সাউথ কোরিয়ায় কতবার গেছি বলতে পারবোনা। তবে যতবার গেছি কখনো বোর হইনি। ঈর্ষা করার মত উন্নত, পরিচ্ছন্ন, সুন্দর, গোছানো আর প্রানচাঞ্চল্যে ভরা দেশটিকে ভালোও বেসেছি। কোরিয়ার আনাচে কানাচে, বড় বা ছোট শহর, কিংবা গ্রামে যেখানেই গেছি প্রনভরে উপভোগ করেছি সময়। তার উপর উত্তর কোরিয়াতে যেতে পেরে ধন্য লেগেছে নিজেকে। হতদরিদ্র, পশ্চাৎপদ অথচ কঠোর পরিশ্রমী ভালোমানুষগুলোকে দেখে মনটা মায়ায় ভরে যায়। একই মানুষ, একই ভাষা, একই সমাজ, একই জলবায়ু অথচ দুই মেরুর জনগোষ্ঠির জীবন মানের পার্থক্য যোজন যোজন। রাজনৈতিক মতাদর্শের পার্থক্যের ঘানি টানছে ভালো মানুষগুলো। 

দক্ষিন এবং উত্তর করিয়া। থার্টি এইট ডিগ্রী প্যারালাল নর্থ বা ৩৮ ‘উঃ’ ডিগ্রী সমান্তরাল অক্ষাংশ, দুই কোরিয়ার সীমান্ত। চীরস্থায়ী ক্ষত। লক্ষ লক্ষ মানুষের বিচ্ছেদের কান্না। আজ এতবছর যখন দেখি ওদের এক হবার সামান্য সম্ভাবনাও আছে, ওদের আবেগের সাথে নিজেও আবেগাপ্লুত হই। অনেকদিন আগের আবেগময় একটি লেখা দিয়ে আবার সেটা প্রকাশ করতে ইচ্ছে হল।

 

×××××××××××××××××××××××

আজুম্মা! পোর্ট অফ কোয়াংইয়াং

সাউথ কোরিয়ান যে কোন শপে ঢুকে প্রথমে দেখি দোকানী পুরুষ নাকি মহিলা। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই হয় মহিলা, আর তখন অবধারিতভাবে খানিকটা চীৎকার করে এই শব্দটা উচ্চারণ করি। যুবতীরা এই শব্দটা আশা করেনা, কিন্তু আমি বলি, বলতে মজা লাগে। এর মানে হচ্ছে ‘খালাম্মা বা খালামণি’। সবখানেই মহিলা বা মেয়েরা একটু অবাক হয়ে স্থানীয় ভাষায় কথা বলতে শুরু করে, আর তখন আমি মুচকি হেঁসে বোঝাই আমার ভাষার দৌঁড় ওইটুকুন, আর নয়। যে কোন দেশে গেলে সবার আগে অতি প্রয়োজনীয় কিছু শব্দ বাক্য শিখে নিতে হয়। যেমনঃ ‘শুপ্রভাত’, ‘শুভ-সন্ধ্যা’, ‘তোমার নাম কি?’, ‘আমার নাম আফলাতুন’, ‘তুমি দেখতে সুন্দরী’, ‘আই লাভ ইউ’ এবং কিছু স্থানীয় গালিগালাজ। 

