আম্মার জন্য কাজ, অতঃপর ফেণী
১৪.০১.২০১৯
১৭.০১.২০১৯
১৪ তারিখ সকাল সকাল বের হবো ভাবলাম, আম্মা বলে পেপার না পড়ে দিন শুরু করা যায়? নাস্তার টেবিলে আস্তে ধীরে পেপার টেপার পড়ে শ্যামলীর দিকে রওনা দিতে দিতে দুপুর গড়িয়ে গেলো। তা-ও সিএনজি করে গেছি বলে রক্ষা, ক্যাব (উবার) নিয়ে গেলে আরো অনেক দেরী হত। ঢাকায় বের হলে এক কাজ সারতেই সারাদিন লেগে যায়।
সবাই জ্যামের কারন হিসেবে রাস্তা ছোট বা পর্যাপ্ত নয় বলে যা একদম ফালতু কথা। ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলোর কথা বাদ দিলাম, সাধারন রাস্তাও ডিভাইডারের দুপাশে যে পরিমান প্রশস্থ, অনায়াসে সেখানে তিনটা লেন হয়ে যায়। শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশে যে পরিমান রাস্থাঘাট আছে সেগুলো যথেষ্ট। ঢাকার রাস্তায় অনেক গাড়ী, কথা সত্য কিন্তু লন্ডনের ছয় ভাগের একভাগও না। অথচ লন্ডনের রাস্তাগুলো কি অনেক বেশি চওড়া? মোটেও না। ঢাকার রাস্তায় জ্যামের সবচেয়ে বড় কারন আমাদের খাসালত (আচরণ, Behaviour)। হাজার হাজার ড্রাইভার, গাড়ী, বাইক, রিকশা, সিএনজি, বাস, ট্রাক আরো কত কি। একজন চালকও জানেনা আরেক চালক কখন কি করে বসবে। একসাথে হাজার হাজার ড্রাইভার যদি, “আমি সবার আগে যাবো।” এই মানসিকতা নিয়ে গাড়ি চালায় সেখানে জ্যাম হবেই। ছয় থেকে দশ ইঞ্চি ফাঁক পেলেও সেখান দিয়ো গোটা গাড়ি গলিয়ে দিয়ে বের হয়ে যেতে চায় যা কিনা অসম্ভব। যে যেখানে যায়গা পায় গাড়ি চালিয়ে দেয়। রাইট সাইড রং সাইড বলে কিছু নেই। স্থানীয় রাস্তা বা হাইওয়ে, সবখানে রং সাইডে সমানে গাড়ী চলে। সবচেয়ে অবাক হয়েছি ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েতে একসাইডে জ্যাম থাকায় রং সাইড দিয়ে পুলিশের গাড়ি আর ডিসির গাড়ির বহর যাচ্ছে। হাইওয়েতে যত্রতত্র ট্রাক, বাস এমনকি সিএনজি রং সাইডে চলতে দেখেছি। কারো কিছু বলার নেই, করার নেই। বিশৃংখলা আমাদের অস্থি-মজ্জা-ডিএনএ তে ঢুকে গেছে। সব কিছুতেই “নিয়ম ভাঙ্গো, নিয়ম ভাঙ্গো” কালচার। এই ভয়াবহ অবস্থা দশ বছর আগেও ছিলো না। মানুষ এখন নিজেদের বিশৃংখলায় অতিষ্ঠ, তাই তারা সবাই শৃংখলা চায়। কিন্তু মুখে শৃংখালার কথা বললেও আচরণে বিশৃংখল। অদ্ভুত, কনফিউজড আর আত্মবিশ্বাসহীন জাতি আমরা। আমরা সত্যি জানিনা আমাদের শান্তি কোথায়। শৃংখলা আর ধৈর্য, এই দুই শব্দ অভিধান থেকে উঠে গেছে।
