চট্টগ্রাম আমার চট্টগ্রাম
(২০ জানুয়ারী ২০১৯ – ২২ জানুয়ারী ২০১৯)
চট্টলা, চাটগাঁ, চাটিগঁও, চিটাগাং, চট্টগ্রাম. . . একটা শহরের এত নাম বোধহয় আর কোথাও নেই।
অনেকগুলো কারনে চিটাগাং আমার প্রিয় শহর। শিশুকাল কেটেছে চিটাগাংএ, বড় হয়ে বহুবার যেতে হয়েছে সেখানে কারন পরিবারের অনেকে চিটাগাং সেটলড্, বন্ধু বান্ধব তো আছেই। আবার চাকরীর ঘাটও চট্টগ্রামে। তার চেয়েও বড় কথা পাহাড় আর সমুদ্র আমাকে টানে, পাগল করে দেয়। ফেণীর পর এই একটা শহর যেটা কখনো আমাকে একঘেঁয়ে করেনা, চট্টগ্রামের অনেক স্মৃতি আমার আবেগের সাথে মিশে আছে। আমার সী ক্যারিয়ার, অর্থাৎ সমুদ্রজীবনের শুরু চট্টগ্রাম থেকে।
সকাল সকাল রওনা হবার কথা থাকলেও আমরা রওনা হলাম একটু বেলা করে। আমি বাসার সামনের উঠানে দাঁড়িয়ে ছোট একটা কাঁঠাল গাছের মুচি আর শিশু কাঁঠালের ছবি তুলছিলাম। আর তুলছিলাম আমাদের শতবর্ষের পুরোনো দালানবাড়ী আর সামনের উঠানের ছবি। এই মাটির সাথে মিশে আছে অনেকগুলো প্রজন্মের হাসি-কান্না-ভালোবাসা আর নাড়ীর টানের স্মৃতি।
আম্মা আর আপাসহ বের হতে হতে প্রায় সাড়ে দশটা বেজে গেলো। আমরা মহিপাল থেকে এগারোটার স্টার লাইনে চেপে রওয়ানা হলাম। জ্যাম না থাকলে সোয়া এক ঘন্টাও লাগেনা। সাড়ে বারোটার মধ্যে আমরা তুষারের বাসায়। বাসায় তখন শারমীন আর আফিয়া। তুষার অফিসে, সাফওয়ান-সাইহান স্কুলে। এর মধ্যে শারমীন ডাইনিং টেবিল ভরিয়ে ফেলেছে এটা ওটা দিয়ে। দুপুরের খাবার সময় হতে বেশী বাকী নেই তবুও এতো নাস্তা! ও আল্লাহ্। তবুও ঘরটা কেমন জানি খালি খালি লাগছিলো। স্কুল থেকে সাফওয়ান আর সাইহান যখন ফিরলো তখন বুঝলাম কেন খালি খালি লাগছিলো।
তুষারের এই বাসা বড়সড় আর খোলামেলা। ইন্টেরিয়রও বেশ। সাফওয়ান-সাইহান আসাতে পুরো বাসা এখন কানায় কানায় ভরা, আলোকিত। রক্তের টান একেই বলে। সাফওয়ান আমার চেয়েও লম্বা হয়ে গেছে মাশা আল্লাহ্। সাইহানও বড় হয়েছে। সাইহান নাকি অনেক দুরন্ত, আমার মনে হল ও আগের চেয়ে অনেক শান্ত হয়ে গেছে। বিকেলের দিকে মেঝমামী আর সোহাগ ভাইয়াও আসলেন। আমরা আর কোথাও যাইনি। রাতে তুষার ফেরার পর আমরা সবাই মিলে গল্পে মেতে উঠলাম। কতদিন পর পরিবারের এতগুলো মানুষকে একসাথে পেলাম।
পরদিন সকালে শারমীনের বানানো পায়ার স্যূপ দিয়ে খোলা পিঠা পেট ভরে খেয়ে একটু বেলা করে লাভলী খালাম্মার সাথে দেখা করে এলাম। ওখানে তূর্ণাও ছিলো। তূর্ণার ছেলেটা অনেক কিউট মাশা আল্লাহ।