এই ভয়েজে খুব বেশী সাউথ কোরিয়া আসা হচ্ছে। জাহাজের মালিক সাউথ কোরিয়ান তো! আমাদের রুট হচ্ছে এশিয়া-প্যাসিফিক আর ফার-ইস্ট। ভৌগলিকভাবে সাউথ কোরিয়ার পুসান (কিংবা বুসান) পোর্ট সুবিধাজনক হওয়াতে ট্রানজিট হিসাবে এর ব্যাবহার হচ্ছে অহরহ। দুনিয়ার প্রায় সবখানথেকে কোরিয়ানরা কাঁচামাল আমদানী করে। রফতানীর পরিমান যে কি, তা টিভি দেখে বা শপিংএ গিয়ে বোঝা যায়। প্রথম প্রথম মনে হবে আচার আচরণে কোরীয়রা একেবারে জানোয়ার। আসলে ওটাই ওদের স্বাভাবিক আচরণ। আমরা বলি কুত্তা স্বভাব। কুত্তা ওদের প্রিয় খাদ্য। ভালোমত জানতে বুঝতে পারলে কোরিয়ানদের সাথে চমৎকার বন্ধুত্বও হয়ে যেতে পারে। সত্যি কথা বলতে কি, পৃথিবীর অন্য যে কোনো জাতির মত বাংলাদেশীদের প্রতি কোরিয়ানদেরও ভালোবাসা বা শ্রদ্ধাবোধ নেই। এতোগুলো দেশ ঘুরলাম, বাংলাদেশী শুনলেই বিদেশীদের মুখখানা কেমন যেন হয়ে যায়। এদিকে কোরিয়ানরা বাংলাদেশে ভালোই বিনিয়োগ করে বলে খবরাখবরও রাখে। একবার পুসান সিটিতে, বাংলাদেশী শুনে এক কোরিয়ান বলে, “হোর-তাল, হোর-তাল, জয়-জয়, হোর-তাল, নো অফিস, নো কারস, নো শপিং হোর-তাল।” এরপর পিস্তলের ভঙ্গিতে আমার দিকে আঙ্গুল তুলে বলে, “কারেক্ট?” আড়ষ্ঠভাবে বললাম, “আঁ-হাঁ!” হাঁসতে হাঁসতে পেটে হাত দিয়ে কুঁজো হয়ে গেলো। মানুষ জমে গেছে, তাদেরকে সে ওদের ভাষায় বাংলাদেশের দুরবস্থার কথা বলছে আর বাংলাদেশী হিসাবে আমাকে দেখাচ্ছে আঙ্গুল দিয়ে। এতো কঠিন মানুষ ভাবি নিজেকে অথচ কোনোভাবেই চোখের পানি আটকে রাখতে পারিনি। খুব খারাপ লাগছিলো, অবশ্য ঐ কোরিয়ান আমার কাছে বার বার ক্ষমা চেয়েছিলো এবং পেছন পেছন হেঁটেছিলো অনেক্ষন। আমি কথা বলতে পারছিলাম না। সে বলে যাচ্ছিলো,

“আই ওয়াজ ইন ছিতাগং ফর ফাইভ এন্ড হাফ মান্থস্, বাংকলাদেইশী পিপোল ভেরী গুড এ্যান্ড ভেরী কাইন্ড। বাট প্রবলেম ইজ পলিটিশিয়ানস্। দে নো(know) অনলি ওয়ান থিং, হোর-তাল। আই এ্যাম ভেরী সরি মাই ফ্রেন্ড, প্লীজ ডোন্ট বি আনহ্যাপি।” বাংলাদেশকে ওরা বলে বাংকলাদেশ। 

দক্ষিন চীনের ঝানজিয়াং থেকে তাইওয়ান স্ট্রেইট হয়ে ছয় দিন পর এসে পৌঁছলাম দঃ-কোরিয়ার কোয়াং ইয়াং পোর্টে। আলাদাভাবে বললে কিন্তু হবেনা, উচ্চারণ করতে হবে একদম দ্রুত একটুও না থেমে এভাবে – কোয়াঙইয়াং। বিশাল স্টিল মিলের জেটির এক পাশে আমাদের জাহাজ। যেহেতু শিল্প এলাকা, শহর থেকে বেশ খানিকটা দুরে। ঘন্টাখানেকের ড্রাইভ। তারপরও অনেকগুলো পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে গড়ে তোলা নতুন এই শিল্প এলাকার যেদিকে চোখ যায়, দুচোখ ভরে যায়। হাতে গড়া বলে বিশ্বাসই হতে চায় না, মনে হয় পুরোটাই প্রাকৃতিক। 

