নিউ ইয়র্ক নিউ ইয়র্ক – ১ (Cruise to Staten Island)
অগাষ্ট ৬, ২০১৯
পায়ে হেঁটে নিউ ইয়র্ক সিটি সেন্টারে ঘুরে বেড়িয়েছি বহুক্ষন। (ধন্যবাদ জয়া মা, ধন্যবাদ জামাই বাবা বেলাল)
বেলাল আমাদের নাই ইলেভেন মেমরিয়াল তথা ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের সামনে ড্রপ করে দিয়ে গেলো। আমরা বলতে আমি, ভাতিজি জয়া, নাতি রাফসান এবং নাতনী নাজাহ্। প্রথমে নাইন ইলেভেন মেমরিয়াল ভালোমত ঘুরে ফিরে দেখলাম যেখানে এক সময় টুইন টাওয়ার ছিলো। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১১ তারিখে পর পর দুটো যাত্রীবাহি বিমান টুইন টাওয়রের দুটো টাওয়ারকে আঘাত করে গুঁড়িয়ে দেয়। ভয়াবহ এই সন্ত্রাসী হামলায় বিমানগুলোর সকল ক্রু/যাত্রী সহ মোট তিন হাজার মানুষ মুহুর্তে মারা যায়। ভেঙ্গে যাওয়া দুটো টাওয়ার যেখানে ছিলো সেটা এখন নিহতদের স্মরণে সংরক্ষিত। বিশাল এলাকাজুড়ে বানানো হয়েছে কৃত্রিম জলপ্রপাত, পথরে খোদাই করে লেখা হয়েছে হাজারো নিহতের নাম। এত বছর পরও কি এক গভীর ব্যাথাতুর, মন খারাপ করা পরিবেশ। পাশে বানানো হয়েছে নাইন–ইলেভেন মেমরিয়াল মিউজিয়াম। আমাদের যাওয়া হয় নি, অনেক লম্বা কিউ। সময় হবেনা। নতুন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার পাশেই বানানো হয়েছে তবে এখন এটা একটা বহুতল ভবন। প্রথমে নাম দেওয়া হয়েছিলো ফ্রীডম টাওয়ার।
জয়া আমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখালো বিধায় আমার সময় অনেক বেঁচে গেছে, ওর অফিস এখানেই কোথাও। জয়ার বাচ্চারা আমার নাতি নাতনী, ভাইয়া বলে ডাকে আমাকে। মাশা আল্লাহ্ অনেক সুইট, বিশেষ করে মেয়েটা এক্কেবারে কিউটের ডিব্বা। নাইন–ইলেভেন মেমরিয়ালের পাশেই বৃটিশ কলোনিয়ালদের বানানো “সেইন্ট পল’স্ চ্যাপেল” যা নির্মান করা হয় ১৭৬৬ সালে। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর ১১’র সেই ভয়াবহ হামলায় টুইন টাওয়ারসহ আশপাশের আরো বহু ভবন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে অথচ ঠিক পাশে থাকা সত্বেও প্রাচীন এই চার্চ এবং গ্রেভইয়ার্ড এতটুকু ক্ষতিগ্রস্থ হয় নি। তাই এর ডাকনাম হয়ে গেছে, “The Little Chapel That Stood.” এমনকি স্থানীয়দের দাবী চার্চ সংলগ্ন প্রাচীন গ্রেভইয়ার্ড এবং এর একটা গাছেরও কোন ক্ষতি হয় নি।
