবনের আশায় আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে এতোদুর এসেছিলো বাস্তবতা ছিলো ভিন্ন। প্রকাশ্য বর্ণবাদ, বৈষম্য, নিম্নমানের ঘরবাড়ী আর উগ্রবাদী শেতাংগদের মুর্মূহুর্ত হামলার ভেতর দিয়ে কাটছিলো তাদের জীবন। আফ্রিকা আর ক্যারিবিয়ান অভিবাসীদের নাচ নর্থ লন্ডনের হলগুলোতে সীমিত আর ক্যারিবিয়ান স্টীল ব্যান্ড মিউজিক শুধুমাত্র আর্লস্ কোর্ট এলাকার কোলহিয়ার্ন (Colherene Pub) পাবে প্রতি রোববার বাজাতে দেওয়া হত। যাই হোক, ১৯৬৪ সালে ছোট পরিসরে শুরু হওয়া এই ত্রিনিদাদিয়ান শিশু শোভাযাত্রা আজ রূপ নিয়েছে বিশ্বের অন্যতম বিশাল সাংষ্কৃতিক সড়ক-অনুষ্ঠানে যেখানে সবাই জাত-বর্ণ নির্বিশেষে আনন্দ ফুর্তিতে মেতে ওঠে।

.

নটিং হিল কার্ণিভাল ইউরোপের সবচেয়ে বড় তথা বিশ্বের দিত্বীয় বৃহত্তম আনন্দ মিছিল। বিশ্বের সবচেয়ে বড় কার্ণিভাল হয় ব্রাজিলের রিও তে (Rio De Janeiro)। অতীতের যে কোনো কার্ণিভালের চেয়ে এবার অনেক বেশী পুলিশের উপস্থিতি ছিলো লক্ষনীয়। সাত হাজার রেগুলার পুলিশের সাথে পাঁচশত ট্রান্সপোর্ট পুলিশ, ঘোড়সাওয়ার, দুর্ধর্ষ গন্ধ-সংবেদনশীল কুকুর (Sniffer Dogs) এবং সেন্ট্রাল লন্ডনের অগণিত সিসিটিভি ক্যামেরার সাথে আরো শ’ খানেক ক্যামেরা কার্ণিভাল এলাকায় অপারেট করানো হয়। ক্রমবর্ধমান ছোরা সন্ত্রাস (Knfie Crime) আর গ্যাং ক্রাইমের মধ্যে দুইদিন ব্যাপী ইউরোপের সবচেয়ে বড় এই অকুতোভয় গণজমায়েতে পুলিশের সিকিউরিটি ব্যাবস্থা ছিলো অভাবনীয়। আগাষ্টের এই চমৎকার উষ্ণ দিনে উপস্থিত জনসাধারণের সুবিধার জন্যে বিশেষ বিশেষ ব্যাবস্থার মধ্যে ছিলো হাজার হাজার টয়লেট, পিসোয়ের (প্রস্রাবখানা), প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র, নিখোঁজ সংবাদকেন্দ্র ইত্যাদি। নটিং হিল থেকে নর্থ কেনসিংটন, ল্যাডব্রোক গ্রোভ এলাকা হয়ে কেনসাল টাউন এবং ওয়েস্টবোর্ণ পার্ক এলাকার রাস্তাগুলোতে শোভাযাত্রা আর গণজমায়েতের কারনে গাড়ী চলাচল করতে দেওয়া হয় নি।

.

পুরো অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে শান্তিপূর্ণভাবে। বিচ্ছিন্ন ছোটখাট ঝামেলা ছাড়া বড় কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Post comment