আবার বরদৈন

১৮.০১.২০১৯

মদিনা বাস সর্ভিস। ফেনী-কুমিল্লা। ঢাকা চট্টগ্রাম হাইওয়ের উপর।

পরদিন দুপুরবেলা আবার নানুরবাড়ী (বরদৈন) চলে গেলাম। গত সন্ধ্যার আঁধারে বাড়ী, মসজিদ এসব দেখে মন ভরেনি। বহু বছর পর লোকাল বাসে চড়া। ছেলেবেলার সেই মদিনা সার্ভিস এখনও আছে। বাসের ভেতরটাও সুন্দর। হাইওয়ে দিয়ে বেশ কয়েকটা স্টপেজ ধরে গেলেও ফকির বাজার স্টপেজ পর্যন্ত যেতে আধঘন্টারও কম সময় লেগেছে। ভাড়া পঁচিশ টাকা। আগে ছিলো দুই টাকা। 

যেদিক থেকে তাকাই সেদিক থেকেই দেখতে ভালো লাগে লাল মসজিদ।

মসজিদের পাশে ঘুমিয়ে আছেন নানা, নানু, লিলি খালাম্মা, বড়মামা আর মোহন মামা।

আগের টিনশেড লাল মসজিদ ভেঙে আধুনিক ছয়তলা ফাউন্ডেশনের মসজিদ, মাশা আল্লাহ্।

বাস থেকে নেমে হাঁটাপথ এখন আর ছেলেবেলার মত অনেক দুরের মনে হয় না। সামান্য এগিয়ে যেতেই ঝকঝকে দিনের আলোয় লাল মসজিদ দেখে মন ভরে গেলো। আলহামদুলিল্লাহ্, কি সুন্দর আমার নানুরবাড়ীর নতুন মসজিদ। যেদিক থেকে তাকাই সেদিক থেকেই দেখতে ভালো লাগে লাল মসজিদ। মসজিদের দক্ষিন দিকে পুকুরঘাট ঘেঁসে সিঁড়িঘর হবে। ওপর দিকে উঠে যাবে মসজিদ, তাড়াহুড়োর কিছু নেই, তবে প্ল্যান এগিয়ে যাচ্ছে। মসজিদের উত্তরপশ্চিম দিকে রাস্তার ওপারে নানার জায়গা আছে, ওখানে ওজুখানা বানানোরও পরিকল্পনা আছে হাছানের। আমরাও আশা করি নানুরবাড়ীর লাল মসজিদ একদিন পাঞ্চেগানা মসজিদ, তারপর জামে মসজিদ হবে। ঘুরে ফিরে মসজিদের অনেকগুলো ছবি তুললাম। গ্রামের রাস্তা পিচঢালা হয়েছে, রাস্তায় এখন প্রচুর সি.এন.জি দেখা যায়। ঘরে ঘরে কারেন্ট, ডিশ কানেকশন চলে এসেছে বহু বছর আগে। তখন সেজমামার বাড়ীতে আছেন মামা, মামীমা, রীমা আপা, হাসান, সামনুন আর সাবরিনা। হাছান গাড়ী নিয়ে এসেছে, ড্রাইভ করেছে সামনুন। সামনুনের ড্রাইভিং আমার খুব পছন্দ হয়েছে, মাশা আল্লাহ্। ঠান্ডা মাথায় দক্ষ হাতে নিপূনভাবে গাড়ী চালায়, সময় নষ্ট করেনা আবার যাত্রীদেরও কম্ফোর্ট দেয়। 

ফকির বাজার অংশ থেকে তোলা ছবি, এখান থেকে ডানে নানুবাড়ীর শুরু।

মসজিদের পাশেই ঘুমিয়ে আছেন নানা, নানু, লিলি খালাম্মা, বড়মামা আর মোহন মামা। মোহনমামা বড় তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। নানুরবাড়ীর পুকুরটা কচুরিপানায় ভর্তি ছিলো, হাছান পরিষ্কার করিয়েছে। বাড়ীঘরে সেজমামা ছাড়া আর কেউ থাকেনা বলে পুকুরঘাটের বসার যায়গা ছাড়া আর কিছুর কোন অস্তিত্ব নেই, সিঁড়ি ভেঙ্গে পানিতে তলিয়ে গেছে, পানি খুবই নোংরা, গোসল করা অসম্ভব। ছেলেবেলার সেই টলটলে পুকুর যেখানে ঘন্টার পর ঘন্টা ঝাঁপাঝাঁপি করেছি, সাঁতার কেটেছি এখন সেটা কল্পনাও কার যায় না। 

