০৮.০১.২০১৯
১৩.০১.২০১৯

= ঢাকা আর ভুইঘর =

জানুয়ারীর ৮ তারিখ আমার জীবনের একটি বিশেষ দিন। বিপুল ভাইর সাথে দেখা হল। আমার সৌভাগ্য বিপুল ভাইর কল্যাণে দেশের ঐতিহ্যবাহী পিঠার স্বাদ নিতে পেরেছিলাম। অল্প সময়ে মনের অনেক ভাবের আদানপ্রদান হল।
পরদিন সন্ধ্যার পর কাওসারকে নিয়ে হাঁটলাম। দেশে কেউ হাঁটতে চায় না, কাওসার তার ব্যাতিক্রম। বাংলাদেশের পোড়া মাংস খবাবার কথা আগেই বলে রেখেছিলাম। ধানমন্ডি লেকের পাশে খোলা যায়গায় রাস্তা থেকে খানিকটা নীচুতে একটা রেষ্ট্যুরেন্ট বা ক্যাফে সেখানে অনেকক্ষন সময় নিয়ে বসে গরুর গোশতের ঝাল-ঝাল শিক কাবাব পর পর দুটো সাবাড় করলাম সাথে গ্লাসের পর গ্লাস লেমোনেড কিবংবা ফান্টা। লেকের ওই জায়গাটার নাম ‘রবীন্দ্র সরোবর’, রেষ্ট্যুরেন্টের নাম মনে নেই। তবে এটা মনে পড়ছে অনেকগুলো বাচ্চা বাচ্চা জুঁটির ভীড়ে আমরা দুই বুড়ো। জায়গাটাকে ওপেন রেষ্ট্যুরেন্ট না বলে ওখানকার স্মোকিং এরিয়া বলা যেতে পারে। ফুলের মত ফুটফটুে ছেলেমেয়েগুলো জোড়ায় জোড়ায় বসে সিগারেট ফুঁকছে। আমার পাশের টেবিলে চারটা মিষ্টি মেয়ে, যেন চারটা জীবন্ত চিমনী। ওদের সিগারেটের ধোঁয়ার কুন্ডলী আস্তে ধীরে আমাদের দিকে আসতে আসতে বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। ওরা সবাই ট্রাউজার্স, টি-শার্ট আর উপরে ফুলস্লীভ শার্ট, হাতা গুটিয়ে পরা। কাওসার মহা বিরক্ত, মেয়েগুলি বেয়াদ্দপের মত সিগারেট ফুঁকছে। কিন্তু আমার ভালো লাগছে। “বিদেশে থাকলে এমনই হয় গো মা, সব সহ্য হয়।”
চারিদিকে মুখ ঘুরিয়ে দেখলাম। ছেলে, মেয়ে, প্রতিটি মুখ সুন্দর। মন ভালো করা তারুন্যের সৌন্দর্য। আজ ওরা আয়েশ করছে, কিন্তু একদিন ঠিক ওরাই দায়িত্ব নেবে। পরিবার, সমাজ, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে সামনের দিকে। বুক ভরে নিশ্বাস নিলাম, টের পাচ্ছি বাতাসের সাথে ভেতরে ঢুকছে নিকোটিন আর ধুলোবালি। তবু ভালো লাগে। আবেগে আপ্লুত হয় মন। এখন আমি আমার দেশে, এখানেই আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা। মৃত্যু কি এখানে হবে?
বিদেশের হাঁটা আর দেশের হাঁটা এক নয়। প্রতি পদে পদে ধাক্কার হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে হাটছি, তবু হাঁটতে ভালোই লাগছিলো। কাওসার বলছিলো, “বঙ্গবন্ধুর বাড়ীটা একটু দেখে যা।” তাই একটা ডিট্যুর নিলাম তবে ৩২ নম্বরের কাছাকাছি গিয়ে দেখি রাস্তা বন্ধ, কিছু একটা হচ্ছে। ইলেকশান শেষ, সরকারের উচ্চ পদস্থ কেউ এসেছে হয়তো. . .