প্রথমে গেলাম শানু আপুর বাসায়। মিতু আপু কষ্ট করে রাস্তা পর্যন্ত এলেন আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। গুলশান থেকে আপা এসেছে আগেই। শানু আপা, পিন্টু ভাইয়া, মিতু আপা, আম্মা, আমি আর রুমা আপা। শানু আপা, শিরী আপা, বিলকিস আপা আর মিতু আপা হচ্ছে আম্মার জানের জান। আপারাও তাই। বিলকিস আপা আমাদের মাঝে নেই। শানু আপা, আম্মা, মিতু আপা আর আপা (রুমা); ওনারা মেতেছেন গল্পে। দুপুের খেয়েদেয়ে সবাই বসেছে আড্ডায়, অন্যদিকে আমি বসেছি পিন্টু দুলাভাইর সাথে।
গতবার যখন এসেছিলাম বসতে পারিনি, পিন্টু ভাইয়া খুব মন খারাপ করেছিলেন। একটু কথা বলে যাবারও সময় হয় না? এত ব্যস্ত, অনেক বড় হয়ে গেছিস? না ভাইয়া, আপনাদের সামনে বড় হবার সুযোগ নেই, হতে চাইও না। পিন্টু ভাইয়াকে শ্রেফ দুলাভাই বললে ভুল হবে, উনি আমাদের গুরুজনও।
এবার আর ভুল হয় নি। যতক্ষন ছিলাম ভাইয়ার সাথে কথা বলেছি। ভাইয়া আমার সাথে কথা বলে আরাম পান। উনিও ফেণীর আদিবাসী, পাইলট হাই স্কুলের ছাত্র। ফেণীর পুরোনো লোকজন সবাইকে চেনে, আমিও তাই। গল্প শুরু হলে শেষ হতে চায় না, ভাইয়াও হারিয়ে যান অতীতে। অয়নকে নিয়ে কথা হল, ওকে নিয়ে ভাইয়ার স্বপ্নের শেষ নেই। এঘর ওঘর ঘুরিয়ে অয়নের নির্দেশনায় করা ঘরের নতুন ইন্টেরিয়র ডেকরেশন দেখালেন ভাইয়া, অনেক সুন্দর, ছিমছাম, চোখে সরাসরি আলো লাগেনা। ঘর মনে হয় আরেকটু বড় হয়ে গেছে। অসাধারণ। মাশা আল্লাহ্ কাজকর্ম নিয়ে অয়ন বেশ ভালোই আছে, এখন বৌমা দরকার। কিন্তু অয়নের কোনো আগ্রহ বা মাথাব্যাথা নেই। কথা সত্য, অয়ইন্নারে কান ধরে বিয়া করায়ে দিতে হবে।
বিকেলে সবাই মিলে গেলাম শিরী আপুর বাসায়। ওনার মোহাম্মদপুরের বাসায় আমি এই প্রথম গেলাম। শেষবার শিরি আপুর বাসায় গেছিলাম সম্ভবতঃ ১৯৯৭ সালে। আজিমপুর বাসায় তবে বেবী আইসক্রীমের মোড়ের কাছের বাসায় না, এটা তার পরের টা। বাসায় বাবু, টুম্পা আর তৃষা ছিলো। ওরা তখন অনেক ছোট। খসরু দুলাভাই বরাবরের মত অনেক দুষ্টুমী আর খুনসুটি করলেন। বিলকিস আপুও ছিলেন তখন। অনেক অনেক মায়া করতেন আমাকে বিলকিস আপু, যা কখনো ভোলার নয়।
ডোনা, টুম্পা যার যার বাসায় তাদের সংসার নিয়ে আছে। তৃষা আছে অষ্ট্রেলিয়ায়, পিএইচডি করছে। এখন বাসায় শুধু শিরী আপু আর বাবু। যতক্ষন ছিলাম, মনে হচ্ছিলো খসরু দুলাভাই হঠাৎ করে এসে বলবে, “ওইশ্ শালাবাবু!” খুব মিস করছিলাম উনাকে। পরেরবার ডোনা, টুম্পা আর তৃষার সাথে দেখা হবে আশা করছি।