দুপুরে আম্মাকে নিয়ে গেলাম পাহাড়তলী, আমজাদ ভাইর বাসায়। – আমজাদ ভাইর সাথে আমার পরিচয় ১৯৯০ সালে তেজগাঁও ঢাকার টেলিসেন্টার বা টিটিসি তে। আমজান ভাই তখন তাঁর টিসিএম ট্রেনিংয়ে আর আমরা (প্রাইভেটলি) মেরিটাইম রেডিও এন্ড স্যাটেলাইট টেলিকমিউনিকশেনস্ ট্রেনিংয়ে ছিলাম। ঢাকায় আমজাদ ভাই আর আমার অনেক অনেক মধুর স্মৃতি আছে যা আজও মনকে নাড়া দেয়।
আমজাদ ভাই আমাকে খুব স্নেহ করতেন এবং অল্প সময়ের মধ্যে তিনি আমার এবং আমার পরিবারের এত আপন হয়ে গেলেন যে তিনি আমার সেজভাই হয়ে গেলেন। সম্পর্ক আরো গাঢ় হল ১৯৯৮ (অথবা ৯৯) সালে যখন আমজাদ ভাই আমার ফুপাতোবোন ঊর্মিকে বিয়ে করেন। আমজাদ ভাইর সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিলো উনার অফিসে, ২০১৩ সালে সামান্য কিছু সময়ের জন্য, চট্টগ্রামের নন্দনকাননে। এরপর দেশে গেলেও আমজাদ ভাইর সাথে দেখা হয় নি নানান ব্যাস্ততার কারনে। বহু বছর পর আমজাদ ভাইকে দেখে অনেক ভালো লাগলো। আজ আমজাদ ভাই একজন বাবা, আবার শশুরও। বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, ছোটজন হাই স্কুলে। উর্মী আমাদের জোর করে রেখে দিলো, দুপুরে খেয়ে যেতে হবে। আমি আর আম্মা পরে ভালোমত খেয়ে দেয়ে বাসায় ফিরলাম বিকেলে।
বিকেলেই আপা আর শারমীনসহ গেলাম কুমার ভাইয়ার বাসায়। ওখানে ফুপা আছেন। ফুপার শরীর ভালো না, তবে এবার অনেক ঝরঝরে দেখলাম। অনেক অনেক খুশী হলেন আমাদের দেখে, মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন। চট্টগ্রামে আমার শৈশবের স্মৃতি বলতেই বাদল ফুপুর নন্দনকানের বাসা। ফুপু আমাদের মাঝে নেই এটা এখনো আমার বিশ্বাস হয় না, এখনও মনে হয় হালিশহর বি ব্লকে বাদল ফুপুর বাসায় গিয়ে উনাকে সালাম করে দাঁড়াতেই বুকে জড়িয়ে ধরবেন। হালিশহর বি ব্লকের বাসায় আর কখনো যাওয়া হবেনা।
কুমার ভাইয়া বাসায় ছিলোনা, বড় ছেলে ইমানও ছিলো না তাই তাদের সাথে দেখা হল না। ছোট ছেলে রাফি মাশা আল্লাহ্ অনেক সুন্দর আর লক্ষী হয়েছে। রীমা ভাবী বিকেলের নাস্তায় এত বেশী খাবার দিয়েছে যা দিয়ে ডাবল ডিনার হবে। সোমার বাসায় যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে, সোমা না খাইয়ে ছাড়বেনা। কিন্তু খাবো কি করে?