জেটি-গেটের মুখে আছে কাস্টম/ইমিগ্রেশন চেক পয়েন্ট, সিকিউরিটি পুলিশ বক্স, বেশ কটা পাবলিক পে-ফোন বুথ। একটু পাশে একটা দোতলা ঘর, নীচতলায় সিঁড়ি, বাঁ দিকে মাঝারি একটা ডিপার্টমেন্টাল শপ। সিঁড়ির ডানে একটা ছোট ইলেক্ট্রনিকস্ শপ, তার ডানে রেষ্ট্যূরেন্ট। দোতলায় সিঁড়ির বাঁয়ে আবার রেষ্ট্যূরেন্ট আর ডানে গেম রুম, পিংপং, তাস দাবা এসব খেলার জন্য। র‍্যাকে প্রচুর বই সেগুলো প্রোটেষ্ট্যান্ট খ‍্রীষ্ঠ ধর্মীয়। পুরো বিল্ডিংটা আসলে স্হানীয় এক প্রোটেষ্ট্যান্ট বিশপের। সন্ধ্যায় চুটিয়ে পিংপং খেলে আমরা দোতলার রেষ্ট্যুরেন্টে খেতে যেতাম। স্থানীয় খাবার কেউ মুখেও তুলতে পারতাম না। শুধু সফট্ ড্রিংকস খেয়ে চলে আসতাম। রেষ্ট্যূরেন্টটা বিশাল, হলরুমের মতো, অনেক চেয়ার টেবিল, পিলারের গায়ে গায়ে টি.ভি. চলছে একদম কম শব্দে। কাষ্টমার নেই-ই বলা চলে, এই বিশাল রেষ্ট্যূরেন্ট চালাচ্ছেন মাঝবয়েসি দুজন মহিলা। আইটেমও প্রচুর। রেডি স্টক আছে কোমল পানীয়, বীয়ার, স্কচ, স্থানীয় মদ, কোরিয়ার সবচেয়ে কঠিন চোলাই ‘সজু’, নানা ধরনের চিপস্, রাইস (স্টিকি রাইস, আমাদের দেশের মত ঝরঝরে নয়, কাঠি বা চপস্টিকস্ দিয়ে তুলতে হয়), চিকেন, শ্রিম্প, বীফ, পর্ক, ভেজিটেবলস্, এবং সব ধরনের কিমচি। কিমচি কোরিয়ানদের অসম্ভব প্রিয় এক ধরনর ঝাল চাটনী, যা ছাড়া ওরা লাঞ্চ বা ডিনার করার কথা কল্পনাও করতে পারেনা। ভেজু-কিমচি আমার সবচেয়ে প্রিয়। আমি বিভিন্ন দেশের খাবার পরখ করতে খুব পছন্দ করি। অবশ্যই হারাম এ্যাভয়েড করে। আমাদের উপমহাদেশ আর পূর্ব এশিয়ার হাতেগোনা কটি দেশ ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও হাত দিয়ে ভাত খাবার রেওয়াজ নেই। আরবরা হাত দিয়ে খায় বটে, তবে ডাল ঝোল এসব থাকেনা বিধায় গায়ে গায়ে হয়ে যায় না। ফার ইস্টার্ন অর্থাৎ বোঁচা নাকওয়ালা গোষ্ঠীর সবাই কাঠি ব্যাবহার করে। চপস্টিকস্। আমাদের হাত দিয়ে খাওয়া দেখলে ওরা কেমন যে করে সেটা বলে বোঝানো যাবেনা। যাই হোক, কাঠি দিয়ে খাওয়া শিখেছিলাম চায়না থেকে, ওরা আমাকে কাঠি দিয়ে ভাজা বাদাম তুলতে লাগিয়ে দিতো। কি যন্ত্রনা! এখন মাশাল্লাহ্ ভালোই পারি। আমার এখনো মনে পড়ে অনেক কিছুর অর্ডার দিয়েছিলাম আমরা। মাত্র দুজন আজুম্মা বিভিন্ন ডিশ আনতে নিতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। ইংরেজী বোঝেন না এক বর্ণও। আর সেই সুযোগে আমি কোরিয়ান ভাষার প্র্যাকটিস চালিয়ে যাচ্ছিলাম। ওদের ভাষায় বাবা হচ্ছে ‘আ-বু-জি’ বা অপ্পা (কথ্য), মা হচ্ছে ‘ও-মো-নি’ বা ওম্মা (কথ্য)। রাইস হচ্ছে ‘বাপ্’। কিছু কিছু শব্দ বাংলার সাথে মিলে যায়। 