মাগরেবের নামাজের পর এলাম মিতু আপার বাসায়। অগ্নি মাত্র সেদিন ক্যানাডা চলে গেলো স্বামীর কাছে। অরণ্য আছে তবু অগ্নির অনুপস্থিতিতে বাসাটা খালি খালি লাগছে। আপুদের সবার বাসা কাছাকাছি। হেঁটেও চলে আসা যায়। দুপুরে শানু আপুর ওখানে দুনিয়ার খাবার দাবার, এরপর শিরী আপুর বাসায় বিকেলের নাস্তা। মিতু আপাও বিশাল আয়োজন করেছে। বাংলাদেশে এসে পেট বড় হয়ে যাচ্ছে। এত খাওয়া যায়? এদিকে রাতের খাবারের আগে একগাদা নাস্তাও খাইয়েছে। মিতু আপা আম্মা আর আপাকে বাসায় রেখে দেবে, রাতে কোথাও যেতে দেবেনা। দুলাভাই আসার পর উনার সাথে গল্প করতে করতে সবাই রাতের খাবার খেলাম। দুলাভাইর খুব একটা পরিবর্তন হয় নি, সেই প্রথম যেমনটি দেখেছিলাম তেমনই আছেন। হ্যান্ডসাম, হাঁসিখুশী আর খুব ভালোমানুষ আমাদের ভাইয়া। – সত্যি কথা বলতে পিন্টু ভাই, খসরু ভাই এবং টিপু ভাই এরা সবাই খুবই ভালো মানুষ। আমাদের পরিবারের সৌভাগ্য আমরা তাঁদের পেয়েছি। সেই সন্ধ্যায় খানিক দেরীতে জিতুও এসেছিলো ওর গাড়ি নিয়ে। আমাকে বললো রাত সাড়ে দশটার দিকে জ্যাম আর থাকেনা, যদি অপেক্ষা করি তাহলে নামিয়ে দিতে পারবে। কথাটা সত্যি। সাড়ে দশটার পর রওনা দিয়ে আধ ঘন্টারও কম সময়ে দোলাইরপাড় পৌঁছে গেলাম। অবিশ্বাস্য। জিতু আমাকে নামিয়ে দিলো। ওদিকে আম্মা আর আপা রয়ে গেলো মিতু আপুর বাসায়।
পরদিন আম্মাকে নিয়ে আপাও এলো কান্তাদের বাসায়। আপা আর আমার শাশুড়ী অনেক আগে থেকে একে অন্যের পরিচিত। খুব ভালো বন্ধুত্বও। নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিক থেকে আগ্রাবাদ (চট্টগ্রাম) থাকতে একই বিল্ডংয়ে থাকতেন তাঁরা, সেই থেকে পরিচয়। কান্তাকে আমি প্রথম দেখি ১৯৯৩ সালে, তখন ও ‘বাইচ্চা মানুষ,’ স্কুলে পড়ে। ওর জন্মদিনের ফটো তোলার জন্য গিয়েছিলাম। তখন ভুলেও ভাবিনি একদিন ওর সাথে আমার বিয়ে হবে। শুধু বিয়ে নয়, এখন আমাদের একটা মেয়েও আছে। তারপর একটা ছেলে। আর আমরা দুজন এখন বুড়া হয়ে গেছি। যাই হোক, বর্তমান সম্পর্ক হিসেবে আমার শশুর-শাশুড়ী আপার খালা/খালু, গুরুজন। কিন্তু কিসের কি? সমানে চলছে দুষ্টামী। আর খাওয়া দাওয়া আনলিমিটেড। মাঝে মাঝে মনে হয় বার্স্ট করবো। যাই হোক, আগামী কাল অর্থাৎ ১৬ জানুয়ারী জরুরী কাজ আছে।
১৬ তারিখের জরুরী কাজ হচ্ছে আম্মার জন্য ভিসা এ্যাপ্লিকেশন জমা দেয়া। গুলশান-১ নম্বরে ভি.এফ.এস নামে একটা প্রাইভেট কোম্পানী আছে, ওদের অফিসে ফরম পুরন করে, পাসপোর্টের সাথে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জুড়ে দিয়ে, ভিসা ফি সহ সেখানে জমা দিয়ে আসতে হয়। এ্যাপ্লিকেশনের প্যাকেট চলে যায় দিল্লীতে, সর্বোচ্চ পনের দিনের মধ্যে ডিসিশান সহ ফেরত আসে। ভি.এফ.