বাংলার স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল – মেগা সিরিয়াল আর মেগা কমম্প্লেইন।
বিদেশী টিভি চ্যানেলগুলোর কারনে আমাদের দেশের টিভি চ্যানেলগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এই একই ঘ্যান ঘ্যান শুনে আসছি প্রায় দুই দশক ধরে। এই অভিযোগ যে কোনো মেগা সিরিয়ালের চেয়েও লম্বা, মেগা কম্প্লেইন।
২৬ টা টিভি চ্যানেল আমাদের। (এদের মধ্যে ৩টা সরকারী, বিটিভি, সংসদ টিভি আর বিটিভি ওয়ার্ল্ড) – তারপরও আমাদের দেশের মানুষ অন্য চ্যানেল দেখছে। নিজের দেশের চ্যানেল না দেখে তাদের ভাষায় অপঃসংস্কৃতি দেখছে। কেন? এমনকি সেদিনের নতুন একটি চ্যানেল (স্টার জলসা) যার বয়স এখন দেড়/দুই বছর, তার আগ্রাসনে আমাদের সবকটি চ্যানেল ভীত, আতংকিত। কেন? বিদেশী অন্য চ্যানেলগুলোর কথা এক্ষেত্রে নাহয় বাদ দিলাম। আমাদের টিভি চ্যানেল মালিকেরা প্রায়ই বলেন যে বিদেশী টিভি চ্যানেলগুলো তাদের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আকাশ আগ্রাসন করছে। আগ্রাসন? কিভাবে? লজ্জ্বা হয়না এটা বলতে?
১৯৯৩ সাল থেকে দেশের ঘরে ঘরে ডিশ এ্যান্টেনার প্রচলন শুরু হয়েছে, ক্যাবল (cable line) শুরু হয়েছে ৯৫-৯৬ থেকে। প্রচুর শব্দ, সময় (frames with silly noisy beats) আর অথর্হীন ড্রামা নিয়ে বানানো হিন্দি মেগা সিরিয়াল দেখে আসছি প্রায় বিশ বছর ধরে। আগে দেশী চ্যানেল কম ছিল বলে দর্শকেরা আগ্রহ নিয়েই ইন্ডিয়ান চ্যানলের অনুষ্ঠান দেখতো। বহুদিন ধরে দেশের দশর্করা এসব দেখতে দেখতে যখন ক্লান্তির সীমা ছাড়িয়ে নাভিশ্বাস অবস্থা, তখন তারা আমাদের দেশের এই ২৬টি চ্যানেল আঁকড়ে ধরে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে চায়। বুক ভরে নিশ্বাস নিতে চায়। কেননা আমাদের চ্যানেল আমাদের পরিবাবেরই অংশ। এখানে দেশপ্রেমের সবক দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কিন্তু বিধি বাম। কোটি কোটি দশর্কের বুকভরা ভালোবাসা থাকা সত্বেও আমাদের দেশ চ্যানেলগুলো দশর্ক হারাচ্ছে কারন দশর্কেরা হতাশ, ব্যাথিত, তাদের মন দুঃখ ভারাক্রান্ত। এর জন্যে দায়ী নিজেদের চ্যানেলগুলোই, বিদেশী চ্যানেল নয়। প্রথমতঃ আমরা আমাদের অনুষ্ঠান দেখতে চাই অথচ আমাদের শান্তিতে দেখতে দেওয়া হয় না। অনবরতঃ বিজ্ঞাপন বর্ষন, কিছুক্ষন পর পরই নয়, অনুষ্ঠান চলাকালীনও। সেকথা একটু পরে বলছি।
আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো একেকটা মুদি-মনোহরী দোকান। একটু মডার্ন করে বললে হয় ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। সেখানে খবর, সিনেমা, নাটক (ধারাবাহিক কিংবা খন্ড), খেলা, টেকনোলজি, আলোচনা, টক-শো, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, বিতর্ক, নাচ, গান, ব্যান্ড শো, মেগা সিরিয়াল (ক’দিন পর আসবে গিগা আর টেরা সিরিয়াল), টেলিফিল্ম, ট্রাভেল, ওয়াইল্ডলাইফ, নানান জিনিসের প্রতিযোগিতা। “জিনিস” অর্থাৎ Products যেমন মেয়েদর সৌন্দর্য, নাচ, গান, অভিনয়। আলাদাভাবে কিংবা প্যাকেজ হিসাবে, তা আবার বিভিন্ন বয়স ভেদে… এবং আরো কত্তো কি! মুদি-মনোহরী দোকানে যেমন পাওয়া যায় মাছ, মাংস, ডাল, শাক-শব্জি, চাল, আলু মুড়ি থেকে শুরু করে বাচ্চাদের খেলনা, স্নো, পাউডার, সাবান শ্যাম্পু, হাতুড়ি, বাটাল, মোবাইল ফোন, ইলেক্ট্রনিক্স, ল্যাপটপ, মায়া বড়ি, কনডম এবং ইত্যাদি ইত্যাদি।
বুঝলাম আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো এক একটা অল রাউন্ডার যেখানে সব হয়। তা সত্বেও সাধারন দর্শকদের প্রশ্ন, এরা এমন কেন? একদিকে আত্মপ্রসাদে অস্থির। প্রত্যেকটা চ্যানেল দেশের সেরা। অন্যদিকে দুনিয়ার ক্ষ্যাত। দেশের মানুষ যখন হিন্দি মেগা সিরিয়ালের ধড়াম ধড়াম দুর্মিশ থেকে পালিয়ে দেশী চ্যনেলমুখো হতে শুরু করেছে তখন থেকে দেশী চ্যানেলগুলো ওইসব সিরিয়ালের আদলে বাংলা মেগা সিরিয়াল গেলানো শুরু করেছে। গল্প, প্রেক্ষাপট, performance delivery সবই উদ্ভট যেগুলো আমাদের সমাজের সাথে যায় না। অস্থির! তার উপর বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি, দশ মিনিটের একটা ক্লিপে বিশ মিনিট বিজ্ঞাপন। খেই হারিয়ে ফেলে দশর্ক। বিরক্ত। মনের অজান্তে রিমোটের বাটন টেপা হয়, দশর্ক হারিয়ে যায় অন্য কোনো চ্যানেলে। মান যেমন তেমন, অশান্তি তো নেই!
অবশ্যই ভাল অনুষ্ঠানও আছে। যেমনঃ-
১. ইত্যাদি – স্মরণকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান যা দেখে মানুষ আনন্দ পায় এবং শেখে।
২. মাটি ও মানুষ – বতর্মান নাম ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ,’ যা কিনা জনপ্রিয়তার রেকর্ড করেছিল
৩. টক শো – রাজনীতির প্রতি মানুষের যতই রাগ, ঘেন্না, অভিমান থাক না কেন, আগ্রহ আছে প্রবল। তাই টক শো আমাদের দেশে অনেক অনেক জনপ্রিয়।
৪. বাংলাদেশি ধারাবাহিক, খন্ড নাটক, টেলিফিল্ম ইত্যাদি – স্বয়ং ওপারের দশর্কেরা স্বীকার করে যে সবচেয়ে সাধারন মানের নাটকটিও ওদের মোস্ট কালারফুল সিরিয়ালের চেয়ে ভালো কেননা দশর্কেররা সাজগোজ বা শাড়ি গয়নার দিকে তাকিয়ে থাকেনা, তারা পারফরমারদের পারফরম্যান্স উপভোগ করে।
