ইকবাল ভাই, রোটারী ক্লাব এবং. . .

১৭.০১.২০১৯
ষ্টেশন রোডের পশ্চিম প্রান্তে, কলেজ রোড এর কিছুটা আগে ফিরোজ লাইব্রেরী। ফিরোজ লাইব্রেরী ফেণীর ঐতিহ্যবাহী লাইব্রেরীগুলোর একটি। ভেতরে ইকবাল ভাই। আমার পাইলট হাই স্কুলের বড়ভাই। গুরুজন, শ্রদ্ধাভাজনেষু। আমরা যারা পাইলট প্রাইমারীতে পড়তাম তাদের একটা সুবিধা ছিলো পাইলট হই স্কুলের বড়ভাইদেরও মোটামুটি চিনতাম। ফেণীর ঐতিহ্যবাহী লাইব্রেরী ‘ফিরোজ লাইব্রেরী’, তারপর বড় পরিসরে ‘ফেণী লাইব্রেরী’ এগুলো ইকবাল ভাইদের।

ইকবাল ভাই, বাঁয়ে আমি (২০১৯)

পাইলট হাই স্কুলের স্কাউট টীম ক্যাপ্টেন ছিলেন ইকবাল ভাই। এখনও মনে পড়ে ২৬ মার্চ বা ১৬ ডিসেম্বরের মার্চ-পাস্ হত ফেণী পাইলট হাই স্কুল মাঠে। হাই স্কুলের সামনে মঞ্চ, ফেণীর প্রায় সবকটি স্কুল কলেজের স্কাউট টিম, বি.এন.সি.সি সারি বেঁধে একে একে দাঁড়ানো থাকতো। থাকতো মেয়েদের স্কুলের টীমও, ওরা গার্লস গাইড। আমি তখন প্রাইমারীতে, এখনও মনে পড়ে মার্চ করতে করতে ইকবাল ভাই তার টীম নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। মঞ্চের সামনে দিয়ে যাবার সময় স্যালুট দিয়ে ডানে তাকাতেন ক্যাপ্টেন। তিন সারিতে এগুতে থাকা দলের বাকী সবাই একসাথে ডানে মুখ ফেরাতো, শুধু সামনের সারির বাঁয়ের জন সামনে তাকানো থাকতো তা না হলে লাইন এঁকেবেঁকে যেতে পারে। পাইলট হাই এর গতানূগতিক স্কুল-ড্রেসই প্যারেড ড্রেস। সাদা শার্ট, সাদা প্যান্ট আর সাদা কেডস জুতা। স্কাউট টীমে শুধু একটা ব্যাতিক্রম, স্বাধীন বাংলার লাল-সবুজ মেলানো অদ্ধুত সুন্দর গলার স্কার্ফ। অন্য সব স্কাউট টীম ছাপিয়ে চোখ আটকে যায় পাইলটিয়ানদের উপর। শ্বেতশুভ্র ড্রেস পরা একদল হ্যান্ডসাম কিশোর, দেখতে কি যে ভালো লাগতো! স্বপ্নে বিভোর হতাম এই ভেবে, একদিন আমিও সেই স্কুলে পড়বো, ঠিক এমন ইউনিফরম পরে প্রতিদিন আসবো ক্লাশ করতে যেখানে পড়ছে আমার বড় ভাইয়েরা। পড়ে গেছে আমার বাবা চাচারা। চকিতে স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়, ভয় হয় আমি কি এ্যাডমিশন টেস্টে টিকবো? যদি ফেল করি? ভালোলাগা আর ভয় মেশানো শৈশব। কতশত স্মৃতি, কয়েক সেকন্ডের মধ্যে সব মাথায় এসে ভীড় করলো।