হায়রে ঘাটলা। এক সময়ের পরিচ্ছন্ন ব্যাস্ত এই ঘাট, আর কি অবস্থা। পাকা মেছে, উপর থেকে পুকুরে নামার সিঁড়ি, সব শেষ। পেছনে ছিলো বাগানবিলাসী মূল বাড়ী। আমার নানুর বাড়ী

দিনের ঝকঝকে আলোয় ঘুরেফিরে যতখানি সম্ভব ছবি তুলেছি। মসজিদ, পুকুর ভাঙ্গা ঘাট এসব। মেঝমামা আর সেজমামার ঘরবাড়ি আর পুরোনো বাড়ীর জায়গাটা যেটা এখন শ্রেফ জঙ্গল সেগুলোর ছবি তোলার কথা মনে আসেনি।

দু দিন আগে এটা ছিলো কচুরিপানায় ভরা পানা পুকুর, ওগুলো সরানোর পর নোংরা পানি। সেচে খনন করলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

নানুরবাড়ীর পুকুর। প্রায় ৩৬০ ডিগ্রী প্যানো ফটো।

হাসান তার নানুরবাড়ী অর্থাৎ জগন্নাথ দিঘীর উল্টোদিকে মীর বাড়ীর ঠিক পেছনে তার কোন এক মামার বানানো স্কুল দেখাতে নিয়ে গেলো।সৈয়দা আঞ্জুমান আরা বালিকা বিদ্যালয়।স্কুল দেখে আমার টাশকি অবস্থা। চারিদিকে নিরাপদ ঘেরা দেওয়া মাঠ, শহীদ মিনার সহ দ্বিতলত্রিতল এই স্কুলে সব ব্যাবস্হা রয়েছে। অত্যাধুনিক প্ল্যান, সিকিউরিটি ক্যামেরা, ২৪ ঘন্টা গার্ডের ব্যাবস্থা, আধুনিক ক্লাসরুম, লাইব্রেরী, কম্পিউটার ল্যাব, ল্যাবেরোটারী, বড়সড় খেলার মাঠ, বিশাল ডাইনিং কি নেই? ঘুরে ঘুরে দেখে মন ভরে গেলো।

সুখের বিষয় প্রথম বছরেই খুব ভালো রেজাল্ট। স্কুল এবং এর সকল সুযোগ সুবিধা দেখে মনে হয়েছে যিনি এই গাঁয়ে এমন করে এতবড় একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন গলাবাজি করার জন্য নয়, পজিটিভ এ্যাটিচিউড থেকে এটা করেছেন। অত্র এলাকায় এমনিতেই মেয়েদের বড় কোন স্কুল নেই।

ঢাকা-চিটাগাং হাইওয়ে থেকে নানুরবাড়ী আসার দু মিনিটের হাঁটা পথ। এই ছবিটা আমার প্রিয়।