চার্চের সামনে দেখা যায় বিশাল একটা ঘন্টা, The Bell of Hope, যেটা সেইন্ট ম্যারী–লে–বোও (St. Mary-le-Bow chapel of England) এর পাঠানো উপহার। নাইন–ইলেভেনে নিহতদের প্রতি সম্মানস্বরূপ এই ঘন্টা বা বেল তৈরি করা হয় পূর্ব লন্ডনের বিখ্যাত হোয়াইটচ্যাপেল বেল ফাউন্ড্রীতে (Whitechapel Bell foundry)। ২০০২ সাল থেকে প্রতি ১১ সেপ্টেম্বরে নিহতদের স্মরণে এই বেল বাজানো হয়।
নাইন–ইলেভেন মেমরিয়াল পেরিয়ে সেইন্ট পল’স্ চ্যাপেল, তার ঠিক পেছনেই ব্রডওয়ে। সেখান থেকে হেঁটে পূবদিকে খানিকটা এগিয়ে গেলে বিখ্যাত ওয়াল স্ট্রীট যেখানে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্টক এক্সচেঞ্জ যার প্রতিদিনের ট্রেডিং ভ্যাল্যূ প্রায় ১৭০ বিলিয়ন ডলার (চৌদ্দ হাজার তিনশত বাষট্টি কোটি টাকা)। এই ওয়াল স্ট্রীট নিয়ে চলে নানান জল্পনা–কল্পনা, লেখা হয়েছে অনেক কাহিনী, বানানো হয়েছে ব্লকবাস্টার হলিউড মুভি। ষড়যন্ত্র তত্ববিদ বা কনস্পিরেসি থিয়োরিস্টরা মনে করে এই ওয়াল স্ট্রীট থেকেই দুনিয়ার অর্থনীতির সলতে ঘোরানো হয়। এরা চাইলে কোন দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করে দিতে পরে কিংবা ধ্বংস। আমি বিশ্বাস করিনা, আমি মনে করি আমেরিকরার মাটিতে ওয়াল স্ট্রীট বৃটিশদের হাতে গড়া পুতুল মাত্র। যাই হোক, ওসব ভেবে কাজ নেই। ব্রডওয়ে ধরে আরেকটু সামনে গেলে ফেডারেল ব্যাংক অফ নিউ ইয়র্ক। ওখানে নাকি সারা পৃথিবীর সব দেশের সোনা (Gold) জমা থাকে, যার যত বেশী স্বর্ণ সেই দেশের মু্দ্রার মান তত বেশী।
ব্রডওয়েতে হাঁটাহাঁটি করতে করতে দক্ষিন–পশ্চিম দিকে এগিয়ে গেলে ব্যাটারী পার্ক এবং ব্যাটারী গার্ডেন। সেখানে স্টেটেন আইল্যান্ড ফেরী টার্মিনাল। এটা ফ্রী সার্ভিস, বিনে পয়সায় ফেরী করে স্টেটেন আইলেন যাবার ব্যাবস্থা। স্থানীয়–অস্থানীয় নির্বিশেষে সকলের জন্য নিউ ইয়র্ক মেয়েরের প্রীতি উপহার।
স্টেটেন আইল্যান্ডের আসল মালিক কিন্তু নিউ জার্সি অথচ এর বর্তমান মালিক কলোনিয়াল নিউ ইয়র্ক সরকার। বৃটিশদের শাসন থেকে মুক্ত স্বাধীন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউনাইটেড স্টেটস সরকার যতই গলা উঁচু করে চীৎকার করে বলে “আমরা কলোনি বিরোধী!” ততই বেশী বোঝা যায় এটা ডাঁহা মিথ্যে কথা। স্টেটেন আইল্যান্ড, লিবার্টি আইল্যান্ড এবং এলিস আইল্যান্ডের প্রকৃত মালিক নিউ জার্সি হলেও বৃটিশ আমলে সেই যে নিউ ইয়র্ক এদের পেটে ঢুকিয়েছে। আমেরিকা স্বাধীন হবার এত বছর পরও দখলদার নিউ ইয়র্ক রাজ্য সরকার এই দ্বীপগুলোর দখল ছাড়েনি। পরে জানা যায় ২০১৭ সালে সুপ্রীম কোর্টের এক বায়ে নিউ জার্সি এলিস আইল্যান্ড ফেরত পায় যদিও দখলদার কলোনীবাজ নিউ ইয়র্ক সরকার এখনও ছাড়েনি তার বড় প্রমাণ এলিস আইল্যান্ডের জিপ কোড।