এস এর আর কোন কিছু করার নেই, ওরা শ্রেফ কগজপত্র আর সঠিক ফি গ্রহন করতে পারে। কেউ যদি ভুল ভ্রান্তি করে সেক্ষত্রে ওরা অবশ্য দেখিয়ে দেয় তবে কাগজপত্র ঠিক না থাকলে ওরা বিনয়ের সাথে বুঝিয়ে বলে এপ্লিকেশন সাকসেসফুল না-ও হতে পারে। যাদের সীমবদ্ধতা আছে তাদের জন্য প্রিমিয়াম সার্ভিসের ব্যাবস্থা করে আছ, অর্থাৎ ফরম থেকে শুরু করে কাগজপত্র দেখা, বায়েমেট্রিক (ফিঙ্গারপ্রিন্ট, রেটিনাস্ক্যান ইত্যাদি) নেওয়া। এর জন্য ছয় হাজার টাকা চার্জ করা হয়। আমি থাকতে এসবের দরকার কি? ভি.এফ.এস এর জবাব হল শুধুমাত্র এ্যাপ্লিক্যান্ট ঢুকতে পারবে আর কেউ না। কিন্তু আম্মার বয়স বিবেচনা করে আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিলো তবে প্রসেসিংএর সময় আম্মার পাশে থাকতে পারবোনা। অগত্যা বাধ্য হয়ে প্রিমিয়াম সার্ভিস নিলাম, সব মিলিয়ে এখন প্রায় সতের হাজার টাকা। আমি কার্ডে পে করতে চাইলাম, ওরা বললো শুধু ক্যাশ নিতে পারবে। আকাশ থেকে পড়ার অবস্থা, মিষ্টি দোকান, ফলের দোকান সবাই কার্ড নেয়, ভি.এফ.এস নেয় না! এদের অবস্থাও কি লন্ডনের বাঙ্গালী পাড়ার মুদি দোকানদারদের মত নাকি? ওদের কার্ড পেমেন্টের ব্যাবস্থা থাকলেও বলে ক্যাশ নিয়ে আসেন, কার্ড মেশিন খারাপ। ট্যাক্স ফাঁকি দেবার জন্য এমন করে, বলে বেচা বিক্রী নাই। সারা বছর যদি বিক্রীই না হয়, তাহলে বছরের পর বছর লস দিয়ে এই ব্যাবসা করছেন কেন? আপনার সংসার চলে কি করে? বলে, “রিযিকের মালিক আল্লাহ্।” কথা সত্য, আল্লাহর রহমতে দেশে তারা হেলিপ্যাডওয়ালা ভিলা বানায়। ভিলার ভেতরে বসে খাওয়াদাওয়া করে, সেই হিসাবে বিল্ডিংও রিযিক। যাই হোক…
ভাগ্যিস পকেটে আরো কিছু ক্যাশ টাকা ছিলো, প্রিমিয়াম সার্ভিস নিলাম। সাথে পই পই করে বলে দিলাম আমার মা কে যেন কিছু খেতে দেওয়া না হয়। তাঁর সমস্যা হয়, শুধু পানি ছাড়া আর কিছু না। আমি বসে আছি ভিসা প্রার্থীদের ওয়েটিং এরিয়ায়। সামনে কাঁচের পেছনে নাম্বার দেয়া অনেকগুলো বুথ। ডানে ক্লোজড ডোর বুথ সেখানে সম্ভবত বায়োমেট্রিক নেওয়া হয়। পেছনে সদর দরজা যেখান দিয়ে সিকিউরিটি চেক পেরিয়ে ঢুকেছি। ওদের সিকিউরিটির অবস্থা দেখি মহা টাইট। রাস্তা থেকে অনেকগুলো সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠার পর এক সিকউরিটি, লিফট থেকে বেরিয়ে আরেক সিকিউরিটি। যেন ইসরায়েলের তেল-আবিব। এই ফ্লোরে আবার মাল্টিপল কান্ট্রির ভিসা প্রসেস করা হয়। ইউকে, অষ্ট্রেলিয়া আর ক্যানাডা। সব এক ছাতার তলায়, গুড। ভেতরে মোটামুটি ভিসা প্রার্থীরা আছে আমি কেউ না। আম্মাকে নিয়ে কোথায় গেছে কে জানে? পাশ দিয়ে স্যূট-টাই পরা একজন ইয়াং ড্যাশিং হ্যান্ডসাম ভদ্রলোক একটা ট্রলিতে করে প্রচুর সফট ড্রিংকস, কেক, খাবার দাবার ইত্যাদি নিয়ে যাচ্ছে। আম্মাকে দেবেনাতো আবার?