ফেইসবুক না থাকলে কখনোই জানা হতনা ইকবাল ভাই দুর্দান্ত একজন কবি। ছন্দ মিলিয়ে এতো সুন্দর সব কবিতা লেখেন, পড়ে মনে ভালো হয়ে যায়।
যে বছর আমি সিক্সে, সে বছর ইকবাল ভাই মেট্রিক (এস.এস.সি) দিচ্ছেন। বয়সের পার্থক্য বেশী নয় তবে ক্লাস সিনিয়রিটি হিসেবে বড় ভাই মানে অনেক বড় ভাই। পাইলট হাই স্কুলের এই বিষয়টা অনেকটা চেইন অফ কমান্ডের মত। আমরা এক ক্লাশ সিনিয়রদেরও ভাইয়া বলে ডাকতাম, এখন পর্যন্ত সেটা মেইনটেন করে আসছি। স্কুলের বড় ভাইদের প্রতি সম্মান দেখানো আমার কাছে রুচিশীল সৌন্দর্য। বর্তমান প্রজন্মের কি অবস্থা বলতে পারব না। অনেক বছর পর রোটারী ক্লাব করার সুবাদে ইকবাল ভাই সহ একসাথে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিলো।
লাইব্রেরীর ভেতরে ইকবাল ভাইকে দেখতে পাচ্ছি, সাথে একজন ভদ্রলোক অন্যপাশে আরেকজ সম্ভবতঃ সেলসম্যান। শীতকাল, তাই সন্ধ্যা সাতটায়ও মনে হয় অনেক রাত। ষ্টেশান রোডের উপর দিয়ে হেঁটে আসার সময় জয়ের বাসা পার হতে হতে চোখের জল আটাকাতে পরিনি। ওর কথা মনে পড়ছিলো খুব। ভেতরে ঢোকার আগে চোখ মুখ ভালো মত মুছে ধাতস্থ হয়ে ঢোকার মুহুর্তে ইকবাল ভাই আমাকে দেখলেন। দেখামাত্র দাঁড়িয়ে এগিয়ে এলেন, মুখে সেই আগের মত স্নেহমাখা হাসি। শেষ দেখা হয়েছিলো প্রায় আঠারো বছর আগে। ভেতরে নিয়ে বসালেন আমাকে।

রোটারী ক্লাব অফ ফেনী সেন্ট্রাল। Installation Ceremony (2001) পেছনে বাঁ থেকে সর্বজনাব রোঃ ইকবাল ভাই, তমিজ, অমল দা, মুণীর চাচা। সামনে বসা, বাঁ থেকে ইকবাল মামা, মুরহুম এ্যাডভোকেট আক্রামুজ্জামান ভাই, আমি এবং স্বস্ত্রীক তৎকালীন রোটারী ডিষ্ট্রিক্ট (৩২৮০ বাংলাদেশ) প্রেসিডেন্ট।

হাজারো স্মৃতি এসে ভীড় করলো আবার। একের পর এক স্মৃতি, ঘটনা আসছে তো আসছেই। উল্যেখ করার মত হল, ১৯৯৮ সালে যাত্রা শুরু করে ‘রোটারী ক্লাব অফ ফেণী সেন্ট্রাল’। শুরু থেকেই ছিলাম আমি, ইকবাল ভাই আরো অনেকে। আমরা রোটারীয়ান। শুধু এটা বলা যেতে পারে এক বছরের মধ্যেই

RCFC ইনষ্টলেশন প্রোগ্রাম ম্যাগাজিন কমিটি। বাঁ থেকে সর্বজনাব রোঃ তমিজ, ইকবাল ভাই, আমি, প্রিন্সিপাল বাবুলদা এবং মুক্তা মামা।

ফেণীর এই শিশু রোটারী ক্লাবে পূর্ণ যৌবন এনে দিয়েছিলাম আমরা সবাই মিলে। একের পর এক মিশন, সব সাকসেসফুল। দলে দলে জেলায় জেলায় ঘুরে ঘুরে মিটিং কনফারেন্সে জয়েন করা। পাবলিকেশনস্ বের করা, খাটা খাটনি ইত্যাদি। মেম্বারদের ভেতর আন্তরিকতার কোনো অভাব ছিলো না ।

RCFC Installation & Blood Donation Rally (2001)

সব মিলিয়ে ঊনিশ-কুড়ি জন নিয়ে ১৯৯৮ সাল যাত্রা শুরু করে রোটারী ক্লাব অফ ফেনী সেন্ট্রাল। ১৯৯২ সালে শিপে জয়েন করার পর থেকে এমনিতেই আমি দেশে অনিয়মিত। তবে ২০০১ সালের ডিসেম্বরে যখন

রক্ত দান করছেন তৎকালীন ক্লাব ট্রেজারার রোঃ কামরান ভাই।

চুড়ান্তভাবে দেশ ছাড়ি তখন মেম্বার ছিলো ৪০ জন। শুরুটা ছিলো দারুন কর্মচাঞ্চল্যে ভরা। আমি যদি ভুল করে না থাকি, সর্বপ্রথম আমাদের ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হন ফেণীর ডিসি, সেক্রেটারী ইয়াসীন ভাই। সে