গতকাল রাতের অন্ধকারে হাছানের গাড়ী নিয়ে গ্রামের পিচঢালা সিঙ্গেল রাস্তা দিয়ে পায়েরখোলা স্কুলে গিয়ে আবার ফিরে এসেছিলাম। দেশে থাকতে কখনো গাড়ী চালাইনি, কারন চালাতে জানতাম না। শেখার চেষ্টাও কখনো করিনি কারন অবচেতন মন জানতো দেশে যদি ভুলক্রমে একটা গাড়ির মালিক হয়েও যাই সেটা আমি নয়, চালাবে একজন ড্রাইভার। বৃটেনে এসে অনেকটা বাধ্য হয়েই ড্রাইভিং শিখেছিলাম, লাইসেন্স নিয়েছি প্রায় ১৩/১৪ বছর আগে। ম্যানুয়াল গিয়ারের গাড়ীর লাইসেন্স থাকা আমার মত আনাড়ীর জন্য বিরাট ক্রেডিট। তবে অভিজ্ঞতার কারনে হাত পাকা হয়েছে তাই নিজেকে নিরাপদ ড্রাইভারই মনে করি। (তার উপর বৃটিশ পুলিশ, আল্লাহ্ মাফ করুন।) ম্যানুয়াল গাড়ীর লাইসেন্স থাকার কারনে মনে মনে গোপন পূলক অনুভব করি কারন এটাকেফুল ড্রাইভিং লাইসেন্সহিসেবে ট্রিট করা হয়। অন্যদিকে অটো লাইসেন্সওয়ালাদের ফুল লাইসেন্সের মালিক হতে হলে আবার টেস্ট দিয়ে ম্যানুয়াল ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে হবে (প্রশ্ন হল, কার এত ঠেকা লাগছে?) আমার কাছে অটোম্যাটিক গাড়ী চালানো আর ভিডিও গেম খেলা এক মনে হয়। কেমন জানি, বোরিং। অথচ আমার বর্তমান (তৃতীয়) গাড়ী অটোম্যাটিক কারনভলভোতাদের এই মডেলে ম্যানুয়াল গিয়ারের ব্যাবস্থাই রাখেনি! শরম কই লুকাই?

তলে তলে নিজেকে বহুৎ ড্রাইভিংপণ্ডিত ভাবি কিন্তু দেশের রাস্তায় গাড়ী চালানোর স্পর্ধা হয় নি কখনও। গতবার জিতু রীতিমত জোর করছিলো, “আরে মামা চালাও না, কিছু হবেনা আমি আছি।আমি বলেছিলাম, “ওরে আব্বা রে, দরকার হইলে নামাইয়া দে, ইশ্টিয়ারিং ধরতে কইছ না। খুব বেশী হইলে বাইসাইকেল পর্যন্ত আমার দৌঁড়।বাংলাদেশের রাস্তায় গাড়ী চালাবো আমি? না ভাই, এত সাহস নাই। জিতু খুব ভালো গাড়ী চালায়, মাশা আল্লাহ্। আমি যতদুর জানি জিতু ম্যানুয়াল গাড়ীও চালায়। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, দেশে ম্যানুয়াল গিয়ারের গাড়ি দেখাই যায় না। আজ পর্যন্ত কোনো আত্মীয়/বন্ধুর ম্যানুয়াল গিয়ারের গাড়ী দেখিনি। সব অটো, সবাই ভিডিও গেইমের উপর আছে। 

বাড়ির ভেতরে হাছান কি একটা জরুরী বিষয়ে ফারুক মামার সাথে আলাপে ব্যাস্ত। সামনুন বললো মামা চলেন গাড়ি নিয়ে ঘুরে আসি। আপনি চালাবেন, ঠিক আছে! সামনুনের প্রস্তাবে আমি ভয়াবহ দুঃসাহসিক কাজ করে ফেললাম। রাজী হয়ে গেলাম, আজ বিশ্বরোডে গাড়ী চালাবো। সাবরিনা জানেনা বাংলাদেশের রাস্তায় ড্রাইভার হিসেবে আমি দুধের শিশু। বেচারী যখন বললো সেও যাবে আমি মানা করলাম না, তবে একটা ঢোঁক গিললাম। জীবনমৃত্যুর মালিক সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলা। 