রীমা ভাবীর বাসা থেকে সোমার বাসা বেশী দুরে নয়। বাসা থেকে রিকশা নিয়ে ওয়াসার মোড়, সিডিএ এভিনিউ হয়ে হাইলেভেল রোড। তারপর বাঘঘোনার মোড় থেকে ডানে মোড় নিয়ে সামনে খানিকটা এগিয়ে গেলে আমার বন্ধু একরাম দের বাসা। সোমার হাজব্যান্ড শহীদ ভাই একরামের বড়ভাই। শহীদ ভাইর সাথে একরামের মাধ্যমে আমার পরিচয় সেই ১৯৯১ সাল থেকে। একরামদের বাসায় আমি বহুবার গেছি। খালাম্মা আর খালু নিজের সন্তানের মত স্নেহ করতেন। শহীদ ভাই, মফিজ ওদের সাথেও গল্প আড্ডা হত।১৯৯৮ সালে শহীদ ভাইর সাথে সোমার বিয়ে হয়। খালাম্মা অর্থাৎ শহীদ ভাইর আম্মা নিজে পছন্দ করে ছোটবোন সোমাকে (মিন্টু মামার মেয়ে) তাঁর পরিবারের বড় বৌ করে করে ঘরে তোলেন। খালাম্মা আজ আমাদের মাঝে নেই, থাকলে দেখতেন তাঁর রুচিশীল বড়বৌ ঘর সামলাবার পাশাপাশি তাঁর দুই নাতিকেও সুশৃংখল আর সুশীল বানিয়েছে। ওরা দুই ভাই ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে পড়ছে। প্রায় জোর করে সোমাকে বড়বৌ বানিয়ে তিনি ভুল করেন নি। সোমার বিয়ের বহু আগ থেকে শহীদ ভাইর সাথে আমার পরিচয় বন্ধু একরামের বড়ভাই হিসেবে। এখন সম্পর্কে ছোটবোনের জামাই হলেও আমি তাঁকে বড়ভাই হিসেবেই দেখি।
সিডিএ এভিনিউতে নাসিরাবাদের দিকে চলে যাওয়া ফ্লাইওভার দেখে খুশীর বদল মন খারাপ হয়ে গেলো। মানুষ বেড়েছে, বেড়েছে যানবাহন। সময়ের প্রয়োজনে গড়ে উঠছে পথের উপর পথ। উঁচু উঁচু দালান। কমছে আলো, কমছে গাছপালা। হাইলেভেল রোডে ঢুকে মনটা আবার খানিকটা ভালো হল। রাস্তা, তার দুধারে দোকানপাট কুড়ি বছর আগে যেমনটি দেখেছি তেমনই আছে। চানমারী রোডে ওঠার পর এখানে ওখানে বেশ কিছু উঁচু দালান দেখা গেলো, নতুন ফ্ল্যাট। সামনে খানিকটা এগিয়ে গেলে মমতা নগর মাতৃসদন, ওটার সামনের পথ, যেটা উপরে পাহাড়ের দিকে উঠে গেছে ওখানে সোমা-শহীদভাইর নতুন ফ্ল্যাট। সোমা কিছুতেই আমাদের হেঁটে উপরে আসতে দেবেনা। এইটুকুন পথ তবু গাড়ী পাঠালো। এই ফাঁকে শারমীন আর আপা মমতা মাতৃসদনের সাইনবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসতে হাসতে ছবি নিলো একটা। স্মৃতিময় মমতা মাতৃসদন, এখানে সাফওয়ানের জন্ম।
সোমার ফ্ল্যাটে ঢুকে মনটা ভরে গেলো, বড়সড় ফ্ল্যাট তার উপর চমৎকারভাবে সাজানো। ভেতরের কারুকাজ, এ্যারেঞ্জমেন্ট আর ইন্টেরিয়র ডেকরেশন দেখে সোমার লেখা কবিতার লাইনের মত মনে হয়। আবার মনটা দমে গেলো ডাইনিং টেবিলে এত খাবারদাবার দেখে। কিন্তু এত কষ্ট করে সব করেছে, না খেলে চলবে? শহীদ ভাই এসে পৌঁছার আগে নাস্তার নামে যা খেলাম সেটা খেয়ে চারদিন না খেয়ে থাকা যাবে। তার উপর আবার ফুল কোর্স ডিনার। ও আল্লাহ্!
শহীদ ভাই আসার পর একাকীত্ব ঘুচলো। আপা, শারমীন আর সোমা, তিন নারীর মাঝখানে এতক্ষন আমি ছিলাম “চাইর নম্বর”। শহীদ ভাই এখনও আগের মত আছেন। বরাবরের মত আমরা হারিয়ে গেলাম স্মৃতিতে। কত বছর পর সোমা-শহীদভাইর সাথে দেখা হল? ২০০১ এর পর আর কি দেখা হয়েছিলো? সময় কেন এত দ্রুত দৌড়ায়? যতক্ষন ছিলাম ততক্ষন মেতে ছিলাম গল্পে আড্ডায় আর সেলফিতে। সোমার বাড়ীর ছবি তুলে কি শেষ করা যায়? ছাদবাগানও বাদ যায় নি। বিদায়ের সময় লিফ্টের মধ্যেও সেলফী। ওরে সেলফি রে!
চট্টগ্রাম এসে এত অল্প সময় থাকলে পোষায় না। কত বন্ধু, আপনজন বাদ পড়ে গেলো, দেখা হল না। এই শহরের অলিগলি জুড়ে আছে আমার দুনিয়ার সব স্মৃতি, ছেড়ে আসতে মন চায় না। তবু ফিরে যেতে হয়, যোগ হয় স্মৃতি।