আমাকে ব্যাজ পরিয়ে দিচ্ছেন রোঃ ডা. তবারক উল্লাহ্ বায়েজীদ ভাই।

বছর গোবিন্দপুরের ইয়াসীন ভাইয়ের সাথে পরিচয় হয়। অন্যরা যাঁরা ছিলেন সবাই পরিচিত তবে অনেক অনেক সিনিয়র। এ্যাডভোকেট আকরামুজ্জামান ভাই, ডা: বায়েজীদ ভাই, ফেণী ড্রাগ হাউজের মোস্তফা

মেয়েটার লম্বা ঘন কালো চুল ছিলো। ধানমাড়াইয়ের মেশিনে চুল পেঁজিয়ে মাথার খুলির চামড়া উঠে যায়। তার চিকিৎসার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়েছিলেন শ্রদ্ধেয় রোঃ ডা: আসাদ উল্যাহ্ ফারুক ভাই। কাজ পাগল ফারুক ভাই ছিলোন মৃদুভাষী, বিশাল মনের মানুষ। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আল্লাহ্ তাঁকে জান্নাত কবুল করেছেন।

মামা, শফি ভাই, ডা: আসাদ উল্যাহ্ ফারুক ভাই, মীরু ভাই (সোনাপুর হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক), ডা: ইলিয়াছ ভাই, বাবুল ভাই (হাজী স্টোর্স, কলেজ রোড), কামরান ভাই, বাবর চাচা, ডা: আলী আহমেদ ভাই, মিলন ভাই (রাজ্জাক মেডিক্যাল), জয়নাল আংকেল (আবেদীন জুয়েলার্স), আবদুর রহমান বিকম ভাই,

রোটারী ডিষ্ট্রিক্ট কনফারেন্সে চট্টগ্রামে RCFC পরিবার।

ইলিয়াস ভাই (ব্যাবসায়ী সমিতির তৎকালীন সভাপতি), এ্যাডভোকেট খসরু ভাই, দিদার ভাই, এনাম ভাই, তসলীম চাচা, ডা: কাওসার ভাই, ডা: পিসি বণিক, শাহীন বাই (ভিডিও শাহীন), মুক্তা মামা,

রোটারী ডিষ্ট্রিক্ট কনফারেন্সে চট্টগ্রামে RCFC পরিবার।

অমলদা (টাউন ফার্মেসী), হারুন চাচা (রামপুর), মুণীর চাচা, তমিজ ভাই (তৎকালীন, ব্রিজবেন কম্পিউটার্স), প্রফেসর বাবুল চন্দ্র শীল (ফেণী সরকারী কলেজ) এবং আরো অনেকে। (আমি অত্যন্ত

বিনামুল্যে চক্ষু চিকিৎসা এবং ঔষধ বিতরন।

দুঃখিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী, সবার নাম মনে করতে পারছিনা।) মুক্তা মামা জয়েন করার পর ক্লাবের এক্সটার্নাল এ্যাকটিভিটিজ আমার জন্য আরো সহজ হয়ে গিয়েছিলো। এখানে আরেকটা নাম উল্যেখ না করে পারছিনা, ‘গোলাম জিলানী খন্দকার, মাছুম।’ দুর্দান্ত এক্স-রোটারেক্ট, রোটারী/রোটারেক্ট জগতে যার দেশব্যাপী পরিচিতি বিভিন্ন সময়ে আমাদের অনেক উপকারে এসেছে।

বিনামুল্যে চক্ষু চিকিৎসা এবং ঔষধ বিতরন।

সপ্তাহের প্রতি সোমবার সন্ধ্যা সাতটায় আমরা মিলিত হতাম রাজাঝির দিঘীর পশ্চিম পার্শ্বে। ট্রেজারী অফিসে ঢোকার মুখে হাতের বাঁয়ের একটা অফিসঘর, কিসের অফিস মনে নেই। কিন্তু মনে আছে প্রথম প্রথম ডিসি সাহেব নিয়মিত মিটিংএ আসতেন। আরো মনে পড়ে রোটারেক্ট ক্লাব গঠনের কথা। রোটারেক্টরা আমাকে অনেক পছন্দ করতো, ওদের সাথে মিশেছি বন্ধুর মত।