কোরিয়ানদের আমি বলি ফার ইষ্টের নোয়াখাইল্লা। অবিকল নোয়াখাইল্লা এ্যাকসেন্টে ওরা কথা বলে। (আমার বাড়ি ফেণী।) দুজন আজুম্মার মধ্যে একজন বেঁটে, আরেকজন লম্বা। ওদের আমি বুঝিয়ে বলছিলাম কিভাবে আমাদের ডিশগুলো রান্না করবে। ওদের স্টাইলে বানালে গন্ধে কেউ খাবার মুখে তুলতে পারবেনা। মাঝেমধ্যে আমিও কিচেন রুমে যাচ্ছিলাম। তারপরও আমি ছাড়া কেউ তেমন খেতে পারলোনা। আসলে খেতে জানলে শুধু কিমচি দিয়েও অনায়েসে দুপ্লেট ভাত খেয়ে ফেলা যায়। ওদের ভেজিটেবল স্যূপ অতুলনীয়। প্রতি সন্ধ্যায় আমি ওখানে যেতাম। ওদের সাথে খুব গল্প করতাম। প্রচুর কথেপকথন হত, তবে নব্বই ভাগই আন্দাজে বুঝে নিতাম। ওরা ধরে নিয়েছে আমি কোরিয়ান ভাষা ভালো বুঝি। কারন একটু আধটু যা বলি বলি নিখুঁত লোকাল একসেন্টে। ফেণীর ছেলে তো! নোয়াখাইল্লা একসেন্টে কথা বলা আমার জন্মগত যোগ্যতা। 

লম্বা আজুম্মা আমাকে ভালোবেসে ফেললেন। আমার মায়ের কথা জানতে চাইতেন। ভাই বোন কোথায়, কি করে, আমার মা কি ধরনের জামা পরেন। বাবার অবর্তমানে মা কিভাবে সংসারে কর্তৃত্ব দিচ্ছেন এসব। আমার মাকে কি কোরিয়া আনা যাবে? আমার কাছে কারো ছবি ছিলোনা। জাহাজে কখনোই আমি পরিবারের কারো ছবি রাখিনা। আজুম্মা অবাক। ‘সবাইকে ছেড়েছুড়ে থাকো, ছবি রাখোনা! দেখতে ইচ্ছে হয় না?’ আমি বলি আমার কান্না পায়, আজুমমা হাঁসেন – হয়তো ভাবেন, কি অদ্ভুত রে বাবা! তাঁর এক মেয়ে দুই ছেলো। ছেলে দুটো মী-গুক্ -এ পড়াশোনা করে। মী-গুক মানে ইউ.এস.এ। একমাত্র মে পড়ে সোউল এ। এক দুপুরে তিনি তাঁর বাসায় নিয়ে গেলেন। অবিরাম বর্ষা তখন, যেন আমাদের শ্রাবণ মাস। গাড়ীতে করে আজুম্মা আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন, আমি মুগ্ধ হয়ে রাস্তার দুপাশ দেখছি। কখনো পাহাড়, কখনো ধানক্ষেত, শুধু সবুজ আর সবুজ। রাস্তার ধারে সবগুলো ঝোপঝাড় ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে। ছোট্ট শহর কোয়াংইয়াং। রাস্তা, ফুটপাথ, অবধারিত ফুলবাগান, তারপর অফিস, দোকান নয়তো বাড়ী। একটু দুরে পাহাড়ের সারি। গাঢ় সবুজ। বৃষ্টি যেন গভীর মমতায় পুরো শহর ধূয়ে দিয়েছে।