. . . বাংলাদেশে উচ্চ পদস্থ বলতে একজনই, প্রধানমন্ত্রী। বাকী সবগুলা দুধভাত। কিছু হলেই ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’-র হস্তক্ষেপ ছাড়া সমাধান হয় না। যদিও বিশাল মন্ত্রীসভা, উপদেষ্টা ইত্যাদি আছে। কিন্তু সমাধান দেয় না, কারন কোন ক্রাইম হলে দেখা যায় এদের কারো না কারো সংশ্লিষ্টতা আছে। আচ্ছা! প্রধানমন্ত্রী যদি না থাকে তখন এই দুধভাতগুলো কি করবে? বেশীরভাগই পশ্চিমা কোনো দেশে চলে যাবে হয়তো। ইউরোপ-আমেরিকা মাশাল্লাহ্ পলিটিকাল এ্যাসাইলামের লেবাসে চোর ছ্যাঁচড়দের অভয়ারণ্য। ওখানে গিয়ে দিনের বেলা সুপারমার্কেটে কামকাজ করবে আর সন্ধ্যার পর বাংলা পাড়ায় গিয়ে চায়ের কাপের ঝড় তুলবে। বৃটেন, আমেরিকা, ক্যানাডা এসব দেশে এখনো প্রচুর পতিত নেতা আছে যারা এক সময় দুর্দান্ত ক্ষমতাধর ছিলো। এখন সম্বল সন্ধ্যার পর বাংলাপাড়ায় চায়ের কাপের আড্ডা আর ফেইসবুক। এদের সংখ্যা বাড়ছে।
আমরা ইউ টার্ন নিলাম। সুলতানা কামাল মহিলা কম্প্লেক্সকে একপাশে রেখে লেকের দিকে এগিয়ে পায়েচলা পথ ধরে এঁকেবেঁকে দুই বন্ধু হাঁটছি। লেক সংলগ্ন পার্কে লোকসমাগম কম নয়। আছে প্রচুর হকারও। এর মাঝে কল্লোল আর কফিলের সাথে ফোনে কথা হল। ডাঃ কফিলের বাসা এখানেই কোথাও, লেকের ধারে। একটা ব্রীজ পেরিয়ে বাঁয়ে টার্ন নিয়ে ১০নং রোডে উঠতেই কফিলের সাথে দেখা।
– কফিল আমাদের পাইলট হাই স্কুলের বন্ধু, একসাথে সিক্স থেকে মেট্রিক পর্যন্ত পড়েছি। সব ক্লাশে ফার্স্ট হত, ৮৭ সালে আমাদের স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করে স্ট্যান্ড করেছিলো। সে আমলে স্ট্যান্ড করা ছাত্রদের দুর দুরান্ত থেকে দেখতে লোকজন ছুটে আসতো। কফিল এখন সিনিয়র ডাক্তার, তবে এখনও সেই আগের মতই আছে। মৃদুভাষী, চুপচাপ নিপাট ভদ্রলোক। একটেু পর কল্লোলও এলো। কল্লোল একেবারে ক্লাস-ওয়ান থেকে একসাথে। আমরা সবাই পানসী রেস্ট্যুরেন্টে গিয়ে বসলাম। কাওসার, কল্লোল আর কফিল। তিন ‘ক’ এর সাথে আমি ‘স’ বিপুল ভাই ফেইসবুকে কমেন্ট করেছিলো। ওখানেও কিভাবে সময় কেটে গেলো বুঝিনি। অনেকদিন পর ছেলেবেলার বন্ধুদের সাথে দেখা হলে কথা শেষ হতে চায় না।
পরদিন সন্ধ্যায় হাছানসহ গিয়েছিলাম মোহাম্মদপুর একটা বিশেষ কাজে, সেখানে রাসেলের সাথে দেখা।