অনেকটা মুখ ফসকে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “এগুলো কার জন্য নিচ্ছেন?”
“ফর আওয়ার ক্লায়েন্ট, স্যার! প্রিমিয়াম ক্লায়েন্ট।” স্যার শব্দটা শুনতে ভালো লাগেনা। মনে হয় দেশে না, ইন্ডয়াতে বসে আছি। তবে অস্বীকার করবো না, এটা ভদ্রতা প্রকাশের শক্তিশালী মাধ্যম। তাই বলে স্যার? আমাকে?? দেশে বা বিদেশে, বাঙ্গালীদের সাথে ইংরেজী বলতে পারিনা, আসল কথা হল ইংরেজী পারিই না! তোতলাতে থাকি, তাই বিশুদ্ধ বাংলায় বললাম, “আমি যদি ভুল না করে থাকি, প্রিমিয়াম ক্লায়েন্ট একজন?” হাঁসিমুখ তবে প্রশ্নালু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি তার দিকে।
“জ্বী স্যার, মিসেস চৌধুরী।” আবারও বিনয়ী জবাব তবে ট্রলিটা হাল্কা পুশ করে বোঝালো তাকে যেতে হবে।
“আমি বলেছিলাম তাঁকে কোনো খাবার যেন না দেওয়া হয়, পানি দেওয়া যেতে পারে যদি তিনি চান।”
“এটা কার্টিসি স্যার, প্লীজ আপনি চিন্তা করবেন না। আমি উনাকে বলে দেবো। স্যার আমাকে যেতে দিন, প্লীজ।” সে ট্রলি নিয়ে আমার বাঁ দিকের কোনো এক দরজা গলে ভেতরে চলে গেলো।
আমার মায়ের প্রতি ওদের আন্তরিকতা দেখে ভালো লাগছে, কিন্তু এসব খেলে আম্মার বুক জ্বলা শুরু হবে। বেশ কিছুক্ষন পর আম্মার বের হল, হাতে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ। আম্মার মুখে চোরা চোরা হাঁসি। হঠাৎ মনে হল শাড়ী পরা, সত্তুরোর্ধ বয়েসি উনি আমার মা নন, আমার তাসনুভা। একদম শিশু তাসনুভার মত করে বললো, “ব্যাগের ভিতরে বহুত খানা দিছে।” এক ব্যাগ খানা বিজয়ের হাঁসি আমার মায়ের মুখে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, আম্মাকে খাবার জন্য জোর করেনি, বরং খাবার সুন্দর করে প্যাকেট করে দিয়েছে। আপা নীচে অপেক্ষা করছিলো। আপার বাসা, অর্থাৎ জিতুর বাসা একদম কাছে, হেটেঁও যাওয়া যায়। কিন্তু আম্মাকে নিয়ে হাঁটবোনা, দেখি উবার কাজ করে কিনা। আমার বিলাতি উবার এ্যাপ চমৎকার কাজ করলো। বাসায় উপরে উঠার সময় দারোয়ানকে দিয়ে আপা বিরিয়ানী আনতে দিলো। দুপুরে আপার বাসায় মা-ছেলে-মেয়েতে ওই বিরিয়ানী খেলাম। গুলশান-১ এর অখ্যাত কোন রেষ্ট্যুরেন্টের বিরিয়ানী এত স্বাদ হবে ভাবিনি। বরং পুরোনো ঢাকার বিরিয়ানী আমার অখাদ্য মনে হয়েছে। হাজীর বিরিয়ানী, পাজীর বিরিয়ানী, নান্না বিরিয়ানী, ডান্ডা বিরিয়ানী যতসব গালভরা নাম। রাবিশ! আপা অনেক জোর করেছে রাতে থাকার জন্য, আমি থাকিনি, আম্মাকে নিয়ে কালই ফেণী যাবো। তাই সোজা দোলাইরপাড় কান্তাদের বাসায় ফিরে এলাম সবাই মিলে।