আজুম্মার বাড়িটা ছোট। শোয়ার ঘর, বসার ঘর, বড়সড় রান্নাঘর কাম ডাইনিং আর একটা বারান্দা। পরিপাটি করে সাজানো। উপরে তিনটা বেডরুম, ছেলে মেয়েদের। কফি খেতে খেতে আজুমমার পরিবারের সবার ছবি দেখলাম। এরপর শপিংএ গেলাম, আরো কিছুক্ষন গাড়ী করে শহরটা দেখিয়ে আজুম্মা আমাকে জেটিতে পৌঁছে দিলেন। পরদিন খুব ভোরে আমরা বন্দর ছেড়ে গেলাম। আজুম্মাকে বিদায় জানানো হলনা। প্রচন্ড মন খারাপ লাগলো। কি বোকা আমি, আজুম্মার ফোন নাম্বারটা রাখিনি। তাহলে জাহাজ থেকেই তো কথা বলা যেতো। 

সৌভাগ্য আর কাকে বলে। ঠিক এক মাস পর আবার সাউথ কোরিয়া, পোর্ট অফ কোয়াংইয়াং। আনন্দে আমর দম বন্ধ হয়ে আসছে। আজুম্মার সাথে দেখা হবে। একটু অবাকও লাগছে, আজুম্মার জন্যে এত উতলা হচ্ছি কেন? শেষ বিকেলে এক দৌড়ে আজুম্মার রেষ্ট্যূরেন্টে গিয়ে হাজির। আমার ডাক শুনে হন্তদন্ত হয়ে কিচেন থেকে বেরিয়ে এলেন দুজনই। লাম্বা আজুম্মা আর বেঁটে আজুম্মা। আমি দুহাত জোড় করে বললাম দুঃখিত। লম্বা আজুমমা তাঁর দুহাত দিয়ে আমার গাল ধরে দুদিকে মাথা নেড়ে বললেন, ‘দুঃখিত হবার কিছু নেই, তোমাদের কাজইতো এমন।’ আমাকে বসালেন। বেঁটে আজুম্মা নিয়ে এলেন আমার প্রিয় হুং-ছা, মানে রং-চা। চা কে ওরা বলে ‘ছা’। বাংলার সাথে অদ্ভুত মিল তাই না? আজুমমা আমাকে বললেন,

– “তুমি জাহাজে থাকো, তোমার কষ্ট হয় না?”

– “ভালোও লাগে, আবার কষ্টও হয়, সব মিলিয়ে।”

– “আমাকে আজুম্মা ডাকবেনা, বলো ওম্-মা।”

আগেই বলেছি, ওম্মা মানে ‘মা’। বললাম,

– “দেশেতো আমার মা আছেই, তাই তুমি আজুম্মা।”

– “ওটা বাংকলা ওম্মা, আমি হান-গুল ওম্মা।” (হানগুল মানে কোরিয়ান)

– “জাহাজের চাকরী বাদ দাও, তুমি আমার কাছে থাকো।”

– “এটা কখনো হয় নাকি, জাহাজে আমি কতো সম্মান নিয়ে আছি, আর এখানে হবো বিদেশী লেবার, তাও অবৈধ।”

– “অবৈধ না অবৈধ না, আমি কোরিয়ান। তুমি আমার ছেলে তুমিও কোরিয়ান, সরকারের কি করার আছে?”

– “কালই আমরা চলে যাচ্ছি।”

– “এবার কোথায় যাচ্ছ?”