আরো আছে, গান, গানের প্রোতিযোগিতা, ট্রাভেল প্রোগ্রাম দেশের এবং বিদেশে, ছোটদের অনুষ্ঠান, ক্রাইম রিপোর্ট, ইসলামী সাওয়াল-জবাব ইত্যাদি।
ভাল অনুষ্ঠানতো কম নেই, তারপরও বেহায়া স্বদেশী দশর্ক কেন ছোটে বিদেশী চ্যানেলে? কারন আমাদের দেশের প্রত্যেকটা চ্যানেলের দারিদ্র সহনীয় মাত্রার সীমা ছাড়িয়েছে বহু আগে। একেকটা চ্যানেলের জন্ম হয়েছে কোটি-কোটি-কোটি টাকা ঘুষের মাধ্যমে। তারপর ইনফ্রাস্ট্রাকচার, ওভারহেড, চাঁদা, এই খরচ, ওই খরচ করে মালিকপক্ষ ক্ষ্যাপাটে হয়ে আছে প্রফিটের জন্য। বিজ্ঞাপন বিক্রি হয় প্রতি-সেকেন্ড আর টিভি স্ক্রীনের পিক্সেল হিসেবে। বিজ্ঞাপন থেকে প্রচুর আয় হলেও চ্যানেল মালিকেরা দাবী করে সেটা যথেষ্ঠ নয়। সাধারণ মানুষ এসব গাঁজাখুরী গপ্পো বিশ্বাস করেনা।
ক্ষোভ, হতাশা, দুঃখ। অতঃপর প্রত্যাখ্যান।
এদিকে বছরের পর বছর ধরে একটা অভিযোগ সকল শ্রেণীর দর্শকেরা করে আসছে সেটা হল বিজ্ঞাপনের অত্যাচার। দশ মিনিট অনুষ্ঠানে বিশ মিনিট বিজ্ঞাপন। নিউজ চ্যানেল ছাড়া অন্য চ্যানেলগুলোতে এক ঘন্টা পর পর প্রায় আধঘন্টাব্যাপি খবর, একই খবর সারাদিন। পরদিন নতুন খবর, কিন্তু সেই একই খবর সারাদিন। ২৪ ঘণ্টায় ১২ ঘণ্টা খবর। উফফ!! অত্যাচার সেখানেই থেমে নেই। এমন কোনও চ্যানেল নেই যেখানে শান্তিতে গোটা স্ক্রীনজুড়ে অনুষ্ঠান দেখার উপায় আছে।
বর্তমানে দেশে এলসিডি এবং এলইডি ফ্ল্যাট-স্ক্রীন টিভির জয় জয়কার। এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হল বিদ্যুৎ স্বাশ্রয়ী, এনার্জি সেভিং। বেশীরভাগই স্মার্ট টিভি, ভাল মানের স্ক্রীন (HD, UHD, 4K ইত্যাদি), দামও সহনীয়। এক সময় ২৪ ইঞ্চি টিভি মানে বড় টিভি ছিল। আজকাল সবার ঘরে ঘরে ফ্ল্যাটস্ক্রীন টিভি যার স্ক্রীন সাইজ ৩২ থেকে ৬২ ইঞ্চির মধ্যে। ধরুন আপনার টিভির স্ক্রীন সাইজ ৩২ ইঞ্চি (কোনাকুনি), সুতরাং স্ক্রীনের উচ্চতা প্রায় ১৬ ইঞ্চি এবং প্রস্থ ২৮ ইঞ্চি। যে কোনো অনুষ্ঠান দেখার সময় কয়েক সেকেন্ড পর পর বাঁ দিক থেকে ১০ ইঞ্চি আর নিচ থেকে ৪ বা ৬ ইঞ্চি জুড়ে বিজ্ঞাপন। এ্যানিমেটেড বা স্লাইড। কখনো প্লাস্টিকের বিজ্ঞাপন, কখনো গুঁড়োদুধ, মোবাইল নেটওয়ার্ক, নারকেল তেল, ড্রিঙ্কস আরো কত পণ্য। স্ক্রীনের জায়গা বাকি থাকে কতখানি? টিভি কিনলেন ৩২ ইঞ্চি, অনুষ্ঠান দেখতে পারছেন ১৮ বা ২০ ইঞ্চির মধ্যে। বাকিটুকুতে বিজ্ঞাপন। দর্শকের গলা টিপে গেলানো হচ্ছে এসব বিজ্ঞাপন। দর্শক পছন্দ করছে কি করছেনা সেটা বিবেচ্য নয়। আরো আছে, সারা বছর ধরে বিভিন্ন পালা পার্বন লেগে থাকে। ‘এই’ মাস, ‘ওই’ সপ্তাহ, ‘সেই’ দিবস। সারাক্ষন এসবের