* * *
আম্মাকে নিয়ে পুরো দশদিন কান্তাদের বাসায় ছিলাম। এই দশদিন আমার জীবনের অন্যতম সুন্দর সময় কেননা সব সময় আমি মায়ের পাশে ঘুমিয়েছি। বহু বছর পর হারিয়ে যাওয়া শৈশবের অনুভুতি, এটা ঠিক বুঝিয়ে বলাম মত নয়। ছেলেবেলায় মা-বাবার মাঝখানে ঘুমাতাম। প্রথম যেদিন সিঙ্গেল খাটে আমাকে আলাদা করে শুতে দেওয়া হল সেদিন রাতে কাঁদতে কাঁদতে বালিশ ভিজিয়ে ফেলেছিলাম। সেই ভেজা বালিশেই মাথা রেখে ঘুমিয়েছি। নিয়ম হচ্ছে যেদিন থেকে স্কুল শুরু সেদিন থেকে খাট নিজের, বিছানা ভাঁজ করতে হবে নিজেকে। এমনকি গোসল করার পর হাফপ্যান্ট ফেলে আসা যাবেনা, নিজ হাতে ধুতে হবে। সবাই এত নিঃষ্ঠুর কেন? এই প্রশ্ন আর চোখের জল মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতো।
* * *
পরদিন, অর্থাৎ ১৭ তারিখ সকালে ভোঁ-দৌড়। আম্মা আর আপাকে নিয়ে স্টার লাইনে করে আবার ফেণী যাত্রা ঢাকা থেকে। এবারের যাত্রা সুপাহিটেরও বাপ্ – বাম্পার হিট। প্রায় দশ ঘন্টা লেগেছে ফেণী পর্যন্ত আসতে। বাসে যে কয়জন পুরুষ প্যাসেঞ্জার ছিলো, সবাই মিলে যদি বাসকে কান্ধে নিয়া হাঁটা ধরতাম তাহলেও মনে হয় একটু আগে ফেণী পৌঁছতে পারতাম। মহিলা এবং শিশুরা নাহয় বাসের ভেতর থাকতো! কিন্তু এমন জ্যাম, কাঁধে নিয়ে হাঁটতাম কোথায়? জাম কইলে ভুল হবে, কাঁডল। ফেণী বাসায় পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় সন্ধ্যা।
সন্ধ্যার পর রানী আপার হাজব্যান্ড বাবুল ভাই এলেন ওনাদের ছোট ছেলে জামিলকে নিয়ে। বাবুল ভাইকে প্রায় ২৭ বছর পর দেখলাম। জামিলকে এই প্রথম। বাবুল ভাই অনেক অনেক ভালো একজন মানুষ, উনার সাথে গল্প করতে খুব ভালো লাগে। দুলাভাই হিসাবে ক্ষেপাই, উনি রাগ করেন না, বরং হাঁসেন। জামিলও অসাধারণ। রাণী আপুকে সামনাসামনি সর্বশেষ দেখেছি ১৯৯৩ সালে, সময় যে কিভাবে চলে যায়। বাবুল ভাইয়া আর জামিলের সাথে সোহাগ ভাইয়াও ছিলো। সোহাগ ভাইয়াকে দেখলাম প্রায় বিশ বছর পর। উনাদের দেখে দশ ঘন্টার বাস জার্নির ক্লান্তি আর রইলো না। সন্ধ্যাটা মোটামুটি ভালোই কাটলো। পরে বাবুল ভাই, জামিল, সোহাগ ভাইয়া সহ ফেণীর রাস্তায় হেঁটে ট্রাংক রোড গিয়ে শপিং করেছি। সেটাও ছিলো এক মজার অভিজ্ঞতা। ওনাদের এগিয়ে দিতে দিতে শেষমেষ বিরিঞ্চিতে মেঝোমামার বাসা অব্দি চলে গেছিলাম।
ফেরার পথে দেখ হল ইকবাল ভাইর সাথে।
সে গল্প হবে একদম আলাদাভাবে. . .