– “চুং-গুক্ তারপর চোসন” 

‘চোসন?’ বলে আজুমআমা চিৎকার করে উঠলেন। মুহুর্তে তাঁর দুচোখ ভিজে জবজবে হয়ে উঠলো। একবার বেঁটে আজুম্মার দিকে অসহায়ভাবে তাকালেন, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে আমার দুটো হাত চেপে ধরলেন। বেঁটে আজুম্মাও কেমন যেন অস্থির। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলামনা, দুজনে এতোই উৎকন্ঠিত যেন আমার মরণ হবে। 

চুং-গুক্ মানে চীন আর চোসন মানে নর্থ কোরিয়া। দুই কোরিয়াকে একসাথে বলা হয় হান-গুক্। তারমধ্যে দক্ষিনকে বলে দে’হান আর উত্তরকে বলে চোসন। দক্ষিন কোরিয়ানরা মনে করে উত্তরে মিলিটারিরা দেশ চালায়। মানুষের কোনো নিরাপত্তা নেই, খাওয়া নেই দাওয়া নেই কিচ্ছু নেই। আছে শুধু সোলজার্স, সবসময় তাদের বন্দুক লোডেড থাকে। পান থেকে চুন খসলেই ফায়ার। দুহাত দিয়ে আমার গালে আদর করে অশ্রুসজল নয়নে আমােকে বিদায় দিলেন। আজুম্মাকে আমি বোঝালাম এর আগেও আমি নর্থ কোরিয়া গিয়েছিলাম। কোনো সমস্যা হয় নি। তিনি মানতে নারাজ। যাকে দেখছেন তাকেই বলছেন, “এই ছেলে চোসন যাচ্ছে, কে জানে ফিরবে কিনা।” যারা শুনছে তারাও অবাক হচ্ছে। না ফেরার কি আছে?

সত‍্যিই এক দেশ নর্থ কোরিয়া। লিখতে গেলে অনেক লিখতে হবে। কট্টর সমাজতান্ত্রিক দেশ। আমার মনে হয়েছে সমাজতন্ত্রের নামে সামরিক সরকার সব মানুষকে শ্রেফ দাস বানিয়ে রেখেছে। তার উপর তখন দুর্ভিক্ষ চলছিলো। সেনা শাসিত এই দেশে সকল কর্মকান্ড সোলজাররা চালিয়ে থাকে। অন্ন-বস্ত্র- বাসস্থান-চিকিৎসা-শিক্ষা-নিরাপত্বা সবই সরকার দিচ্ছে। শুনতে ভালোই লাগে। কিন্তু বাস্তবে অন্য চেহারা। সোভিয়েত ইউনিয়নও এক সময় এমন ছিলো। ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। সাম্যের নামে দলন। গত কয়েক বছরের দুর্ভিক্ষে খাদ্য আর পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাবে মারা গেছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। পর্যাপ্ত বস্ত্রও নেই এখন। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নেই। এক শহরের মানুষ অন্য শহরে যেতে পারেনা, যেতে হলে পারমিশন লাগে। একমাত্র টি.ভি. চ্যানেল যাতে সারাক্ষন জেনারেলদের জোরালো ভাষন আর দেশের শক্তির কথা, অস্ত্রের কথা প্রচার করা হয়। পরমানবিক বোমা খেয়ে পেট ভরবে? লিখতে গেলে অনেক লিখতে হবে। দেখি, ভবিষ্যতে চান্স পেলে লিখবো। তবে উত্তর কোরিয়ার অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যাবে না। গরীব হলেও সাধারন মানুষগুলো অসম্ভব সুন্দর এবং বন্ধুবৎসল।