RCFC রক্তদান কর্মসূচী

আমরা সবাই অপেক্ষা করতাম কবে সোমবার আসবে। এক ঘন্টার জন্য মিলিত হতাম, এভাবে আমরা সবাই সবার আপন হতে থাকলাম এবং হয়ে গেলাম। সবাই সবার পরিবার পরিজনকে চিনতাম। রোটারী ক্লাব অফ ফেণী সেন্ট্রাল হয়ে গেলো বড় একটা পরিবার, এটা রোটারী কালচার।

রোটারেক্টর পারভেজ আর পৃথিবী

ঢাকা আর চট্টগ্রাম ছাড়া অন্যান্য প্রায় বড় বড় শহরগুলোতে রোটারী ক্লাবের সদস্য অনেক বেশী তবে ক্লাবের সংখ্যা কম ছিলো। বিশেষ করে কুমিল্লা, সিলেট, বরিশাল। ওনাদের যুক্তি ছিলো ক্লাব একটাই হবে, এত ক্লাব দরকার নেই। আমি ক্লাব বাড়ানোর পক্ষে। আমাদের দেশের জনসংখ্যার আধিক্য বিবেচনায়

রোটারী ক্লাব অফ ফেনী সেন্ট্রাল, ইফতার পার্টি ১৯৯৮

ক্লাবের সংখ্যা বাড়ানো মোটেও দুষনীয় নয়। লন্ডন আসার মাত্র দুদিন আগে ফেণী থেকে আমরা সবাই দলেবলে গিয়েছিলাম কুমিল্লা বার্ড এ নতুন একটি রোটারী ক্লাবের অভিষেক অনুষ্ঠানে। রোটারী ক্লাব অফ কুমিল্লা লালমাই। শিকল ভাঙ্গার ইতিহাসের স্বাক্ষী হলাম আমি এবং আমার ক্লাব।

রোটারী ক্লাব অফ ফেনী সেন্ট্রাল, ইফতার পার্টি ১৯৯৮। রোটারেক্টদের সাথে আমি আর রোঃ গোলাম জিলানী মাছুম।

আজ ফেণীতে তিনটি রোটারী ক্লাব হয়েছে। প্রত্যেকের রোটারেক্ট ক্লাব আছে, আছে ইন্টারেক্ট এবং ইনার হুইলস্। আশা করছি সেবার পরিধিও বেড়েছে।