একজন প্রসিদ্ধ আদার ব্যাপারী হিসেবে এসব সাত–পাঁচ ভাবতে ভাবতে বিশাল জনস্রোতের মাঝ দেয়ে ফেরী টার্মিনালে ঢুকছি আর অবাক হচ্ছি। লাখো মানুষের ঢল অথচ কি সুশৃংখল সবাই। সামনে বিশাল কাঁচের অটোম্যাটিক ডোর, তার উপরে দেড় ফুট চওড়া আর প্রায় বিশফুট লম্বা ফিতার মত এলসিডি স্ক্রীন। সেখানে ডোর নাম্বার উল্যেখ করা আছে, আবার নোটিশ কিংবা বিজ্ঞাপন উঠছে। ফেরীতে উঠার পর সবাই মিলে একদম টপ ডেকে চলে এলাম। ফেরীর প্রায় সব প্যাসেঞ্জারই ট্যূরিষ্ট এবং সবাই এই দিকেই দাঁড়িয়েছে কারন সবার উদ্যেশ্য একটাই, ফেরী থেকে স্ট্যাচু অর লিবার্টি দেখা। জয়াকে আবার ধন্যবাদ দিলাম।
আটলান্টিকের বুক চিরে ফেরী ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। অসম্ভব সুন্দর রৌদ্রোজ্জ্বল একটা দিন। বেলা গড়িয়ে গেলেও এখনো ঝকঝকে দিনের আলো। মুগ্ধ হয়ে দেখছি সব. . . ধীরে ধীরে নিউ ইয়র্ক সিটি দুরে সরে যাওয়া, ম্যাহটান স্কাই স্ক্র্যাপার্স, অন্যদিকে নিউ জার্সি, উল্টো দিকে নীল আটলান্টিক। কি অপরূপ সব, বাতাসের পাই সাগরের নোনা জলের গন্ধ, বুক ভরে নিশ্বাস নিই। হঠাৎ এই কোলাহল, জাহাজের দুলুনি, ইঞ্জিনের শব্দ, বাতাস, ঢেউ, বাতাসে গাংচিলের গ্লাইডিং, নীল আকাশ, দুরের নাম না জানা জাহাজ, সমুদ্রের নীল আর দিগন্তের শূন্যতা। সব কিছু খুব আপন মনে হয়। অনেক ভালো লাগা আবার বিষাদ মেশানো অদ্ভুত এক অনুভূতিতে ছেয়ে যায় মন। প্রায় উনিষ বছর আগে সমুদ্রজীবন ছেড়েছি, এখনো সমুদ্র আমায় টানে।
দুরে লিবার্টি আইল্যান্ডের উপর স্ট্যাচ্যূ অফ লিবার্টি দাঁড়িয়ে আছে, দেখে রোমাঞ্চিত হই। লিবার্টি আইল্যান্ডে যাবো, কাল কিংবা পরশু, নয়তো তার পরদিন। যেতে আমাকে হবেই। অন্যদিকে নিউ জার্সি আবার আরেক দিকে নিউ ইয়র্ক সিটি। সমুদ্র থেকে আসলেই অপরূপ সুন্দর লাগে দেখতে।
স্টেটেন আইল্যান্ডে নেমে তাড়াতাড়ি ফিরতি ফেরী ধরতে গিয়ে সৌভাগ্যক্রমে এই ফেরীটিই পেয়ে গেলাম। এবার আর লিবার্টি আইল্যান্ডের দিকে নয়, উল্টোদিকে বসলাম। দুরে ভেরাজানো ব্রীজ দেখা যায় যেটা নিউ ইয়র্ক আর স্টেটেন আইল্যান্ডকে একসাথে জুড়ে দিয়েছে। ম্যানহাটানে ফেরার সময় ধীরে ধীরে নিউ ইয়র্ক সিটি কাছে আসতে আসতে মনে হয় হাই রাইজ বিল্ডিংগুলো যেন গায়ের উপর উঠে যাচ্ছে।
গ্রীষ্মের শেষ বিকেল, হাল্কা মিস্টি বাতাস, শান্ত আটলান্টিকের উপর ভাসি আর ভাবি, “আমেরিকা, কখনোই তুই আমার হিট লিস্টে ছিলিনা, তুই ছিলি আমার স্বাভাবিক গন্তব্য। জানতাম, নিয়তি একদিন আমাকে এখানে নিয়ে আসবে।”