. . . ২০০২ সালের জানুয়ারীর ২ তারিখে আমি লন্ডন আসি। রাসেল আসে মে মাসে, সেই থেকে পরিচয় এবং প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। বয়সে আমার ছোট, ছোটভাইয়ের মত হলেও গভীর একটা মায়ার সম্পর্কে জড়িয়ে আছি। আট/নয় বছর লন্ডন থাকতে রাসেলের সাথে নিবিঢ় যোগাযোগ ছিলো। এখনও যখন দেশে আসি আর রাসেল যদি ঢাকায় থাকে আমরা দেখা করি। অল্প সময়ের জন্যে হলেও দেখা হলে অনেক ভালোলাগায় মনটা ভরে যায়।
১১ তারিখ শাহজাহান কাকা (চাচাশশুর) ও তাঁর পরিবারবর্গ এসেছিলো বাসায়। উদ্দেশ্য আম্মা এবং কান্তার স্বামী-সংসার দেখা।
. . . ২০০৫ এর একদম শুরুর দিকে, যখন কান্তার সাথে আমার বিয়ের প্রাথমিক কথাবার্তা চলছিলো শাহজাহান কাকা তখন স্কটল্যান্ডে। আব্বা (আমার শশুর) উনাকে তদন্তের ভার দিলেন, অর্থাৎ ছেলে কেমন খোঁজ খবর নিতে। খোঁজ খবর নেবার কি আছে? বিদেশে থাকে এসব পোলাপানের চরিত্রের ঠিক আছে? তারপরও শাহজাহান কাকা সেই স্কটল্যান্ড থেকে লন্ডন আসলেন, সাথে এক বন্ধুও ছিলো। শীতের এক সন্ধ্যা আমার বাসায় কাটালেন। আমার সাথে অনেক গল্প করলেন, উপরে গিয়ে বেডরুম বাথরুম দেখলেন। নীচের লিভিংরুম, কিচেন, আরেকটা টয়লেট সব দেখলেন। তারপর বাংলাদেশে খবর পাঠালেন, “চোখ বন্ধ কইরা বিয়া দিয়া দাও।” আমার শশুর-শাশুড়ীও চোখ বন্ধ করলেন, সেই থেকে কান্তাবিবির লাইফ ‘হেল’। আর শাহজাহান কাকার কাছে আমি চীরঋণী।
শাহজাহান কাকা, কাকী, রাতুল, রাহাত এবং সাকিব, সাথে রাতুল ও রাহাতের বৌ, রাতুলের মেয়ে সবাই এসেছিলো। সন্ধ্যাটা খুবই গমগমে আর জমজাট ছিলো ওদের উপস্থিতিতে।
এবার দেশে আশার পর আমার বিশেষ ইচ্ছা আম্মাকে নিয়ে বেড়াতে যাবো। আল্লাহ্ আমার এই নেক ইচ্ছা কবুল করেছেন। ১৩ জানুয়ারী আম্মাকে নিয়ে স্বপ্না আপুর বাসায় গেলাম। আপুর বাসা নারায়নগঞ্জের ভুইঘর রূপায়ন টাউনে। খুবই সুন্দর এ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংগুলো সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে। দেখতে মনে হয় মালয়শিয়া বা সিঙ্গাপুরের কোন বসতি। রূপায়ন টাউনে আপু ছাড়াও আছেন সামাদ ভাই, দিসু, দিসুর স্ত্রী এবং ওদের একমাত্র ছেলে। আমার মা ভাইঝিকে কাছে পেয়ে আনন্দে একেবারে
আত্মহারা। আপু আর দিসুর বৌ অনেক কষ্ট করে অনেক কিছু রেঁধেছে। দিসুর বাবুটাও এখন মাশাল্লাহ্ অনেক কথা বলে। সামাদ ভাইয়ের সাথে গতানুগতিক খুনসুটি করেই যাচ্ছিলাম। দেখতে দেখতে কখন বিকেল গড়িয়ে গেলো টেরই পেলামনা।
আম্মাকে নিয়ে আগামীকাল আবার বের হবো ইনশা আল্লাহ্।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Post comment