আমি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি রোটারীয়ান সর্বজনাব ডা: আসাদ উল্যাহ্ ফারুক, মোস্তফা আজিজ আহমেদ বাবর, মো: ইলিয়াস ভুঁইয়া, মীর হোসেন ভুঁইয়া মীরু ভাই, মো: নাসির উদ্দিন তসলিম এবং ডা: পি সি বণিক। যাঁরা আজ আর আমাদের মাঝে নেই। রোটারী ক্লাব অফ ফেণী সেন্ট্রাল ছিলো তাঁদের আলোয় আলোকিত।
আমার পরম সৌভাগ্য আমি এতগুলো গুণীজনের সংস্পর্শ পেয়ে ধন্য হয়েছি। তাঁদের স্নেহ, মমতা, ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছি।
ইকবাল ভাই আমাকে নিয়ে বের হলেন। পাশের একটা চমৎকার রেষ্ট্যুরেন্টের উপরতলার কেবিনে নিয়ে গেলেন। সেই কুড়ি বছর আগের হ্যাংলার মত করে বললাম, “ভাইয়া, আমি কাবাব খাবো।” ভাইয়াও আগ্রহের সাথে অর্ডার দিলেন। আমরা চলে গেলাম মধুর অতীতে। রোটারী ক্লাবের স্মৃতিতে হারিয়ে গেলাম আমরা। রোটারী ক্লাব অফ ফেণী সেন্ট্রালকে হৃদয় উজাড় করে ভালোবেসেছিলাম আমরা সবাই।
আমাদের প্রাণের শহর ‘ফেণী’ আর আগের ফেণী নেই, সারা দেশের সাথে তাল মিলিয়ে ফেণীরও অবকাঠামগত উন্নয়ন হয়েছে। বাংলাদেশের সব শহরের মধ্যে ফেণীর উন্নয়ন একেবারে অন্যরকম। চতুর্দিকে এবং উপর দিকে উন্নতি। ইউনিক। 3D উন্নতি (ত্রিমাত্রিক)। দেশের বর্তমান অবস্থা বিষয়ে ইকবাল ভাইয়ের সাথে আমিও একমত, সকলের লাইফস্টাইলে পরিবর্তন এসেছে। স্মার্ট কমিউনিকেশন সিস্টেম সারা দেশের সমাজ ব্যাবস্থায় অভাবনীয় পরিবর্তন এনেছে (এক্ষেত্র আমি পজিটিভ এক্সাম্পলগুলোর কথা বলছি)। দারিদ্র কমেছে অনেক। না খেয়ে কেউ মারা যাচ্ছে এখন এমনটি শোনা যায় না। কেউ একেবারে নিঃস্ব, রিক্ত এমনটিও এখন আর শোনা যায় না। আগের মত “টাকার অভাব, টাকার অভাব” এই অভিযোগও কমে এসেছে। ব্যাতিক্রম একটাই, নতুন বসতি এমনহারে বেড়েছে যে স্থানীয়রা হয়ে গেছে ইমিগ্র্যান্ট। তিরিশ বছর আগে ফেণীর খেতাব ছিলো বাংলার লেবানন। এবার কি হবে, বাংলার ইসরায়েল?
স্থানীয় অস্থানীয় নির্বিশেষে একটা বিষয় সবার মানসিকতাকে গ্রাস করে ফেলেছে, অনিশ্চয়তা। আগামীতে কি হবে? ভবিষ্যত প্রজন্মকে কি দিতে পারছি আমরা? আমরা যে শৈশব পেয়েছি, তার ছিটেফোঁটাও কি তারা পাচ্ছে? পাবে? মান, সম্মান, পারিবারিক ঐতিহ্য, ভেল্যূ, সামাজিক মর্যাদা, শিস্টাচার, ম্যানার এগুলোর কোনোটা আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে হৃদয়ঙ্গম করার সুযোগ দিতে পারছি? কিংবা পরিবেশ? এক সময়ের ছোট্ট মফস্বল ফেণী, সেখেনে সবাই সবাইক চিনতো। এখন বড় ব্যাস্ত জেলা শহর, অচেনা। উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে গেছে খেলার মাঠ, পুকুর, গাছপালা সব। বুক ভরে নিস্বাস নেবার জায়গা খুঁজে পাওয়া কঠিন।

অল্প সময়ে অনেক কথা হল ইকবাল ভাইযের সাথে। কথা হল “টক অফ দ্য কান্ট্রি” নিয়ে। প্রতিদিন নতুন নতুন “টক অফ দ্য কান্ট্রি” আসে। আবার পুরোনো “টক”-ও ফিরে আসে, যেমন “ট্রাফিক জ্যাম।” রাষ্ট্র কিভাবে চলছে সাধারণ মানুষ এটা নিয়ে মাথা ঘামায় না। সন্ত্রাস নিয়েও কেউ কিছু বলে না। লাভ নেই, বরং বিপদ। দেশের মানুষ আস্তে আস্তে লন্ডনী হয়ে যাচ্ছে, আবহাওয়া নিয়ে আলাপ করে। এটাই নিরাপদ। তবে আমরা কিভাবে চলছি এটাও ভাবা দরকার। দশ বছরেরও বেশী সময় ধরে ট্রাফিক জ্যাম হল রাস্ট্রীয় সমস্যা। এটা নিয়ে বড় বড় কথা অনেকে বলে। কিন্তু কেউ এটা বলেনা দশ বছরেও কিছু শিখলাম না কেন? রাস্তাঘাট যথেষ্ঠ নয় এটাও বলে। রাস্তাঘাট যথেষ্ঠ নয়? এটা ফালতু কথা। আসল কথা হচ্ছে আমরা অন্য সব কিছুর মত রাস্তাঘাটের সাথেও চরম দুর্ব্যবহার করছি। অথবা, আমরা জানিনা রাস্তাঘাট কিভাবে ব্যাবহার করতে হয়। আমি ইকবাল ভাইকে কলেজ রোড টা প্র্যাক্টিক্যাল এক্সাম্পল হিসেবে দেখালাম। মাঝখানে ডিভাইডার, দুপাশে যানবাহন চলাচলের ব্যাবস্থা। এখানে অনায়াসে দুটো করে লেইন হয়। ফুটপাথ আছ কিন্তু সেখানে দোকান বসে প্রতিদিন। এর নাম ফুটপাথ পাল্টে শপ পাথ রাখেনা কেন? ঢাকা, চট্টগ্রাম, ফেণী, কুমিল্লা কোথাও রাস্তা কম এটা বলার সুযোগ নেই। ডিভাইডার ওয়ালা চার লেনের রোড লন্ডনে শহরে খুব কমই আছে। সবাই বলে যানবাহন অতিরিক্ত। যানবাহন বেশী, জনসংখ্যা বেশী এটা খুবই সত্যি তবে অতিরিক্ত এটাও অবাস্তব কথা। ঢাকায় এটা বেশি, চট্টগ্রামে ওটা বেশী, ফেণীতে সেটা বেশী, তাই জ্যাম বেশী। এগুলো আজাইররা কথা। এসব বলে আমাদের আচরণগত সমস্যা নিজেরা ঢাকার চেষ্টা করি। ঢাকায় সব মিলিয়ে যানবাহনের সংখ্যা যত, লন্ডনে শুধু গাড়ীর সংখ্যাই তারচেয়ে