হাছানের গাড়ীটা টয়োটা কোরোলা হ্যাচব্যাক, যেটাকে দেশে স্টেশন ওয়াগন বলে। বৃটেনেও একই নাম তবে এস্টেট কার হিসেবে বেশি প্রচলিত। ইউরোপআমেরিকায় সেলুন গাড়ীর চেয়ে স্টেশন ওয়াগনের দাম বেশী (এর কারন ব্যাখ্যা করে সময় নষ্ট না করি) অদ্ভুত ব্যাপার হল, বাংলাদেশে সেলুন গাড়ীর দাম বেশী। যাই হোক, আগেই বলেছি হাছান বাকী দশজন গাড়ীওয়ালার মত তার গাড়ীকে সি.এন.জিতে কনভার্ট করেনি। ভেতরে বসলাম আমরা তিনজন। সামনুন প্যাসেঞ্জার সীটে, সাবরিন পেছনে। সামনুনকে বললাম সীটবেল্ট বেঁধে বসতে, নিজেকেও বাঁধলাম। বাড়ী থেকে বের হবার সময় রিভার্স গিয়ার দিতে গিয়ে দেখি এলাহি কান্ড, ড্যাশের স্ক্রীনে পেছনদিকের ফকফকা সিনেমা, সাথে গাইডিং গ্রীডসহ ব্লীপ ব্লীপ। বাহ্ আমি অভিভূত! এ যে রিডাবল ভিডিও গেইম। সরু পীচঢালা রাস্তায় চালাতে গিয়ে কয়েকবার সি.এন.জি স্কুটার আর একটা মাঝারী ট্রাক পাশ কাটালাম, কিন্তু ভয় পেলাম না, কেন?

হাইওয়েতে উঠার আগে দেখি ইতিউতি ট্রাক, চেয়ার কোচ চলছে। কেমন জানি মরার মত সব, কোঁতাইয়া কোঁতাইয়া চলছে। আমি যাবো বাঁয়ে, উত্তর দিকে। ডান দিক থেকে একটা বাস আসছে, অপেক্ষায় আছি আর ওটা আসছে তো আসছেই। পরে হঠাৎ মনে হল আমি তো বাংলাদেশে, এইখানে ভদ্রতা করে বলদে। রাস্তায় উঠে গ্যাসে চাপ দিলাম। 1.6 বা 1.8 লিটারের পেট্রল ইঞ্জিন হাওয়ায় উড়াল দিলো। ১০০ কি.মি. স্পীড উঠতে পাঁচ সেকেন্ডও লাগেনি। জগন্নাথ দিঘীর কাছাকাছি রোডআইল্যান্ডটা খানিক কাটা আছে, ওখান দিয়ে ইউ টার্ন নিয়ে আবার গ্যাস প্যাডেলে চাপ, এবারও উড়াল দিলো হাছানের টয়োটা হ্যাচব্যাক। গাড়ীর সাসপেনশান ভালো, ল্যাদার ট্রীমড্ হওয়ায় কম্ফোর্টও পেলাম। Smooth ইঞ্জিন, বাইরের শব্দও যথেষ্ঠ কন্ট্রোল্ড। এবারও এঁকেবেঁকে চালাতে হচ্ছে তাই মনপছন্দ্ স্পীড টেস্ট করতে পারছিলাম না। বেতিয়ারার কাছে (গাংরা) রোড ডিভাইডারে আবার একটা কাটা পেয়ে ইউ টার্ন নিলাম। এবার গ্যাস প্যাডেল পা দিয়ে গেঁথে দিলাম, দেখি হাছানের কোরোলা কি কয়। ঘোঁৎ করে মুহুর্তের মধ্যে উড়াল দিল গাড়ী, খালি হাইওয়ে, এক থেকে চার গুনতে গুনতে দেখি ১৪০ কি.মি.তে দেখাচ্ছে কাঁটা। স্টিয়ারিং মোটেও কাঁপছিলোনা, বডিও ভারসাম্যা রেখেছে পুরোপুরি। সামনুন আজ সীটবেল্টের প্রয়োজনীয়তা এবং গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে। ওয়েল ডান ভাগিনা।

ALWAYS WEAR SEATBELT.

নাহ্, হাঁচনরাজা ভালো গাড়ী কিনেছে মাশা আল্লাহ্।

আশা করছি দেশে গাড়ী চালাতে ভয় পাবোনা তবে শহরের ভেতর চালাতে পারবোনা। বিশেষ করে ঢাকায়, নো চান্স। বাংলাদেশের জন্য আমি ড্রাইভার না, ড্রাইভারের জাতও না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Post comment