এর মাঝে কেটে গেছে আরো তিনটি মাস। নর্থ কোরিয়ার নাম্-পো তে গিয়েছিলাম ডাব্লিউ.এফ.পি’র ভূট্টা নিয়ে। সাহায্য। রাজধানী পিয়ংইয়াং নাম-পো থেকে কাছেই, দুঘন্টার ড্রাইভ। তারপর আবার চায়না, রাশিয়ার ভ্লাদিভোস্তক, জাপান, তাইওয়ান ইত্যাদি হয়ে আবার সাউথ কোরিয়া এবং পোর্ট কোয়াংইয়ং। নভেম্বর মাস, শীত জেঁকে বসেছে। সকাল সাতটায় জাহাজ জেটিতে ভীড়েছে। ওইতো! কাছেই আজুমমার রেষ্ট্যূরেন্ট দেখা যায় কিন্তু যেতে পারছিনা। বিকেলের আগে ফ্রী হতে পারবোনা। বার বার ওদিকে তাকাই তৃষিতের মতো। ডিনার শেষে ভোঁ-দৌড়। ঠান্ডা পড়ছে বেশ। পুরো রেষ্ট্যূরেন্ট খালি। প্রথমে বেঁটে আজুম্মা কে দেখলাম, জিন্স আর স্যূয়েটার, তার উপর সাদা এ্যাপ্রন। হাঁসিমুখে একটু ঝুঁকে বললাম, ‘আন্ইওংহাসেও’ (সম্ভাষণ)।

বেঁটে আজুম্মা ফ্রোজেন। হতভম্ববের মতো কতোক্ষন চেয়ে থেকে বড় একটা দম নিয়ে চীৎকার শুরু করলেন, ‘শুগাংসী-ই-ই-ই-ই!, শুগাংসী-ই-ই-ই-ই!’। সম্ভবতঃ লম্বা আজুমআমাকে ডাকছেন। কিচেন থেকে লম্বা আজুম্মা ছুটে বেরিয়ে এলেন, তাঁরও গায়ে এ্যাপ্রন। উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন বড় আজুম্মা, কতো কি বলছেন এক বর্ণও বুঝতে পারছিনা, অনুমান করে নিচ্ছি এতোদিন কোথায় ছিলাম, কেমন ছিলাম, চোসনে (উঃ কোরিয়া) কোন সমস্যা হয়নি তো? টলটলে চোখে একবার মুখ ধরছেন, হাত দেখছেন, জ্যাকেটের জিপার খুলে বুক, গলা ধরে দেখছেন। আমি বললাম, ‘আজুম্মা কেমন আছো?’ দুদিকে মাথা নেড়ে বললেন, ‘আজুম্মা নয়, বলো ওম্-মা’। আমি চুপচাপ থাকলাম। ওম্মা বলতে সংকোচ হচ্ছে, কিংবা লজ্জ্বা পাচ্ছি। ইতিমধ্যে বেঁটে আজুম্মা কিচেন থেকে এক গ্লাস হুং-ছা (রং চা) নিয়ে এলেন। মনে রেখেছেন ওটা আমার প্রিয়। অনেক্ষন গল্প করেছি সে সন্ধ্যায়। এরমাঝে খদ্দেররা আসে খেতে। সবাই মোটামুটি পরিচিত। ওদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন, যেন আমি আজুম্মার সন্তান। প্রায় সবাই-ই ইংরেজী বোঝেনা। কোরিয়ান ভাষায় বলতে থাকে, আমিও বুঝে না বুঝে বল আলাপ চালিয়ে যাই। সেবার মাত্র দুই সন্ধ্যা আজুম্মার সাথে গল্প হয়েছে। কতো রকম গল্প। গল্পের ফাঁকে আজুম্মাকে বোঝালাম চোসনে গিয়ে আমার সমস্যা হয় নি। তোমাদের মত ওরাও অবাক হয়েছে আমার কোরিয়ান ভাষার দখল দেখে। দেখতেও তোমাদের মত সুন্দর তবে এত নাদুসনুদুস নয় আর এত এত দামী ড্রেস পরতে পারেনা। তবে এটা সত‍্যি সাধারণ মানুষেরা স্বাধীনতা কি জিনিষ বুঝতে পারেনা। বেঁটে আজুম্মার চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। লম্বা আজুম্মা বললেন ওর দু ভাই ওখানে রয়ে গেছে। সেই ১৯৪৫ এর পর আর কখনো দেখা হয় নি, কথাও হয়নি। জানেইনা ওরা বেঁচে আছে না মরে গেছে। উত্তর আর দক্ষিনের ধাক্কায় এরকম বহু পরিবারের বাঁধন ছিঁড়ে গেছে। 