তখন পথে নামলে জানা যেত না আদৌ পথ শেষ হবে কি না।

কমপক্ষে ছয়গুণ বেশী। অথচ লন্ডনের রাস্তাঘাট সব চিপা চিপা। সেন্ট্রাল লন্ডনের কিছু কিছু এলাকায় এখনও পাঁচশত বছর আগের ঘোড়াগাড়ীর (Horse and caravan) লেআউট পরিবর্তন করা হয় নি। বিদেশে কি জ্যাম হয় না? অবশ্যই হয় তবে চার/পাঁচ মাইল যেতে চার/পাঁচ ঘন্টা লেগে যায় না। কেননা সেখানে সবাই একটা সুনির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে চলে। আমাদের দেশে শহরগুলোতে যে পরিনাম রাস্থাঘাট আছে সেগুলো বর্তমানসময়ের জন্য ঘথেষ্ঠ। প্রয়োজন শৃংখলা, নিয়মানূবর্তিতা। কেউ কাউকে মানেনা, সম্মান সৌজন্যবোধ দেখানো উঠে গেছে বহু আগে, কেউ কারো কথা শোনেনা, রাস্তায় নামলেই ইচ্ছেমত চালাতে থাকে, চলতে থাকে। রাইট সাইড, রং সাইড বলে কিছু নেই। হাজার হাজার চালক, এক ড্রাইভার জানেনা আরেক ড্রাইভার এখন কি করে বসবে। ফাঁক পেলেই নাক গলিয়ে দিচ্ছে। হর্ণ বাজছে অবিরাম, তা না হলে কেউ হয়তো মরেই যাবে। জীবন রক্ষায় হুইসেল। বিশৃংখলা আমারদের রক্তে, মাংসে, মস্তিষ্কে। সবাই মিলে এমন করলে জ্যাম হবেই এটা জানা কথা, তবু করছে। হাজার হাজার যানবাহন, সবার একটাই উদ্দেশ্য, “আমি আগে যাবো।”

আচ্ছা! আমরা এত ক্ষ্যাঁত কেন?
এত কষ্টের মধ্যেও একটা আশা দেখতে পাই। বছরের পর বছর অনিয়ম, বিশৃংখলা এসব দেখে দেশের মানুষ Bored, চরম বিরক্ত। ভেতর ভেতর সবাই শৃংখলা চায়। ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে এমন একটা বাংলাদেশ রেখে যেতে চায় যেখানে ওরা স্বস্তিতে থাকবে। থাকবে নিরাপদে, উপদ্রবহীন জীবন যাপন করবে। একদিক থেকে ভাবলে আশার আলো, অন্য দিক থেকে ভাবলে অন্ধকার, “স্বপ্ন লজ্জ্বাহীন।”
ইকবাল ভাইর দৃষ্টিও হারিয়ে যায় আশা আর হতাশার মাঝামাঝি কোথাও। এ বয়সে নিজেকে নিয়ে কেউ ভাবেনা। হৃদয়জুড়ে থাকে সন্তানেরা, তাদের ভবিষ্যৎ। আমার শৈশবে দেখা বয়স্কাউট ক্যাপ্টেন ইকবাল ভাই আজ একজন বাবা। আমিও।
কিভাবে সময় চলে গেলো টের পেলাম না। ‘আবার দেখা হবে ইনশা আল্লাহ্।’ বিদায় নিলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Post comment