স্লোগান ঝালর হয়ে জ্বলছে আর নিভছে স্ক্রীনের কোথাও না কোথাও। ভালমত হিসাব করলে দেখা যায় স্ক্রীনের অর্ধেক চলে যাচ্ছে বিজ্ঞাপনে। মজার বিষয় হচ্ছে, এইভাবে আয় করার বুদ্ধি তারা পেয়েছে ইনডিয়ান চ্যানেলগুলোর কাছ থেকে। কিন্তু মাত্রায় ছাড়িয়ে গেছে বহুগুন। অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপন বিরতি, এটা অতীত। এখন বিজ্ঞাপন চলতে থাকে সারাক্ষন। পথর্ক্য হল অনুষ্ঠানের বিরতিতে বিজ্ঞাপন চলে পুরো পর্দা জুড়ে। অনুষ্ঠান চলাকালীন বিজ্ঞাপন চলে আংশিক পর্দা জুড়ে। মানেটা কি দাঁড়ালো? যতক্ষন টিভি দেখছি ততক্ষন বিজ্ঞাপন দেখছি। দেখতে বাধ্য হচ্ছি। যে কোনো অনুষ্ঠান প্রচারিত হচ্ছে কোনো না কোনো ব্র্যান্ডের সৌজন্যে। ধরুন, সুন্দরী প্রতিযোগিতা স্পন্সর করছে আলমের এক নং পঁচা সাবান, সেক্ষেত্রে অনুষ্ঠানের নাম হয়ে যাচ্ছে “এক নং পঁচা” সুন্দরী প্রতিযোগিতা।
ঘন্টায় ঘন্টায় খবর। খবরের প্রতিটা শিরোনাম বিক্রি হচ্ছে কারো কাছে, তাদের বিজ্ঞাপন। একেক অংশ বিক্রি হচ্ছে একেক প্রতিষ্ঠানের কাছে, তাদের বিজ্ঞাপন যেমন মুল সংবাদ, দেশের খবর, আন্তর্জাতিক সংবাদ, সব। শিরোনাম “উহার” সৌজন্যে, খেলার খবর ‘ইহার’ সৌজন্যে, আবহাওয়ার পূর্বাভাষ ‘তাহার’ সৌজন্যে। আর এইসব কনসেপ্টও কারো না কারো কাছ থেকে ধার করা। হাস্যকর, আবার মর্মান্তিক, দুঃখজনক। দর্শকেরা জেলখানার কয়েদী না।
কিছু চ্যানেল কথায় কথায় আমাদের দেশের সংস্কৃতির কথা বলে সব সময়, বার বার। তাদের কাছে দেশী সংস্কৃতি হচ্ছে দেশী মেয়েদের নিয়ে বিদেশী স্টাইলে সুন্দরী প্রতিযোগিতা, বিদেশী মেগা সিরিয়াল নকল করে দেশী কলা কুশলীদের দিয়ে হাস্যকর সিরিয়াল বা মেগা সিরিয়াল বানানো যার সাথে সত্যিকার দেশীয় সমাজের কোনও মিল নেই। সেই টিভি মালিকেরাই সবাই একজোট হয়ে যখন দেশের সংস্কৃতি নিয়ে হাহাকার তোলে, মিটিং আর টক শো করো, তখন দশর্কেরা হাসে। আর রিমোটের বাটন টেপে, চলে যায় ভিনদেশী চ্যানেলে।
অন্যের ঘাড়ে দোষ না চাপিয়ে নিজের দুর্বলতাগুলো স্বীকার করে কিভাবে দর্শকদের ফিরিয়ে আনা যায় সেটা ভাবতে হবে। স্মার্ট হতে হবে। দর্শকদের বোঝাতে হবে যে তাঁদের প্রছন্দ-অপছন্দের প্রতি খেয়াল রাখা হয়, তাঁদের শ্রদ্ধা করা হয়। পছন্দের অনুষ্ঠান যদি একরাশ বিরক্তি নিয়ে দেখতে হয়, কার ভাল লাগে সেটা? দর্শক জানে বিজ্ঞাপন ছাড়া টিভি চ্যানেল বাঁচবেনা। তাই বলে দর্শকদের বিরক্ত করে তাড়িয়ে দিয়ে অন্য চ্যানেল দেখেতে বাধ্য (এবং অভ্যস্থ) করে এখন বিদেশী চ্যানেলগুলোকে আগ্রাসী বলে লাভ হবেনা। দর্শক ফিরে আসবেনা।