আজুমমা বলে দিয়েছেন যখনই কোয়াংইয়াং আসি, এক দৌঁড়ে যেন আজুম্মার কাছে চলে যাই। রেষ্ট্যূরেন্টে না পেলে অবশ্যই বাসায়। আজুম্মা আফসোস করেন, যদি আমি কোরিয়ায় থেকে যেতাম খুব ভালো সুন্দর একটা মেয়ে দেখে আমাকে বিয়ে দিতেন।

– “জানো! কোরিয়ায় বিয়ে করতে গেলে পুরুষদের অনেক টাকা থাকতে হয়, যার টাকা নেই তার কপালে বৌ নেই। অবশ্য তোমার কোনো সমস্যা হোতোনা, আমি আছি, আমি তোমার ওম্মা না?”

– “দেশে আমার মা আমার জন্য মেয়ে দেখবেন। সে-ও নিশ্চই অপরূপা হবে।”

– “তোমাদের দেশের মেয়েরা বেশী সুন্দর।” আজুম্মা বলেন, “যদিও আমাদের মত সাদা নয়। সবচেয়ে সুন্দর চোখ আর লম্বা চুল। তোমার মা নিশ্চই তোমার বান্ধবীর সাথে তোমার বিয়ে দেবেন।”

– “বান্ধবী? আমার বান্ধবী নেই।”

হাঁ… বলে আজুম্মা গালে হাত দিলেন। অবাক।

– “এত্তো সুন্দর আর হ্যান্ডসাম ছেলে, বান্ধবী নেই?”

– “আমি হ্যান্ডাম? তুমি একদম পাগল। তাছাড়া আমাদের সমাজ বেশ কনজারভেটিভ। তবুও ছেলেমেয়েরা প্রেম করেনা তা নয়। আসলে এ বিষয়ে আমার সামান্য আগ্রহও ছিলোনা কখনো, এখনো নেই।”

– “অপরিচিত একটা মেয়েকে বিয়ে করবে? সে তো পাকিস্তান আর ইন্ডিয়াতে হয় বলে শুনেছি।”

– “আমাদের দেশেও বেশীরভাগ সেরকমই হয়।”

– “বিয়ের পর বৌ কে জাহাজে রাখবে?”

– “নাহলে যে মরে যাবো।” বলে খুব হাসতে লাগলাম।

– “বৌকে নিয়ে যদি কখনো কোয়াংইয়াং আসো, অবশ্যই ওকে আমার বাড়ী নিয়ে যাবে। তাকে নিয়ে আমি ঘুরবো, বেড়াবো, শপিং করবো।”

– “অবশ্যই। তোমাদের দেখে সে ও খুব খুশী হবে।”

কোরিয়ানদের বরাবরই কুত্তাখোর, কুত্তা মেজাজ বলে গালাগাল দিতাম। এখনো দিই। কিন্তু আজুম্মার কথা মনে হলে সব ভুলে যাই। এমন ভালোবাসা কি কোথাও পেয়েছি? দুবছরের বেশী হল সাউথ কোরিয়া যাওয়া হয় নি। আজুম্মার স্মৃতি আজও হৃদয়ে উজ্জ্বল হয়ে আছে। এখনো স্বপ্ন দেখি আমার জাহাজ একদিন কোয়াংইয়াং গিয়েছে। আমাকে দেখে আজুমমা ছুটে এসেছেন। টলটলে চোখ। জড়িয়ে ধরেছেন, গালে দুহাত দিয়ে আদর করছেন। অনুভব করি আজুম্মার ভালোবাসা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Post comment